Codex Gigas

আত্মা ‘বন্ধক’ নিয়ে বাইবেল রচনায় সাহায্য করেন খোদ শয়তান! সত্যিই কি দুর্ভাগ্য ডেকে আনে ৭৫ কেজির পাণ্ডুলিপি?

জনশ্রুতি, শয়তানের সাহায্য নিয়ে রচনা করা হয়েছিল এই বাইবেলটি। এমন কথাও শোনা যায়, বিশেষ এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে মোহাবিষ্ট ছিলেন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট দ্বিতীয় রুডল্‌ফ।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৫ ১৬:৪৭
Share:
০১ ১৮

বাইবেল— খ্রিস্ট ধর্মের ধর্মগ্রন্থ। শয়তান বা দুষ্ট আত্মার আধিপত্য দূর করতে রক্ষাকবচের কাজ করে এই পবিত্র গ্রন্থ, এমনটাই বিশ্বাস করেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা। তাঁদের মতে, এই গ্রন্থ সঙ্গে থাকলে কোনও অশুভ শক্তির পক্ষে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হয় না।

০২ ১৮

তবে এমনও বাইবেল আছে, যা শয়তানের হাত থেকে রক্ষা করে না, বরং তা খোদ শয়তানেরই! সে গ্রন্থ রচনার নেপথ্যে রয়েছে অদ্ভুত কাহিনি। এই পাণ্ডুলিপির লিপিকার বেনেডিক্টাইন সম্প্রদায়ের হারমান দ্য রিক্লুজ় নামে এক সন্ন্যাসী। ব্রতভঙ্গের অপরাধে তাঁকে জীবন্ত অবস্থায় দেওয়ালে গেঁথে দেওয়ার শাস্তি ধার্য করা হয়। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে নিস্তার পেতে হারমান কথা দেন যে, মঠের উন্নতির জন্য এক বছরের মধ্যে তিনি একটি বৃহদাকার পাণ্ডুলিপি রচনা করবেন। মঠাধ্যক্ষ এতে রাজি হন।

Advertisement
০৩ ১৮

প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে মাসের পর মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন হারমান। কিন্তু যে কাজ শেষ হতে দশকের পর দশক লেগে যাওয়ার কথা, তা এত অল্প সময়ে শেষ করা অসম্ভব ছিল। যে দিন পাণ্ডুলিপি রচনা শেষ করে মঠাধ্যক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার কথা, তার আগের রাতে নাকি শয়তানের শরণাপন্ন হন নিরুপায় সেই সন্ন্যাসী।

০৪ ১৮

পাণ্ডুলিপিটি রচনা করতে সাহায্য করেন শয়তান। সেই রাতেই কাজ সম্পন্ন হয়। সময়ে কাজ শেষ করতে পারায় হারমানের শাস্তি মকুব হয় এবং তিনি মুক্তি পান। কিন্তু এই ‘উপকারের’ পরিবর্তে শয়তানের কাছে আত্মা বন্ধক রাখতে নাকি বাধ্য হন সন্ন্যাসী।

০৫ ১৮

আবার কেউ কেউ বলেন, এক বছরও নয়, শাস্তিস্বরূপ বৃহদাকার পাণ্ডুলিপিটি রচনার জন্য সময় দেওয়া হয় মাত্র এক দিন। উপায়ান্তর না দেখে মধ্যরাতে শয়তানের দ্বারস্থ হন হারমান। এ ভাবেই অসম্ভব এই কাজটি রাতারাতি সম্পন্ন হয়। আবার এমন গল্পও প্রচলিত রয়েছে যে, আর কেউ নয়, এ পাণ্ডুলিপির রচয়িতা স্বয়ং শয়তান।

০৬ ১৮

শয়তানের পূর্ণাঙ্গ প্রতিকৃতির স্থান হয় এই পাণ্ডুলিপিটিতে। এই বিশালাকার পাণ্ডুলিপিটির ‘ডেভিল’স বাইবেল’ নামকরণের নেপথ্য কারণ হিসাবে প্রচলিত রয়েছে এমন নানা কাহিনি। তবে, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত ‘স্যাটানিক বাইবেল’-এর সঙ্গে এ গ্রন্থের কোনও যোগ নেই।

০৭ ১৮

বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং নিউ টেস্টামেন্ট ছাড়াও নানা রকম লেখায় সমৃদ্ধ এই সুবৃহৎ পাণ্ডুলিপি। এর মধ্যে যেমন রয়েছে ঐতিহাসিক উপাখ্যান, চিকিৎসা বিষয়ক রচনা, তেমনই রয়েছে জাদুমন্ত্র। শোনা যায়, কিছু গুপ্ত জ্ঞান, ভূতপ্রেত বিতাড়নের উপায় এবং কালোজাদুর সঙ্গেও জড়িত আছে এই পাণ্ডুলিপি।

০৮ ১৮

কেউ কেউ এ-ও বিশ্বাস করেন যে, পাণ্ডুলিপিটি একটি অভিশাপ বহন করে। এটি যাঁদের কাছেই ছিল, তাঁদের প্রত্যেকের জীবনে কোনও না কোনও দুর্ভাগ্যের কাহিনি রয়েছে। এ কথা ঠিক যে, শয়তানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়টির কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। তবে এই মিথটিই বইটিতে বাড়তি রহস্য যোগ করেছে।

০৯ ১৮

এ ছাড়াও এই গ্রন্থকে নিয়ে যে সব গল্পকথা প্রচলিত, সে আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছিলেন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট দ্বিতীয় রুডল্‌ফ। গুপ্ত জ্ঞান বিষয়ে প্রভূত আগ্রহ ছিল তাঁর। তিনি এই পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে মোহগ্রস্ত ছিলেন বলা যায়, মনে করতেন এটি কোনও শক্তির উৎস। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল এই বইটি।

১০ ১৮

‘শয়তানের বাইবেল’ বলে পরিচিত পাণ্ডুলিপিটির প্রকৃত নাম ‘কোডেক্স গিগাস’। ‘কোডেক্স গিগাস’ একটি লাটিন শব্দবন্ধ। ‘কোডেক্স’ শব্দের অর্থ বই বা পাণ্ডুলিপি, এবং ‘গিগাস’ শব্দের অর্থ ‘দানব’। ‘কোডেক্স গিগাস’ বলতে দৈত্যাকার বই বা পাণ্ডুলিপিকে বোঝায়। এই বইটির দৈর্ঘ্য তিন ফুট, প্রস্থ ২০ ইঞ্চি এবং বেধ ৯ ইঞ্চি। ওজনে ৭৫ কেজির কাছাকাছি। সার্থকনামা গ্রন্থটি তুলে ধরতে দুই বা তার অধিক মানুষের প্রয়োজন হয়।

১১ ১৮

ত্রয়োদশ শতকের প্রথমার্ধে বোহেমিয়ার (বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্র) ক্রাস্টের কাছে অবস্থিত বেনেডিক্টাইন মঠে এই পাণ্ডুলিপিটি রচিত হয়। ১৬৪৮ সালে ‘ত্রিশ বছরের যুদ্ধ’-এর শেষে সুইডেনের ইম্পেরিয়াল সেনা লুট করে এই ‘সম্পদ’। ১৬৪৯ সাল থেকে পাণ্ডুলিপিটি স্টকহলোমের সুইডিশ রয়্যাল লাইব্রেরিতেই রয়েছে। ১৬৯৭ সালের ৭ মে, স্টকহলোমের ‘ট্রে ক্রোনার’ নামক রাজকীয় দুর্গে অগ্নিকাণ্ডের ফলে এই লাইব্রেরির বেশির ভাগ অংশ পুড়ে যায়। ‘কোডেক্স গিগাস’টিকে রক্ষা করার জন্য জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলা হয়। ভিকার ইয়োহান এরিখসন্‌স নামে এক লুথারীয় পণ্ডিত জানান, পাণ্ডুলিপিটির আঘাতে একজন পথচারী আহত হন।

১২ ১৮

লাটিন লিপিতে রচিত বাইবেলটির দ্বিতীয়ার্ধে বেশ কিছু জাগতিক বিষয়ও রয়েছে। মধ্যযুগীয় বিখ্যাত রচনা সেগুলি। এর মধ্যে রয়েছে ফ্লেভিয়াস জোসিফাসের ‘অ্যান্টিকুইটিস অফ দ্য জিউজ়’ এবং ‘দ্য জুইশ ওয়ার’, ইজ়িডোর অফ সেভিলের ‘ইটিমোলোজিয়াই’ নামক বিশ্বকোষ এবং ‘ক্রোনিকা বোমোরুম’, ‘আর্স মেডিসিনাই’ নামক একটি চিকিৎসা বিষয়ক সঙ্কলন গ্রন্থের প্রথম দিককার সংস্করণ এবং কনস্টান্টাইন দ্য আফ্রিকানের দু’টি বই।

১৩ ১৮

পাণ্ডুলিপিটিতে থাকা শয়তানের পাতাজোড়া প্রতিকৃতিটি লম্বায় ২০ ইঞ্চি। যে পাতায় শয়তানকে আঁকা হয়েছে, তার ঠিক পাশের পাতা জুড়ে রয়েছে আলোকোজ্জ্বল স্বর্গরাজ্যের ছবি। শুভ এবং অশুভের পরস্পরবিরোধিতা ফুটিয়ে তুলতেই ছবি দু’টিকে পাশাপাশি পাতায় রাখা হয়েছে বলে মনে করা হয়।

১৪ ১৮

ছবিটি এমন ভাবে আঁকা, যাতে মনে হচ্ছে শয়তান সোজাসুজি তাকিয়ে রয়েছেন পাঠকের দিকে। তাঁর পরনে সাদা অধোবাস, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। অধোবাসে যতিচিহ্নের (কমা) মতো ছোট ছোট লাল রঙের আঁচড়। ছবিতে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শয়তান। তাঁর শারীরিক আকার, হাত-পায়ের গড়ন যদিও স্বাভাবিক মানুষের মতো। কেবলমাত্র হাত এবং পায়ে পাঁচটির বদলে চারটি করে আঙুল রয়েছে। বাঁকানো, লম্বা নখগুলির রং রক্তের মতো লাল।

১৫ ১৮

ঘন, সোনালি চুলগুলি যেন খুলির উপরের টুপি। বাঁকানো শিং দু’টি আগুনে কমলারঙা। মুখমণ্ডল গাঢ় সবুজ। একই রঙের কুলোর মতো কান দু’টির ধার বরাবর টানা হয়েছে লাল রং। বড় বড় দু’চোখের মণি টকটকে লাল। রক্তিম ঠোঁট এবং ইঁদুরের মতো দাঁতগুলির ফাঁক দিয়ে দু’ভাগে বেরিয়ে আছে লালরঙা লকলকে জিভ। প্রাচীন বাইবেলে রূপক হিসাবে এমন দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া সাপের কাঁটাওয়ালা জিভের বর্ণনা রয়েছে। খ্রিস্টীয় মূর্তিবিদ্যা এবং দানববিদ্যায় শয়তানের উপর যে সব রূপ আরোপ করা হয়েছে, তার মধ্যে এটি একটি।

১৬ ১৮

অনুমান করা হয় যে, তিনশোরও বেশি পাতার এই পাণ্ডুলিপিটি তৈরি করতে প্রায় ১৬০টি প্রাণীর চামড়া প্রয়োজন হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ছাগল, বাছুর, গাধা এই তিনটি প্রাণীর কোনও একটির চামড়া দিয়ে অথবা এই তিনটি প্রাণীর চামড়া মিলিয়েই পাণ্ডুলিপিটি তৈরি হয়েছে।

১৭ ১৮

পাণ্ডুলিপিটিতে ৩২০ থেকে ৩২২টি পৃষ্ঠা ছিল বলে ধারণা। তবে এখন ৩১০টি পাতা পাওয়া যায়। ইতিহাসবিদদের মতে, কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যেই পাতাগুলো বাঁধাই থেকে কেটে নেওয়া হয়। জল্পনা, হারিয়ে যাওয়া পাতাগুলিতে হয়তো মঠের নিয়মকানুনের উল্লেখ ছিল। কারও আবার বিশ্বাস, ওই পৃষ্ঠাগুলোয় লেখা ছিল কোনও অত্যন্ত গোপন, বিপজ্জনক বিষয়।

১৮ ১৮

নানা জনশ্রুতির পাশাপাশি পাণ্ডুলিপির ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। মধ্যযুগের এই রচনাটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছবি সংবলিত বাইবেল। পাণ্ডুলিপিটির আকার দেখে বলা হয় এটি লিপিবদ্ধ করতে অন্ততপক্ষে বছর ২০ সময় লাগার কথা। পণ্ডিতদের বিশ্লেষণ, লিপিকার ছিলেন এক জন ব্যক্তিই। ত্রয়োদশ শতকে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩০-৩৫ বছর। সে দিক থেকে বলা যায়, পাণ্ডুলিপি রচনায় প্রায় সারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন হারমান। এমন বিস্তৃত কাজের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় রাখার বিষয়টিও বিস্ময়কর।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement