যে দিকে চোখ যায়, নজরে পড়ে বরফে মোড়া শূন্যতা। এই পৃথিবীতেই এমন জায়গা আছে যেখানে গেলে মনে হবে যেন অন্য কোনও গ্রহে এসেছি। জায়গাটা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধেরও সবচেয়ে উত্তরে, সোয়্যালবার্ড নামে এক দ্বীপপুঞ্জ— যার পরে আর মানুষের বাসচিহ্ন নেই।
কিন্তু সেই সোয়্যালবার্ডেরই এক রহস্যময় উপগ্রহচিত্র এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। সেই ছবিতে দেখা গিয়েছে, সুমেরু বৃত্তের কাছে ওই দ্বীপের উপকূলে ভিড় জমিয়েছে দৈত্যাকার প্রাণীর দল। আর তার পরেই হইচই পড়েছে বিজ্ঞানীমহলে।
উত্তর মেরুকে ঘিরে আছে আর্কটিক বৃত্ত, যা সাড়ে ৬৬ ডিগ্রি অক্ষাংশ থেকে মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানেই আছে আর্কটিক মহাসাগর। উত্তর মেরুর সবচেয়ে কাছে আছে চারটি দেশ— কানাডা, গ্রিনল্যান্ড, নরওয়ে আর রাশিয়া। নরওয়ের উত্তরে নরওয়েজিয়ান সমুদ্র পেরিয়ে সোয়্যালবার্ড দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান, ‘স্পিট্জ্বারজেন’ নামেও লোকে চেনে একে।
সোয়্যালবার্ড তার অনন্য এবং রহস্যময় নিয়মের জন্য বিখ্যাত। সুমেরু বৃত্তের কাছে বরফে ঢাকা সেই দ্বীপপুঞ্জেই রয়েছে ‘সোয়্যালবার্ড গ্লোবাল সিড ভল্ট’।
সেই ভল্টে রাখা আছে ১২ লক্ষের বেশি শস্যবীজের নমুনা। ভবিষ্যতের ধরিত্রীতে খাদ্যসুরক্ষার অভাব দেখা দিলে সেই দরজা খুলে দেওয়া হতে পারে। ফসল তৈরি করা যেতে পারে ভল্টে থাকা শস্যবীজ থেকে।
শীতের মাসগুলিতে সোয়্যালবার্ডে সূর্যের মুখ দেখা যায় না। এ রকম পরিস্থিতিতে হতাশার ঝুঁকি বাড়ে বলে ‘বিষণ্ণতার দ্বীপ’ নামেও পরিচিত সোয়্যালবার্ড। সোয়্যালবার্ড ১৯২০ সালের ‘সোয়্যালবার্ড চুক্তি’ দ্বারা শাসিত, যা ৪০টিরও বেশি দেশ দ্বারা অনুমোদিত।
সেই সোয়্যালবার্ডে এ বার নতুন রহস্য। নরওয়ের মূল ভূখণ্ড এবং উত্তর মেরুর মাঝখানে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জের প্রত্যন্ত তীরে বিশালাকার প্রাণীর সমাবেশ দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
কিন্তু কী সেই অতিকায় প্রাণী? উপগ্রহচিত্র ভাল করে পরখ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সেই বিশাল প্রাণী অন্য কিছু না, সিন্ধুঘোটক। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার (ডব্লিউডব্লিউএফ)’ এবং ‘ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে (বিএএস)’-এর সহযোগিতায় ‘ওয়ালরাস ফ্রম স্পেস’ নামে প্রকল্পের মাধ্যমে সেই খোঁজ চালানো হয়েছে।
সমুদ্রের বরফঠান্ডা জল থেকে উপকূলে উঠে এসে সিন্ধুঘোটকদের সমাবেশ করা মেরুবৃত্তীয় বন্যপ্রাণী গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। সোয়্যালবার্ডে দ্বীপপুঞ্জের ওই উপকূলে এর আগে সিন্ধুঘোটকদের সমাবেশ কখনও লক্ষ করা যায়নি। উপগ্রহচিত্রে প্রথম ধরা পড়ল সেই দৃশ্য।
‘ওয়ালরাস ফ্রম স্পেস’ প্রকল্পটি শুরু হয়েছে ২০২১ সাল থেকে। মেরুবৃত্তীয় প্রাণীদের সংরক্ষণের চেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানের জন্য হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক উপগ্রহচিত্রের মাধ্যমে সিন্ধুঘোটক শনাক্ত এবং গণনা করার জন্য কাজ করেন সেই প্রকল্পে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অতিকায় প্রাণীগুলি কী ভাবে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে, তা-ও পর্যবেক্ষণ করা হয় ওই প্রকল্পে।
বিশালাকার এক একটি সিন্ধুঘোটকের ওজন দু’হাজার কিলোগ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। বিশ্রাম এবং প্রজননের জন্য মূলত সমুদ্রের বরফের চাঁইয়ের উপর নির্ভর করে সেই প্রাণী। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বরফ গলার কারণে বিশ্রাম এবং পরিবহণের জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে সিন্ধুঘোটকদের জন্য।
সোয়্যালবার্ডের উপকূলে সিন্ধুঘোটকদের এ রকম জমায়েত, সুমেরুর আবহাওয়া পরিবর্তনের অনেক লক্ষণের মধ্যে একটি বলেও মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। ডব্লিউডব্লিউএফ-এর ‘পোলার অ্যান্ড ওশান’ বিভাগের প্রধান উপদেষ্টা রড ডাউনির কথায়, ‘‘সিন্ধুঘোটকেরা বিশাল এবং শক্তিশালী প্রাণী। কিন্তু জলবায়ু সঙ্কটের কারণে তারা ক্রমবর্ধমান ভাবে ঝুঁকির মুখে রয়েছে। কারণ তাদের নীচে থেকে সমুদ্রের বরফ আক্ষরিক অর্থেই গলে যাচ্ছে।’’
সিন্ধুঘোটক কেবল তাদের বিশাল আকার এবং দাঁতের কারণে বিখ্যাত, তেমনটা নয়। সুমেরুর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অতিকায় এই প্রাণী। উত্তর গোলার্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হিসাবে তাদের উপস্থিতি সুমেরুর সমগ্র খাদ্যশৃঙ্খল এবং স্থানীয় জীববৈচিত্রকে প্রভাবিত করে।
সিন্ধুঘোটক সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী। জমায়েত করতে, বিশ্রাম নিতে এবং সন্তানের জন্ম দিতে সমুদ্রের বরফের উপর নির্ভর করে তারা। তবে সমগ্র বিশ্বের তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে প্রতি বছর সুমেরুর বরফ একটু একটু করে গলছে।
ফলে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সিন্ধুঘোটকেরাও বাধ্য হয়ে সমুদ্র ছেড়ে উপকূলে উঠে আসছে। কিন্তু এই অভ্যাস তাদের অতিরিক্ত ভিড় এবং সংঘাতের ঝুঁকির মুখে ফেলেছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
‘ওয়ালরাস ফ্রম স্পেস’ প্রকল্পের অধীনে সুমেরুবৃত্ত জুড়ে সিন্ধুঘোটকদের সংখ্যা নির্ভুল ভাবে পর্যবেক্ষণ করে গবেষকদের দল। এর জন্য বিজ্ঞানীদের ওই দল উপগ্রহচিত্রের উপরও নির্ভর করে।
উপগ্রহচিত্রের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য বিজ্ঞানীদের আরও ভাল ভাবে বুঝতে সাহায্য করে, পরিবেশগত পরিবর্তনে কী ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে সিন্ধুঘোটকেরা। সিন্ধুঘোটকদের উপর ক্রমাগত নজরদারি কেবল তাদের বেঁচে থাকার জন্য নয়, বরং তাদের উপর নির্ভরশীল বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিজ্ঞানীদের মতে, জলবায়ু সঙ্কট যত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তত জরুরি হয়ে পড়েছে সিন্ধুঘোটকদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও। মানুষের কার্যকলাপ এবং পরিবেশগত ক্ষতির কারণে অসংখ্য সিন্ধুঘোটক বর্তমানে হুমকির মুখে।
গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বের গড় তাপমাত্রার দ্বিগুণ হারে উষ্ণ হচ্ছে সুমেরু। সমুদ্রের বরফের দ্রুত গলে যাওয়াই তার প্রমাণ। ফলে সিন্ধুঘোটকদের আবাসস্থল রক্ষা এবং তাদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করার জন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ না করলে অতিকায় এই প্রাণী এবং সুমেরুবৃত্তের অন্যান্য প্রজাতি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হবে।