Johan de Witt

২০ বছর ক্ষমতায় থাকা রাষ্ট্রপ্রধানকে উলঙ্গ করে রাস্তায় নামিয়ে আনে উন্মত্ত জনতা, খুন করে দেহ খুবলে খায় ‘সভ্য’ ইউরোপীয়েরা!

বিশ্বাসঘাতকতা, দাঙ্গা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর উদাহরণ হল জোহানের করুণ কাহিনি। ডাচ ইতিহাসের একটি বিশেষ অন্ধকার অধ্যায়। রাস্তায় টেনে এনে রাষ্ট্রপ্রধানকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করতে হাত কাঁপেনি জনগণের।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:০৮
Share:
০১ ১৭

নৃশংসতম বললেও কম বলা হয়। দু’দশক ধরে দেশের শাসনব্যবস্থা ধরে রেখেছিলেন এক রাষ্ট্রপ্রধান। তাঁকেই এক লহমায় রাস্তায় টেনে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করতে হাত কাঁপেনি জনগণের। ইতিহাসে কথিত ভয়ঙ্কর এক হত্যাকাণ্ড। সপ্তদশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান ইউরোপীয় রাষ্ট্রনায়কের প্রকাশ্য হত্যা।

০২ ১৭

শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি বিদ্রোহীরা। ভয়ঙ্কর শাস্তির খাঁড়া নেমে এসেছিল প্রভাবশালী ডাচ রাষ্ট্রপ্রধান জোহান ডি উইট এবং তাঁর ভাই কর্নেলিসের উপর। একটি ভুয়ো খবরের স্ফুলিঙ্গ, তাতেই দাবানলের মতো ছডি়য়ে পড়েছিল গণরোষ। দুই ভাইকে একসঙ্গে মৃত্যুদণ্ড দেয় উন্মত্ত জনতা। সেই সময়ের কিছু সংবাদপত্রে এই শিহরন জাগানো ঘটনার ছবিসমেত বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল।

Advertisement
০৩ ১৭

বিভ্রান্তিকর প্রচার, রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং বিদ্রোহ রূপান্তরিত হয় হত্যাকাণ্ডে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের দেহ ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছে। তার পর সেই মৃতদেহের অংশ খুবলে খেয়ে নেয় উন্মত্ত জনতা! এমনটাই বলছে ইতিহাসের বেশ কিছু দলিল।

০৪ ১৭

১৬৫৩ থেকে ১৬৭২ সাল পর্যন্ত বর্তমান নেদারল্যান্ডসের (সাবেক হল্যান্ড) ‘কাউন্সিলর পেনশনারি’ বা রাজনৈতিক নেতা হিসাবে যিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন, তিনি জোহান। প্রথম এবং দ্বিতীয় অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধে (১৬৫২-৫৪ সাল ও ১৬৬৫-৬৭ সাল) সংযুক্ত প্রদেশগুলিকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ইতিহাসের পাতায় লেখা রয়েছে।

০৫ ১৭

ডাচদের নৌ-শক্তি ও বাণিজ্যকে সুসংহত করার ক্ষেত্রেও জোহানের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। নেদারল্যান্ডস-সহ ইউরোপ বসবাসের জন্য একসময় সহজ জায়গা ছিল না। যুদ্ধ, সংঘাত এবং হত্যাকাণ্ড ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ভূ-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় বিধ্বস্ত ছিল মহাদেশের বিস্তীর্ণ অংশ। সেই অস্থিরতার আঁচ ছড়িয়ে পড়েছিল ডাচদের মধ্যেও।

০৬ ১৭

বিশ্বাসঘাতকতা, দাঙ্গা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের ভয়ঙ্কর উদাহরণ হল জোহানের করুণ কাহিনি। এটি ডাচ ইতিহাসের একটি বিশেষ অন্ধকার অধ্যায়। বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়লে তার ফলাফল কতটা নৃশংস হতে পারে তার ভয়াবহ উদাহরণ ১৬৭২ সালে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক জনবিক্ষোভ।

০৭ ১৭

জোহান এবং কর্নেলিস ডি উইটের উপর আক্রমণের সূত্রপাত ঘটে অবিরাম বিদ্বেষপূর্ণ এবং ভুয়ো প্রচারের মাধ্যমে। যেখানে দাবি করা হয়েছিল যে, উইট ভ্রাতৃদ্বয় দুর্নীতিগ্রস্ত, অনৈতিক এবং ডাচ প্রজাতন্ত্রের (বর্তমান নেদারল্যান্ডস) শত্রুদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সেই সময় জোহান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তিনি সমগ্র ইউরোপের একমাত্র নেতা, যিনি রাজবংশের প্রতিনিধি ছিলেন না।

০৮ ১৭

১৬২৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নেদারল্যান্ডসের ডর্ড্রেখ্‌টে জন্ম হয় জোহানের। তাঁর বাবা জ্যাকব ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন স্টেটস পার্টির সমর্থক। এই দলটি সাবেক হল্যান্ডের হাউস অফ অরেঞ্জের প্রতিনিধি রাজপুত্রদের বিরোধিতা করার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। মধ্যযুগীয় কাল থেকেই ডি উইটস পরিবার ডর্ড্রেখ্ট শহর শাসন করে আসছে। রাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী পরিবারটি তৎকালীন হল্যান্ড জুড়ে উচ্চ রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিল।

০৯ ১৭

১৬৫০ সালে জোহানকে ডর্ড্রেখ্‌টের ‘কাউন্সিলর পেনশনারি’ নিযুক্ত করা হয়। এই পদের বলে তিনি হল্যান্ডের নেতা বলে পরিচিত হন। সেই বছর হল্যান্ডের রাজ্যগুলি প্রাদেশিক আধিপত্যের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিল। অরেঞ্জের তরুণ রাজপুত্র দ্বিতীয় উইলিয়াম স্টেটস জেনারেল এবং সেনাবাহিনীর সহায়তায় জোহানের বাবা জ্যাকব-সহ স্টেটস দলের পাঁচ নেতাকে আটক করে কারারুদ্ধ করেন।

১০ ১৭

১৬৫০ সালে অরেঞ্জের রাজপুত্র দ্বিতীয় উইলিয়াম মারা যান। সেই বছরই জোহান হল্যান্ড এবং পশ্চিম ফ্রিজ়ল্যান্ড রাজ্যের ডর্ড্রেখ্‌টের প্রতিনিধিদলের নেতার পদ লাভ করেন। জোহান গণিত এবং আইনশাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন। জোহানের ভাই কর্নেলিস ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ নৌসেনা আধিকারিক ও ডর্ড্রেখ্‌টের গভর্নর।

১১ ১৭

ক্ষমতার আসনে বসেই জোহান বুঝতে পেরেছিলেন যে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুদ্ধে আখেরে ক্ষতি হচ্ছে ডাচদেরই। দেশটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছে। তাই তিনি শান্তিপ্রতিষ্ঠার সংকল্প নেন। অলিভার ক্রমওয়েলের ইংল্যান্ড এবং হল্যান্ডের মিলনের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করেন জোহান। ১৬৫৪ সালে ‘ওয়েস্টমিনস্টার চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে একটি বিশেষ নিবন্ধ অন্তর্ভুক্ত ছিল। জোহান সেই শর্ত হল্যান্ডের রাজ্যগুলিকে মেনে নিতে রাজি করান।

১২ ১৭

তিনি দেশের আর্থিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করেন এবং ইস্ট ইন্ডিজ়ে ডাচদের বাণিজ্যিক আধিপত্য বিস্তার করার পথ সুগম করেন। এতে অনেক ডাচ নাগরিক অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন, বিশেষ করে যাঁরা জোহানকে অপছন্দ করতেন। হাউস অফ অরেঞ্জ বলতে তৎকালীন হল্যান্ডের রাজপরিবারকে বোঝানো হত। সেই রাজবংশের উত্তরাধিকারী উইলিয়াম তৃতীয়কে ক্ষমতায় দেখতে চেয়েছিলেন ডাচ নাগরিকদের একাংশ। বর্তমান নেদারল্যান্ডসের রাজতন্ত্র এই পরিবারেরই অংশ। অন্য দিকে, জোহান শক্তিশালী এবং ধনী বণিক শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন।

১৩ ১৭

দ্বিতীয় চার্লস যখন ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন তখন জোহান হাউস অফ অরেঞ্জের রাজপুত্রকে স্ট্যাডথোল্ডার বা ক্যাপ্টেন জেনারেল নিযুক্ত করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃত হন। এর ফলে ইংরেজ ও ডাচ সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ১৬৬৫ সালে যুদ্ধ শুরু হয়। ১৬৬৭ সালের জুনে অ্যাডমিরাল মিশিয়েল ডি রুইটারের সাফল্যের ফলে ইংরেজ নৌবহরের বেশির ভাগ অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সঙ্গে জোহানের কূটনৈতিক দক্ষতা ডাচদের স্থিতিশীল অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছিল।

১৪ ১৭

১৬৭২ সালের জুন মাসে জোহানকে হত্যার চেষ্টায় আক্রমণ করা হয়। তাঁকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এর দু’মাস পর তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এর পর জোহানের ভাই কর্নেলিসকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। জোহান যখন কারাগারে তাঁকে দেখতে যান, তখন রক্ষী এবং সৈন্যরা আচমকাই অদৃশ্য হয়ে যায়।

১৫ ১৭

বিক্ষুব্ধ জনতা সেই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। বিশাল গণ অভ্যুত্থান ঘটে সেখানে। জনগণ বাইরে জড়ো হয় এবং কারাগারের ভিতরে ঢুকে পড়ে। বাকিটা ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় বলেই চিহ্নিত রয়েছে। দুই ভাইকে একসঙ্গে গুলি করে মারা হয় প্রকাশ্য জনসভায়। উলঙ্গ করে জনতার মাঝে ‘বিচারের জন্য’ ফেলে দেওয়া হয় দুই ভাইকে।

১৬ ১৭

দ্বিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে জনতা তাঁদের দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উলঙ্গ করে দেয়। এর পর তাঁদের দেহ বিকৃত করে। তাঁদের হৃৎপিণ্ড ও লিভার টেনে বার করে খেয়ে ফেলে বলেও বহু প্রতিবেদনে দাবি উঠেছিল। জনতা তাঁদের উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখে। তাঁদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরিয়ে ফেলে। আঙুল এবং জিভ স্মারক হিসাবে বিক্রি হয়েছিল বলেও দাবি।

১৭ ১৭

তৃতীয় উইলিয়ামকে ডিউইট ভাইদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য পরিকল্পনাকারী হিসাবে সন্দেহ করা হয়েছিল। যদিও সেই দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কৌতূহলী দর্শনার্থীরা এখনও সেই কারাগারে যেতে পারেন, যেখানে ডিউইট ভাইদের নির্যাতন করা হয়েছিল। এখন এর নাম গেভানজ়েনপোর্ট। অনতিদূরেই রয়েছে জোহান ডি উইটের একটি স্মারক মূর্তি। সেখানেই দুই ভাইকে হত্যা করেছিল উন্মত্ত জনতা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement