ঠিক যেন নরকের দুয়ার। পুরাণ, মহাকাব্যে যার উল্লেখ রয়েছে সেই দরজা রয়েছে এই পৃথিবীর বুকেই। পৃথিবীর নানা সংস্কৃতিতে নরক নিয়ে রয়েছে নানা মত। নরক বলতে আমাদের সামনে যে কল্পিত ছবিটা ভেসে ওঠে, এটা অবশ্য সেই নরক নয়। এ হল বাস্তবের নরক। পশ্চিম এশিয়ার তুর্কমেনিস্তানে নাকি রয়েছে এক ‘নরকের দ্বার’।
তুর্কমেনিস্তানের কারাকুম মরুভূমিতে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দাউ দাউ করে জ্বলছে সেই নরক। এর পরিচিত নাম ‘গেটওয়ে টু হেল’। ২২৯ ফুট চওড়া এবং ৬৬ ফুট গভীর বিশাল সেই গহ্বরটি ‘নরকের প্রবেশদ্বার’ নামে পরিচিত। এটি রয়েছে সে দেশের রাজধানী আশগাবাদ থেকে কিছুটা দূরে।
ধূ ধূ মরুভূমির মাঝে ২০ মিটার গভীর একটা রহস্যময় গর্ত। অর্ধদশকেরও বেশি সময় ধরে একটানা আগুন জ্বলছে সেই অগ্নিকুণ্ডে। ১৯৭১ সাল থেকে ক্রমাগত আগুন বেরিয়ে আসছে জ্বালামুখটি থেকে। মিথেন গ্যাসে ভরা এই গহ্বর দিন-রাত বছরের পর বছর ধরে এ ভাবেই জ্বলছে।
সেই নরকের দরজা চাক্ষুষ করতে প্রতি বছরই পর্যটকদের ভিড় জমে দরওয়াজা শহরে। পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণের এই ‘নরকের দরজা’। রাবণের চিতার মতো অহোরাত্র জ্বলতে থাকা এই আগুন নেবানোর জন্য এ বার উঠেপড়ে লেগেছে সে দেশের সরকার। বিশাল এই গহ্বরের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকটা সমর্থ হয়েছে বলেও দাবি করেছে তুর্কমেনিস্তানের বর্তমান সরকার।
বিজ্ঞানীদের মতে, প্রাকৃতিক দাহ্য গ্যাসের প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে গর্তের আগুনের শিখা ম্লান হতে শুরু করেছে। সরকারের দাবি, আগুন অতীতের তুলনায় তিন গুণ কমে যাওয়ায় শুধুমাত্র নিকটবর্তী এলাকায় তা দৃশ্যমান। তাই সে দেশের ভূতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই নরকের আগুন এ বার বোধহয় নিবতে চলেছে।
ইতিপূর্বে এই অগ্নিগহ্বরের বিশাল আভা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে দেখা যেত। সন্ধে নামলে অনেক দূর থেকেও এই আগুনের লেলিহান শিখা চোখে পড়ে। উপগ্রহচিত্রেও ধরা পড়েছিল সেই ছবি।
তুর্কমেনিস্তানের জ্বালানি সংস্থা ‘তুর্কমেঙ্গাজে’র প্রধান ইরিনা লুরিয়েভা চলতি সপ্তাহে একটি জীবাশ্ম জ্বালানি সম্মেলনে এই নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি জানান, আগে কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে আগুনের বিশাল আভা দেখা যেত। তাই এর নামকরণ করা হয়েছিল নরকের প্রবেশদ্বার। আজ কেবল সেই আগুনের একটি ক্ষীণ উৎস অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছে।
কী ভাবে পৃথিবীর বুকে এই ‘নরকের দরজা’র সৃষ্টি হল? ১৯৭১ সালে সাবেক সোভিয়েতের ভূতত্ত্ববিদেরা কারাকুম মরুভূমিতে তেলের খোঁজে খনন শুরু করেন। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ তুর্কমেনিস্তান। তাই খোঁড়াখুঁড়ি চালাতেই প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডার খুঁজে পান সন্ধানকারীরা।
এই খোঁড়াখুঁড়ির ফলে মাটি ধসে সেখানে তৈরি হয় বিশাল এক ক্রেটার বা গর্ত। আর সেই গহ্বর থেকে মিথেন গ্যাস বেরিয়ে আসতে শুরু করে। মিথেন অত্যন্ত ক্ষতিকর গ্যাস বলে পরিচিত। শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাসটি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। বায়ুদূষণ ঘটায় ও শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী বলে ধরা হয় এটিকে।
মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি টের পেয়ে সেখানে খননকাজ বন্ধ করে দেন তেল অনুসন্ধানকারীরা। সেই গ্যাসে পরিবেশ দূষিত হচ্ছিল। সেই গর্ত থেকে যাতে কোনও ভাবে বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে আসতে না পারে, সেই জন্য ওই গর্তে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
তাঁরা ভেবেছিলেন কয়েক দিন পরই হয়তো আগুন নিবে যাবে। তাদের ধারণা ছিল, এখানে সীমিত পরিমাণ গ্যাস থাকতে পারে। সেই অনুমান ভুল বলে প্রমাণিত হয়। ৭০-এর দশকে জ্বালানো আগুন আর নেবেনি। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই ভাবে জ্বলছে ‘নরকের দরজা’।
বি়জ্ঞানীদের অনুমান, এই গর্তটি সম্ভবত মিথেনের বিশাল ভূগর্ভস্থ ভান্ডারের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। সালফার, মিথেন-সহ বেশ কিছু গ্যাসের কারণেই এই আগুন। গর্তের মুখ থেকে সব সময়ই সালফারের গন্ধ নির্গত হয়। সেই অফুরন্ত গ্যাসের ভান্ডার গহ্বরের আগুনকে বছরের পর বছর ইন্ধন জুগিয়েছে।
স্থানীয় ভাষায় এই ক্রেটারকে বলা হয় ‘নরকের দ্বার’ (গেট অফ হেল)। জন ব্র্যাডলি নামে মার্কিন আলোকচিত্রীর কারণে এই জায়গার ছবি ছড়িয়ে পড়ে। নরকের দ্বার দেখতে পর্যটকদের প্রবল উত্সাহের কারণে প্রতি বছর সেখানে জড়ো হন অগণিত পর্যটক। ওই এলাকার আয়ের অন্যতম উত্সই এই ‘নরকের দ্বার’।
২০২২ সালেই ‘নরকের দরজা’ বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তুর্কমেনিস্তানের প্রেসিডেন্ট গুরবাঙ্গুলি বার্দিমুখামেদভ। তিনি জানিয়েছিলেন, একটি ভুলের জন্য পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। আশপাশের গ্রাম এবং মানুষের স্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাব পড়ছে।
তা ছাড়া তুর্কমেনিস্তান প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার করতে পারছে না বলেও মনে করেন তিনি। এই প্রাকৃতির সম্পদ থেকে দেশের অনেক লাভ হতে পারত। কিন্তু উল্টে প্রকৃতি এবং পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে বলেও মত প্রেসিডেন্টের। প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদন ও রফতানি বৃদ্ধি করতেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছিলেন তিনি।
অতিরিক্ত মিথেনকে ‘বন্দি’ করতে ওই এলাকায় অন্তত দু’টি নতুন কুয়ো খোঁড়া হয়েছে। মিথেন যাতে বাতাসে মিশে না যায়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তবে এই প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎসমুখ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ফাঁকা মরুভূমির মাঝে এই ‘দারভাজা গ্যাস ক্রেটার’ নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত নেই।