পশ্চিমে পকিস্তান, উত্তর ও উত্তর-পূর্বে চিন। জোড়া প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতে নাজেহাল কেন্দ্র। এই পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির রক্তচাপ বাড়াচ্ছে দক্ষিণের দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। এর জন্য অবশ্য ৫১ বছর আগে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেওয়া ‘ভুল সিদ্ধান্ত’কেই দুষছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ। বিষয়টি নিয়ে ভারতের ঘরোয়া রাজনীতি জলঘোলা হওয়ার আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউ।
চলতি বছরের ১৬-১৮ অক্টোবর পর্যন্ত তিন দিনের ভারত সফর করেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হারিনি অমরসূর্য। এ দেশের মাটিতে তাঁর পা পড়ার আগেই কচ্চতীবু দ্বীপ পুনরুদ্ধারের দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লেখেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী তথা ডিএমকে নেতা এমকে স্ট্যালিন। পাঁচ দশক আগে স্বেচ্ছায় এই দ্বীপ কলম্বোর হাতে তুলে দিয়েছিল কেন্দ্র। নয়াদিল্লির সেই উদারতা যে এখন কাঁটা হয়ে পায়ে বিঁধছে, তা বলাই বাহুল্য।
স্বাধীনতার কিছু দিনের মধ্যেই কচ্চতীবুর অধিকার নিয়ে বিবাদে জড়ায় ভারত ও লঙ্কা সরকার। মাত্র ২৮৫ একর আয়তন বিশিষ্ট (প্রায় ১.৯ বর্গ কিলোমিটার) দ্বীপটির ‘কৌশলগত অবস্থান’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশের মধ্যবর্তী পক প্রণালীতে বিন্দুর আকারে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কচ্চতীবু। সংশ্লিষ্ট দ্বীপটি থেকে তামিলভূমির রামেশ্বরমের দূরত্ব মেরেকেটে ৩০ কিলোমিটার। এর খুব কাছে রয়েছে উত্তর শ্রীলঙ্কার জাফনা এলাকার নেদুনথিভু।
কচ্চতীবুর আদি নাম ছিল কাচ্চি। রামেশ্বরম শিলালিপিতে সংশ্লিষ্ট দ্বীপটির উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, দ্বাদশ শতাব্দীতে পুভাগু (বর্তমান নাম পুঙ্গুডুটিভু), মিনিনাক (বর্তমান নাম মানিনাগা) এবং কারা (বর্তমান নাম কারাইতিভু)-সহ একাধিক এলাকা পরিদর্শনের সময় কচ্চতীবু গিয়েছিলেন লঙ্কা রাজা নিস্কাঙ্ক মল্ল (১১৮৭-১১৯৬ সাল)। ওই সময়ে এর উপর কলম্বোর যে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু, ১৭ শতক আসতে না আসতেই রাতারাতি বদলে যায় কচ্চতীবুর ভাগ্য। ওই সময় মাদুরাইয়ের রামনাদ রাজ্যের অংশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে পক প্রণালীর সংশ্লিষ্ট দ্বীপ। তামিল রাজারা সেখানে একটি গির্জাও তৈরি করেছিলেন। মাদুরাই এবং রামেশ্বরমের ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের প্রায়ই সেখানে প্রার্থনা সারতে যেতে দেখা যেত। পরবর্তী ১০০ বছরে এর কোনও পরিবর্তন হয়নি।
১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধের পর ধীরে ধীরে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। গোটা ১৮ শতক ধরে তা চালিয়ে গিয়েছিলেন ইংরেজ বণিকেরা। এই সময়কালে তামিলনাড়ুও চলে যায় ব্রিটিশদের দখলে। ফলে কচ্চতীবুর দখল পায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ওই সময় প্রশাসনিক সুবিধার কথা চিন্তা করে মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই) প্রেসিডেন্সির আওতায় পক প্রণালীর দ্বীপটিকে রেখেছিলেন তাঁরা।
ভারতে কোম্পানির শাসনকালে শ্রীলঙ্কার পরিচিতি ছিল সিলোন হিসাবে। প্রায় ওই একই সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় দক্ষিণের ওই দ্বীপরাষ্ট্রও। পরবর্তী দশকগুলিকে সামরিক মহড়া এবং অত্যাধুনিক হাতিয়ারের পরীক্ষার জন্য কচ্চতীবুকে ব্যবহার করতে থাকে ইংরেজ নৌবাহিনী। কিন্তু, ১৯২০ সালে হঠাৎ করেই সংশ্লিষ্ট দ্বীপটিকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড।
বড়লাট চেমসফোর্ডের আমলে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড (১৯১৯ সাল) এবং মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনকে (১৯২০-’২২ সাল) কেন্দ্র করে উত্তাল হয় সারা ভারত। এর মধ্যেই প্রশাসনিক সুবিধার দোহাই দিয়ে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে কচ্চতীবুকে বিচ্ছিন্ন করে সিলোনের সঙ্গে পক প্রণালীর দ্বীপটিকে জুড়ে দেন তিনি। ১৯২১ সালের মধ্যে তা পুরোপুরি ভাবে চলে যায় কলম্বোর নিয়ন্ত্রণে।
কিন্তু, ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় ফের ওই দ্বীপটিকে নয়াদিল্লির কাছে ফিরিয়ে দেয় ইংরেজ সরকার। ওই সময় ব্রিটিশদের যুক্তি ছিল, প্রশাসনিক সুবিধার জন্য কচ্চতীবুকে সিলোনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু, এটি প্রকৃতপক্ষে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অংশ। আর তাই এর নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি ভাবে দিল্লির পাওয়ার অধিকার রয়েছে, কলম্বোর নয়।
অন্য দিকে, শ্রীলঙ্কায় ব্রিটিশ শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৪৮ সালে। এর পরই কচ্চতীবু দ্বীপটির উপর অধিকার দাবি করে বসে কলম্বো। শুধু তা-ই নয়, এই নিয়ে দুই দেশের মৎস্যজীবীদের মধ্যে বাড়তে থাকে বিরোধ। এই পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে ১৯৬৮ সালে ভারত সফর করেন তৎকালীন শ্রীলঙ্কা প্রধানমন্ত্রী ডুডলি সেনানায়েকে। ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সরাসরি পক প্রণালীর দ্বীপটি চেয়ে বসেন তিনি। ফলে দু’তরফে শুরু হয় আলোচনা, যা চলেছিল টানা ছ’বছর।
১৯৭৪ সালের জুনে কচ্চতীবু নিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে একটি চুক্তি করেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই সমঝোতামাফিক দ্বীপটির অধিকার পায় কলম্বো। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট চুক্তিতে পক প্রণালী এবং রাম সেতুর অন্তর্বর্তী এলাকায় সামুদ্রিক সীমান্ত নির্ধারণের প্রক্রিয়াও আনুষ্ঠানিক ভাবে সেরে ফেলে দুই প্রতিবেশী। ১৯৭৬ সালে দুই দেশের মধ্যে আরও একটি চুক্তি সম্পন্ন হয়। সেখানে সংশ্লিষ্ট দ্বীপে যাওয়ার অধিকার পান ভারতীয় মৎস্যজীবীরা।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অবশ্য মৌখিক ভাবে লঙ্কার মৎস্যজীবীদের ওই এলাকায় মাছশিকারের অধিকার দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর কন্যা ইন্দিরা ‘বন্ধুত্বের’ খাতিরে সম্পূর্ণ কচ্চতীবুকেই কলম্বোর হাতে তুলে দেন। শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক ছিল তাঁর। কিন্তু, তিনি শ্রীলঙ্কার কুর্সি হারানোর পর থেকেই ফের নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে সীমান্ত বিবাদ, আজও যার খেসারত দিতে হচ্ছে ভারতীয় মৎস্যজীবীদের।
এ দেশের মাছশিকারিদের অভিযোগ, কচ্চতীবুতে যাওয়ার আইনগত অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাঁদের উপর ‘দৌরাত্ম্য’ চালিয়ে থাকে লঙ্কার নৌবাহিনী। এর জেরে ট্রলার-সহ প্রায়ই আটক হতে হয় তাঁদের। অন্য দিকে কলম্বোর পাল্টা দাবি, সংশ্লিষ্ট দ্বীপ এবং তার আশপাশের এলাকা তাঁদের জলসীমার অন্তর্গত। অথচ সেখানে ঢুকে অহরহ মাছ শিকার করছেন ভারতীয় মৎস্যজীবীরা। সেই কারণেই বাধ্য হয়ে গ্রেফতার করতে হচ্ছে তাঁদের।
কচ্চতীবু নিয়ে দুই দেশের বিবাদের কারণ খুঁজতে গিয়ে ১৯৭৪ সালের ‘ভারত শ্রীলঙ্কা সমুদ্র সীমান্ত চুক্তি’র দিকে আঙুল তুলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের কথায়, সংশ্লিষ্ট সমঝোতায় এ দেশের মৎস্যজীবীদের ওই দ্বীপে যাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। কচ্চতীবুর সৈকত সংলগ্ন এলাকায় তাঁরা মাছ ধরতে পারবেন কি না, তা নিয়ে কিছু বলা হয়নি। জায়গাটা পক প্রণালীর গা ঘেঁষা হওয়ায় মাছশিকারিদের পক্ষে দুই দেশের জলসীমা নির্ধারণ করাও খুবই কঠিন। প্রকৃতিগত ভাবে এই সমস্যা সংঘাতকে জটিল করছে বলেও স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
২০১৫ সালে একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কচ্চতীবু নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসেন তৎকালীন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। তিনি বলেন, ‘‘ওই দ্বীপে কোনও ভারতীয় মৎস্যজীবী ঢুকলে তাঁকে গুলি করবে আমাদের নৌবাহিনী।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর কলম্বোকে হুমকি দেয় নয়াদিল্লি। পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেছিলেন দুই প্রতিবেশীর বিদেশমন্ত্রী।
এই ইস্যুতে তামিলভূমির যুযুধান ডিএমকে এবং এআইএডিএমকের মতো দলগুলির অবশ্য আলাদা অভিযোগ রয়েছে। তাদের দাবি, কোনও রকম সংবিধান সংশোধন না করে কচ্চতীবুকে শ্রীলঙ্কার হাতে তুলে দেন নেহরু-কন্যা ইন্দিরা। এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সঙ্গে এক বর্ণও আলোচনা করেনি কেন্দ্র। নেওয়া হয়নি তাদের মতামত। আর তাই রাজনীতির ময়দানে প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও কচ্চতীবুকে ফের এ দেশে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে প্রায়ই এক সুর শোনা যায় সেখানকার দলগুলির নেতানেত্রীদের গলায়।
কিন্তু বিজেপির দাবি, কচ্চতীবুকে লঙ্কা সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যাপারে পর্দার আড়ালে থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন করেছিলেন ডিএমকে নেতারা। এখনও কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধী জোটে রয়েছে তামিলভূমির এই রাজনৈতিক দল। গত বছর তথ্যের অধিকার আইনে পক প্রণালীর দ্বীপটিকে ঘিরে প্রকাশ্যে আসে সেই তথ্য। বিষয়টি নিয়ে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) পোস্ট করে কংগ্রেস এবং স্ট্যালিনের দলকে বিঁধতে ছাড়েননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
গেরুয়া শিবিরের সেই অভিযোগ অবশ্য গায়ে মাখেননি তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী। উল্টে বছর ঘুরতেই কচ্চতীবুকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে বিষয়টিকে উস্কে দিলেন তিনি। লঙ্কা প্রধানমন্ত্রী অমরসূর্যের সফরের মুখে কেন্দ্রের মোদী সরকারকে পাঠানো চিঠি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘‘২০২১ সাল থেকে আমাদের মৎস্যজীবীদের হেনস্থা করছে কলম্বোর নৌবাহিনী। এখানকার ১,৪৮২ জন মাছশিকারি এবং ১৯৮টি ট্রলার আটক করেছে তারা।’’ মোট ১০৬টি পৃথক হয়রানির ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ডিএমকে নেতা স্ট্যালিনের দাবি, কচ্চতীবুকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করতে মোট ১১ বার কেন্দ্রকে চিঠি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। অন্য দিকে কেন্দ্র জানিয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে তারা। আটক মৎস্যজীবীদের ফেরানোর বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে জটিলতা যে এখনই মিটছে না তাতে কোনও সন্দেহ নেই।