মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক-যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভারত-আমেরিকার মধ্যে চড়ছে পারদ। এই আবহে রাশিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নিশানা করলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ওয়াশিংটনের কাজকর্মকে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর ওই মন্তব্যের পর পাল্টা সুর চড়ান ট্রাম্পের বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারো। ফলে দু’তরফে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ সম্পর্কে ফাটল যে ক্রমশ চওড়া হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
তিন দিনের মস্কো সফরে গিয়ে গত ২১ অগস্ট রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন জয়শঙ্কর। এ ছাড়া রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লেভরভের সঙ্গেও বৈঠক হয় তাঁর। পরে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে ক্রেমলিনের তেল আমদানির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করতে শোনা যায় বিদেশমন্ত্রীকে। ঠিক তখনই তিনি বলেন, ‘‘মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির কোনও মাথামুন্ডু নেই।’’
রাশিয়ার থেকে ‘উরাল ক্রুড’ (মস্কোর অপরিশোধিত তেলের নাম) কেনার জন্য সম্প্রতি ভারতকে নিষেধাজ্ঞার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘বিশেষ কোনও ব্যক্তি সম্পর্কে (পড়ুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট) কোনও মন্তব্য করব না। তবে এই বিষয়ে কিছু কথা বলতে চাই। আমরা রুশ তেলের সর্বাধিক ক্রেতা নই। এ ক্ষেত্রে এক নম্বরে রয়েছে চিন।’’
এর পরেই আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দুনিয়াকে আয়না দেখান ভারতের বিদেশমন্ত্রী। বলেন, ‘‘আমরা রাশিয়ার থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস বা এলএনজি) কিনছি না। সেটা সম্ভবত কিনছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ২০২২ সালের পর মস্কোর সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক লেনদেন সর্বাধিক বৃদ্ধি পায়নি। আমি মনে করি সেই তালিকায় দক্ষিণের কিছু দেশ রয়েছে।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর স্বাভাবিক ভাবেই একটি প্রশ্ন সামনে এসেছে। এই দেশগুলির ক্ষেত্রে কেন খড়্গহস্ত হচ্ছে না ওয়াশিংটন?
পাশাপাশি, নয়াদিল্লিকে যে আমেরিকাই একটা সময়ে রাশিয়ার থেকে খনিজ তেল কিনতে বলেছিল, সংশ্লিষ্ট বৈঠকে তা-ও স্পষ্ট করেন জয়শঙ্কর। তাঁর কথায়, ‘‘গত কয়েক বছরে ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম স্থির রাখতে আমাদের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার অনুরোধ করে যুক্তরাষ্ট্র। তার মধ্যে রাশিয়ার থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানিও ছিল। ঘটনাচক্রে আমরা ওয়াশিংটনের থেকে খনিজ তেল কিনে থাকি এবং সেটা বর্তমানে বৃদ্ধি করা হয়েছে। তার পরেও যে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, তাতে আমরা বিভ্রান্ত।’’
জয়শঙ্করের এ-হেন মন্তব্যের পরেও ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য পুরনো অবস্থানে অনড় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাণিজ্য উপদেষ্টা নাভারো পাল্টা বলেছেন, ‘‘ভারতের রুশ তেলের কোনও প্রয়োজন নেই। ওরা মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ কিনে সেটা শোধন করে ইউরোপ এবং আমেরিকার বাজারে চড়া দামে বিক্রি করছে। এতে মুনাফা হচ্ছে নয়াদিল্লির। অন্য দিকে, ভারতকে তেল সরবরাহ করে সেই পয়সায় ইউক্রেনের বাসিন্দাদের হত্যা করতে আরও অস্ত্র কিনছে ক্রেমলিন।’’
কূটনীতিকদের অনুমান, আগামী দিনে এই যুক্তিতেই ভারতের উপরে বড় নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারে আমেরিকা। সেই আতঙ্কে রাশিয়া থেকে খনিজ তেল আমদানি অবশ্য বন্ধ করছে না নয়াদিল্লি। মস্কোয় লেভরভের সঙ্গে বৈঠকের পর জয়শঙ্কর বলেন, ‘‘আমরা বিশ্বাস করি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক সবচেয়ে দৃঢ় ভাবে অগ্রসর হয়েছে, যা বিশ্বের অন্যতম মাইলফলক।’’
চলতি বছরেই নয়াদিল্লি আসার কথা রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। সেখানে কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হবে, জয়শঙ্করের মস্কো সফরে তার রূপরেখা ঠিক হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ভূ-রাজনৈতিক নানা জটিলতা সত্ত্বেও দুই দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং আমজনতার মধ্যে যোগাযোগকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দৃঢ় ভিত্তি বলে সেখানে উল্লেখ করেছেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী।
গত ২০ অগস্ট ভারতের সঙ্গে খনিজ তেলের বাণিজ্য নিয়ে বড় ঘোষণা করেন এ দেশে কর্মরত রুশ উপ-বাণিজ্য প্রতিনিধি এভজ়েনি গ্রিভা। নয়াদিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের থেকে ‘তরল সোনা’ কেনার ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ ছাড় পাবে ভারত।’’ তবে এ ব্যাপারে দু’তরফে যে বাণিজ্যিক গোপনীয়তা রাখা হচ্ছে, তা স্পষ্ট করেছেন তিনি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (পড়ুন স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এর জেরে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় মস্কোর উপরে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। এর পরেই অর্থনীতি বাঁচাতে নয়াদিল্লিকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রি করতে থাকে মস্কো। বিষয়টি লাভজনক হওয়ায় ক্রেমলিনের প্রস্তাবে দেরি করেনি কেন্দ্র।
