প্রথমে বালোচিস্তান, তার পর খাইবার-পাখতুনখোয়া। এ বার অগ্নিগর্ভ সিন্ধ প্রদেশেও তীব্র হচ্ছে স্বাধীনতার স্লোগান। শুধু তা-ই নয়, সেখানকার আমজনতার নিশানায় রয়েছেন মূলত সেনা অফিসার ও জওয়ানেরা। ফলে অস্বস্তি বেড়েছে পাকিস্তান ফৌজ এবং শাহবাজ় শরিফ সরকারের। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে ইসলামাবাদের গলার কাঁটা হতে পারে ভারত সীমান্ত লাগোয়া দক্ষিণের এই প্রদেশ। নয়াদিল্লি এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
‘অপারেশন সিঁদুর’ স্থগিত হতে না হতেই চোলিস্তান খাল প্রকল্পকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ। গত ২০ মে ওই আন্দোলনের একটি ভিডিয়ো এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে এলাকাবাসীকে সেনা কনভয় আটকে স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছে। সিন্ধবাসীরা পাক সৈনিকদের ‘দুশমন’ বা শত্রু বলে উল্লেখ করতেও পিছপা হননি। যদিও সংশ্লিষ্ট ভিডিয়োর কোনও সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম।
এক্স হ্যান্ডলে ভাইরাল হওয়া ভিডিয়োটিতে এলাকাবাসীদের ‘কাল বনা থা বাংলাদেশ, আজ বনেগা সিন্ধুদেশ’ বলে স্লোগান দিতেও শোনা গিয়েছে। এর পরই সেনা কনভয় আটকে দেন তাঁরা। শুরু হয় পাক সৈনিকদের সঙ্গে তর্কাতর্কি। উর্দিধারীদের বক্তব্য ছিল ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে সীমান্ত থেকে ফিরছেন তাঁরা। এ কথা শুনে আরও ফুঁসে ওঠেন আন্দোলনকারীরা। উন্মত্ত সিন্ধবাসীর বিরুদ্ধে ফৌজি ট্রাক দখলের পাশাপাশি বেশ কয়েক জন সৈনিককে আটকে রাখার অভিযোগও উঠেছে। রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর থেকে অবশ্য এই ইস্যুতে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি আসেনি।
পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ বিপুল সংখ্যায় সিন্ধি ভাষাভাষীদের আবাসস্থল হিসাবে পরিচিত। পাশতুনভাষী পাঠানদের সংখ্যাও সেখানে নেহাত কম নয়। ভৌগোলিক দিক থেকে এলাকাটির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, সিন্ধের দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে করাচি বন্দর, যা ইসলামাবাদকে সামুদ্রিক রাস্তা দিয়েছে। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট শহরটিকে পাক অর্থনীতির ভরকেন্দ্র বলে মনে করা হয়। সেখানে রয়েছে শেয়ার বাজার-সহ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর। এ হেন সিন্ধ স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে পাকিস্তান যে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
সিন্ধ প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম কিন্তু সদ্য হয়েছে, এমনটা নয়। দেশভাগের মাধ্যমে পাকিস্তান তৈরির কিছু দিন পর থেকেই ধীরে ধীরে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে সেখানে। ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে বাংলাদেশ গঠিত হলে হাওয়া পায় স্বাধীন সিন্ধুদেশের আন্দোলন। এর নেতৃত্বে ছিলেন গুলাম মুর্তাজা সৈয়দ নামের এক জাতীয়তাবাদী নেতা। পরবর্তী কালে এর নেতৃত্ব দিতে দেখা গিয়েছে ‘জয় সিন্ধ কওমি মাহাজ়’ নামের সেখানকার একটি রাজনৈতিক দলকে। সাম্প্রতিক বিক্ষোভের নেপথ্যেও তাদের হাত রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সিন্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অভিযোগ, তাঁদের এলাকার যাবতীয় সম্পদ লুট করছে পাক সেনা এবং পঞ্জাব প্রদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে সিন্ধিদের ভাষা ও সংস্কৃতি। এলাকাবাসীদের কণ্ঠস্বর দমিয়ে ফেলতে বার বার স্বৈরশাসনের অভিযোগও উঠেছে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে। সেই কারণেই পাক ফৌজকে ‘অবৈধ দখলদার’ বলে মনে করেন তাঁরা। এই অভিযোগ একেবারেই উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কারণ পাক সরকার এবং সেনার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ রয়েছে স্বাধীনতাকামী বালোচ বিদ্রোহীদেরও।
দেশভাগের পর উর্দুকে জাতীয় ভাষা বলে ঘোষণা করেন পাকিস্তানের জন্মদাতা মহম্মদ আলি জিন্না। তাঁর যুক্তি ছিল, এতে সবাইকে সংঘবদ্ধ রাখা যাবে। কিন্তু, এর ফল হয় হিতে বিপরীত। বাংলাভাষী পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা এর ফলে সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন। এই নিয়ে আন্দোলন তীব্র হলে ১৯৭০ সালে তা দমিয়ে ফেলতে সেখানে গণহত্যা চালায় ইসলামাবাদ। পাক সেনা এর নামকরণ করেছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। ওই ঘটনার এক বছরের মাথায় দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের সেই রাস্তাতেই বর্তমানে হাঁটছেন সিন্ধি ভাষাভাষীরা। এ ব্যাপারে পাশতুনদের সমর্থন পাচ্ছেন তাঁরা। সিন্ধ প্রদেশে পাক সেনা এবং গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) দৌরাত্ম্যের অভিযোগও নেহাত কম নয়। সরকার ও ফৌজের বিরুদ্ধে মুখ খোলায় তুলে নিয়ে গিয়ে হামেশাই খুন করে থাকেন উর্দিধারীরা। এর পর গায়েব করা হয় মৃতদেহ, দাবি ক্ষুদ্ধ এলাকাবাসীদের। ভাইরাল ভিডিয়োয় যাঁদের সেনা কনভয় থামাতে দেখা গিয়েছে তাঁদের পড়ুয়া, শ্রমিক ও কৃষক বলে চিহ্নিত করেছে স্থানীয় গণমাধ্যম।
তবে এই ইস্যুতে ঘি ঢেলেছে সিন্ধ প্রদেশের মরু এলাকার চোলিস্তান খাল প্রকল্প। প্রবল গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে যার কাজ আপাতত স্থগিত রেখেছে শরিফ প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাঁরই সরকারের অন্যতম বড় জোট শরিক পাকিস্তান পিপল্স পার্টির (পিপিপি)। তাঁদের বিরোধিতার জেরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সিন্ধ প্রদেশের নওশাহরো ফিরোজ় জেলা।
গত ২১ মে সিন্ধ প্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিয়াউল হাসান লাঞ্জারের বাসভবনে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল উন্মত্ত বিক্ষোভকারী। ঘরে ঢুকে চলে দেদার ভাঙচুর। পরে মন্ত্রীর বাড়ি সংলগ্ন দু’টি ১০ চাকার ট্রেলারেও অগ্নিসংযোগ করে তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় পুলিশ সেখানে পৌঁছোলে দু’পক্ষের মধ্যে বেধে যায় তুমুল সংঘর্ষ। পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে গুলি চালানোর অভিযোগ। তাতে দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। আহত হন এক ডিএসপি-সহ ছয় পুলিশকর্মী।
পুলিশের গুলিতে দু’জনের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে ওঠে। উন্মত্ত জনতা এক এলাকা থেকে অন্যত্র তাণ্ডব চালাতে থাকে। সেই হিংসার একাধিক ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের একাংশকে হাতে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। ফলে কার্ফু জারি করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয় স্থানীয় প্রশাসন।
কৃষিভিত্তিক পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল বেশ শুষ্ক। আর তাই সেখানকার চাষের জমিতে জল পৌঁছে দিতে চোলিস্তান সেচ খাল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে শরিফ সরকার। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তোলে একাধিক শরিক দল। এর মধ্যে অন্যতম সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টোর তৈরি পাকিস্তান পিপল্স পার্টি বা পিপিপি।
শরিফ সরকারের অন্যতম বড় শরিক হল পিপিপি। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ এই রাজনৈতিক দলটির গড় হিসাবে পরিচিত। পিপিপির অভিযোগ, চোলিস্তান সেচ খাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চাষের জলের একচেটিয়া অধিকার পাবেন পঞ্জাবের কৃষকেরা। অন্য দিকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে সিন্ধু নদীর নিম্ন অববাহিকার সিন্ধ প্রদেশ। আর তাই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হতে না হতেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে শামিল হয় পিপিপি।
গত মাসে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বাতিল করে শাহবাজ় সরকারের ‘কমন ইন্টারেস্ট কাউন্সিল’ বা সিসিআই। জলবণ্টন এবং সেচ খাল নিয়ে পাক পঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের মধ্যে সুনির্দিষ্ট চুক্তির দাবি তুলেছে পিপিপি-সহ একগুচ্ছ শরিক দল। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির জন্য ২১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল শাহবাজ় প্রশাসন। এর মাধ্যমে চার লক্ষ একর জমিকে চাষযোগ্য করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
২০২৩ সালে ‘পাকিস্তানের সবুজায়ন উদ্যোগ’ (গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ) নামের একটি প্রকল্পের সূচনা করে ইসলামাবাদ। এর মূল উদ্দেশ্য হল কৃষির উন্নতিসাধন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির আওতায় চোলিস্তান সেচ খাল কাটার কথা ছিল। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধ ও বালোচিস্তান— এই তিনটি প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষের জল পৌঁছোনোর কথা রয়েছে।
চোলিস্তান প্রকল্পে কয়েক লক্ষ একর মরু এলাকায় মোট ছ’টি খাল কাটার কথা বলা রয়েছে। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধ ও বালোচিস্তান— তিন প্রদেশের জন্য দু’টি করে খাল বরাদ্দ করেছিল পাক সরকার। শুধু তা-ই নয়, পাঁচটি খাল সিন্ধু নদী এবং একটি খাল সিন্ধুরই শাখানদী শতদ্রু থেকে কাটার পরিকল্পনা করে ইসলামাবাদ। গত মার্চে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে সিন্ধ প্রদেশে সর্বাধিক বিক্ষোভ দানা বাঁধে।
চোলিস্তান খাল প্রকল্পের বিরোধিতার ব্যাপারে সিন্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাশে পেয়েছে পিপিপি। কিন্তু, স্বাধীন সিন্ধুদেশ তৈরিতে একেবারেই সায় নেই তাঁদের। অন্য দিকে সংশ্লিষ্ট আন্দোলনটিকে সমর্থন করার ব্যাপারে ভারতের কিছু সমস্যা রয়েছে। পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা গুজরাতের কচ্ছ এলাকার কিছু অংশকে প্রস্তাবিত সিন্ধুদেশের অন্তর্ভুক্ত করতে আগ্রহী। কোনও অবস্থাতেই নয়াদিল্লির পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী বালোচ বিদ্রোহীদেরও সরাসরি কখনও সমর্থন করেনি ভারত। তবে ইসলামাবাদের অভিযোগ, নয়াদিল্লির গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এর প্রত্যক্ষ মদত পাওয়ার কারণেই এতটা সংঘবদ্ধ ভাবে আন্দোলন পরিচালনা করতে পারছেন তাঁরা। পর্দার আড়ালে থেকে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার সিন্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করুক, এই দাবি ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে দক্ষিণের ওই প্রদেশে।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এ ভারতের হাতে মার খাওয়ার পর পদোন্নতি ঘটে ‘ফিল্ড মার্শাল’ হয়েছেন পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনির। এই নিয়েও সিন্ধ প্রদেশে জনরোষ তীব্র হচ্ছে। ‘যুদ্ধ’জয়ের প্রমাণ চেয়ে সুর চড়াচ্ছে সেখানকার আমজনতা। তবে তাঁদের পক্ষে দ্বিতীয় বাংলাদেশ হওয়া মোটেই সহজ নয়। কারণ, করাচিতে রয়েছে পাক নৌবাহিনীর সদর দফতর। এ ছাড়া আন্দোলন ভাঙতে পিপিপিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে সেখানকার গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের।