এক সময় বিশ্বের অন্যতম ধনী শহর। বালির নীচে কয়েক হাত খুঁড়লেই মিলত দামি রত্নপাথর। এখন সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যক্ত, ভূতুড়ে। শহরের কঙ্কালটাই শুধু পড়ে রয়েছে। নেই কোনও জনবসতি। বালির কণা গ্রাস করেছে শহরের ইমারতের কাঠামোকে।
স্কুল, থিয়েটার, ক্যাসিনো, হাসপাতাল, বলরুম তো ছিলই, তা ছাড়া ছিল এক্স-রে কেন্দ্র, যা দক্ষিণ গোলার্ধে প্রথম চালু হয় ওই স্থানেই। আফ্রিকার প্রথম ট্রামও চলেছিল এই শহরেই। দক্ষিণ নামিবিয়ার নামিব জেলায় অবস্থিত অধুনা পরিত্যক্ত এই শহর কোলম্যানস্কোপ।
আফ্রিকান ভাষায় শহরের নামের মানে ‘কোলম্যানের পাহাড়’। শোনা যায়, বহু বছর আগে জনি কোলম্যান নামে এক গাড়োয়ান বালির ঝড় উঠেছে দেখে যাত্রী-সহ গাড়ি ফেলে রেখে পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই নামেই শহরের নামকরণ হয়ে যায়। চিরকালের জন্য অমর হয়ে যায় গা়ড়োয়ানের নাম।
নামিব মরুভূমিকে বিশ্বের প্রাচীনতম মরুভূমিগুলির মধ্যে একটি বলে মনে করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ২ হাজার কিলোমিটার এবং এটি পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক এবং ভয়াবহ স্থানগুলির মধ্যে একটি। বন্দরশহর লিউডেরিৎজ় থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এই মরুভূমির মধ্যে রয়েছে এই ‘ভূতের শহর’।
নামিবিয়া তখন জার্মান কলোনি। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে রেললাইন পাতছে জার্মানরা। সালটা ১৯০৮। লাইন পাতার কাজ করতে করতে সেখানে এক কর্মী হঠাৎ পেয়ে যান একটি উজ্জ্বল পাথর। সেটিকে অবশ্য হিরে বলে চিনতে পারেননি সেই কর্মী। তিনি সেটা দেখান জার্মান রেল ইনস্পেক্টরকে। ব্যস, তার পরই জার্মানরা বুঝে যায় ওখানে অনেক হিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
হিরের লোভে এই অঞ্চলে ঘাঁটি গাড়তে থাকেন জার্মান ব্যবসায়ীরা। এর অল্প দিন পরেই জার্মান সরকার এই এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে হিরে উত্তোলনের কাজ শুরু করে। একটা সময় বিশ্বের মোট উত্তোলিত হিরের ১২ শতাংশ পাওয়া যেত কোলম্যানস্কোপ থেকে।
১১৭ বছর আগের ঘটনা। মরুশহরে হিরের সন্ধান পাওয়া তেমন দুষ্কর ছিল না। বালির নীচেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকত দুর্মূল্য রত্নগুলি। হাত দিয়ে বালি সরিয়ে মাত্র কয়েক ফুট গর্ত খুঁড়লেই পাওয়া যেত হিরে। এই শহরের মাটির নীচে ছিল হিরের আকর। তা থেকে হিরে সংগ্রহ করে জমিয়ে রাখতেন শহরবাসীরা।
জার্মানদের হাত ধরে ধীরে ধীরে উন্নতি ও আধুনিকতার স্বাদ পেয়েছিল ছোট্ট শহরটি। এক সময় বিশ্বের অন্যতম ধনী শহরের তকমা পেয়েছিল এটি। সেখানে মরুভূমির চরম পরিস্থিতিতেও বিলাসবহুল জিনিসপত্রের অভাব ছিল না। আর ছিল হিরের ঝলকানি।
সুসময় বেশি দিন চলেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এর দুর্দিন শুরু হয়। কারণ, এলাকার হিরে ফুরিয়ে আসছিল। ত্রিশের দশকে কোলম্যানস্কোপের থেকে ১৬৮ মাইল দক্ষিণে নামিবিয়ার সীমান্তের দিকে আরও একটি হিরের খনি আবিষ্কৃত হয়। সেখানে বিপুল পরিমাণ হিরে উত্তোলন শুরু হওয়ায় কোলম্যানস্কোপের অবস্থা দুয়োরানির মতো হতে শুরু করে।
হিরের ঝলক ফিকে হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাসিন্দারাও একে একে পাততাড়ি গোটাতে থাকেন। পত্তন হওয়ার ৪৮ বছরের মধ্যেই সমৃদ্ধ শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল। ১৯৫৪ সালে সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হয়ে যায় কোলম্যানস্কোপ। ১৯৫৬ সালে পরিবারগুলি তল্পিতল্পা গুছিয়ে চলে গিয়েছিল।
আজ এটি পর্যটকদের বেড়াবার জায়গা। পরিত্যক্ত হয়ে যাওয়ার পর ওই স্থানের দখল নিয়েছে মরুভূমি। জার্মান কায়দায় তৈরি সব বাড়ির একতলার মেঝে এখন একহাঁটু বালির তলায়। এখনও পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ এই শহর। প্রশাসনের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করা যায় এখানে।
স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত আর রবিবার সকাল ১০টা থেকে পর্যটকদের অনুমতি দেওয়া হয় ঘুরে দেখার।
দেওয়ালের উজ্জ্বল নীল বা সবুজ রং, অথবা ফুলের ওয়ালপেপার ধীরে ধীরে সময় এবং প্রকৃতির নির্মম আঘাতে রংহীন হয়ে পড়ছে। চারপাশে ঘোরাফেরা করা সরীসৃপদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বাড়িগুলি। বালির আঘাতে দরজার কব্জা ভেঙে গিয়েছে।
মরুভূমির এই ‘ভূতের শহরে’ যাঁরা প্রবেশ করেন তাঁদের সামনে উপস্থিত হয় জরাজীর্ণ ভবনগুলি। বাড়িগুলি ভয়াবহ বালির ঝড় সহ্য করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ধনী পরিবারগুলি আরও ভাল সুরক্ষার জন্য বালির পাহাড়ের মাথায় সবচেয়ে উঁচু বাড়িগুলি তৈরি করেছিলেন। পর্যটকেরা এখন হাঁটু পর্যন্ত বালিতে ভরা ঘরগুলির মধ্য দিয়ে হেঁটে যান। বালির চাদর সরিয়ে মাঝেমধ্যে উঁকি দেয় আফ্রিকার প্রথম ট্রামলাইন। কখনও উজ্জ্বল ইতিহাস, কখনও মলিন বাস্তব খেলা করে যায় বালির আড়াল থেকে।