গত সাড়ে তিন বছরে ভারতকে ‘তরল সোনা’ বিক্রির দর যে রাশিয়া একই রেখেছে, তা নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ‘উরাল ক্রুড’-এ বেশি ছাড় দিচ্ছিল মস্কো। পরে সেটা কমিয়ে দেওয়ায় ক্রেমলিনের অশোধিত তেল আমদানির পরিমাণ কিছুটা হ্রাস করে নয়াদিল্লি। রাশিয়া ফের অতিরিক্ত ছাড় ঘোষণা করায় ওই সূচকের ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে ভারত-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এত দিন আন্তর্জাতিক লেনদেন ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক টেলিকমিউনিকেশন’ বা সুইফ্টের মাধ্যমে চলছিল। কিন্তু, নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে ওই পরিষেবা থেকে মস্কোকে ব্রাত্য রেখেছে পশ্চিমি দুনিয়া। ফলে আর্থিক আদানপ্রদানের জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে মিলে একটি বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে ক্রেমলিন।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতি রয়েছে। মস্কো সফরে গিয়ে সেই অঙ্ক কমানোর ব্যাপারে সওয়াল করেছেন বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর। ক্রেমলিন অবশ্য এ দেশের পণ্যের জন্য ঘরোয়া বাজার খোলার ইঙ্গিত দিয়েছে। ফলে দু’তরফে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কূটনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
গত জুলাইয়ে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। ফলে ২৭ অগস্ট থেকে মার্কিন বাজারে এ দেশের সামগ্রীর উপরে ৫০ শতাংশ কর নেবে তাঁর প্রশাসন। এর জেরে আমেরিকায় ভারতীয় পণ্য বিক্রি করা কঠিন হতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রুশ বাজারে ঢোকার সুযোগ মিললে আর্থিক লোকসান যে অনেকটাই আটকানো সম্ভব হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ট্রাম্পের বাণিজ্যিক উপদেষ্টা নাভারো আবার নয়াদিল্লিকে ‘শুল্কের মহারাজা’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তাঁর হুঁশিয়ারি, ‘‘রুশ তেল কেনা ভারত বন্ধ না করলে অতিরিক্ত শুল্ক দিতেই হবে। ওদের সঙ্গে আমাদের বড় মাপের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এতে মার্কিন অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মস্কোর ‘তরল সোনা’ আমাদের বিক্রি করে ওরা মুনাফা করছে।’’
তবে ভারতকে নিয়ে ট্রাম্পের নীতির কড়া সমালোচনা করেছেন তাঁরই সতীর্থ তথা রাষ্ট্রপুঞ্জের মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি। তাঁর যুক্তি, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের মূল শত্রু হল চিন। বেজিঙের বিরুদ্ধে কৌশলগত অংশীদার হিসাবে ভারতকে পাশে পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হল, শুল্ক নিয়ে বাড়াবাড়ির জেরে নয়াদিল্লি ধীরে ধীরে মুখ ফেরাতে শুরু করেছে। আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রকে এর চরম খেসারত দিতে হতে পারে।’’
পুতিনের ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন রুশ ডেপুটি চিফ অফ মিশন রোমান বাবুশকিন। নয়াদিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি হিন্দিতে বলেন, ‘‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফের মতো কোনও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারত তৈরি করলে প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে সাহায্য করবে মস্কো।’’
অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতে ফ্রান্সকে পাশে পেতে পারে ভারত। গত ২১ অগস্ট এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) একটি বিস্ফোরক পোস্ট করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘আগামী বছর (পড়ুন ২০২৬) ভারতে ব্রিকস-ভুক্ত দেশগুলির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির যাবতীয় পদক্ষেপকে সমর্থন করবে প্যারিস।’’
বর্তমানে ভারত, রাশিয়া এবং চিন-সহ ব্রিকসে মোট ১০টি দেশ রয়েছে। মস্কো এই সংগঠনের একটি পৃথক মুদ্রা চালু করতে আগ্রহী। যদিও তাতে আপত্তি রয়েছে নয়াদিল্লির। প্রথম দিন থেকেই ব্রিকসকে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হিসাবে দেখে আসছেন ট্রাম্প। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির বিরুদ্ধে বেশ কয়েক বার তোপ দাগতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে।
গত ১৫ অগস্ট পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ থামাতে আমেরিকার আলাস্কায় পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। পরে সংঘাত বন্ধ করতে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কিকে সঙ্গে নিয়ে ফের এক বার রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা করার আশ্বাস দেন তিনি। যদিও সেই অবস্থান থেকে বর্তমানে সরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ফলে নতুন করে নয়াদিল্লির উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর ফিকির ওয়াশিংটন খুঁজছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এই আবহে জয়শঙ্কর সুর চড়ানোয় তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।