দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯–১৯৪৫) বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্তৃত ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে সংঘর্ষ চলেছিল। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে নানা ধরনের আবহাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। কোথাও তীব্র ঠান্ডা, কোথাও মরুভূমি, কোথাও গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক দিকে ছিল অক্ষশক্তি, অন্য দিকে মিত্রশক্তি। অক্ষশক্তির মধ্যে ছিল জার্মানি, ইতালি এবং জাপান। অন্য দিকে মিত্রশক্তিতে প্রধান যে দেশগুলি ছিল সেগুলি হল ব্রিটেন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চিন। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে পরাজিত হয় অক্ষশক্তির দেশগুলি।
মিত্রশক্তি যুদ্ধে জিতলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল বিপুল। অন্য দেশের তুলনায় কম হলেও ক্ষতি হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও। আবহাওয়া পরিবর্তন কোনও যুদ্ধে যে কত বড় সমস্যার কারণ হতে পারে তা মার্কিন প্রশাসন ভাল ভাবে টের পেয়েছিল। যুদ্ধের সময় তাদের জাহাজে বরফ জমে যেত। অস্ত্র এবং রাডার অকেজো হয়ে পড়ত। পাশাপাশি ইঞ্জিন, জ্বালানি ঠান্ডায় জমে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হয় মার্কিন সেনাবাহিনী। যথাযথ শীতবস্ত্র না পাওয়ায় ফ্রস্টবাইটের মতো অসুস্থতায় ভুগতে হয় বেশ কিছু সেনাকে। টহলদারির সময় উত্তর আটলান্টিকে মার্কিন ও ব্রিটিশ জাহাজ বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ঠান্ডার কারণে। যদিও এত সমস্যার সম্মুখীন হয়েও শেষ পর্যন্ত জিতেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রশক্তি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বুঝেছিল যে, শীতপ্রধান এলাকায় তাদের নৌবাহিনীকে আরও শক্তিশালী হতে হবে। সে কারণে মার্কিন সামরিক কৌশল ও প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করতে আন্টার্কটিকায় সামরিক ও বৈজ্ঞানিক অভিযান শুরু করা হয়েছিল। এই অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন হাইজাম্প’। ১৯৪৬-এ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্যোগে মূলত শুরু হয় এই অভিযান। যদিও অভিযান শেষ হয় সময়ের আগেই। হঠাৎ ১৯৪৭-এ বন্ধ করে দেওয়া হয় এই অভিযান। তবে কি শুধু আন্টার্কটিকার পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর উদ্দেশ্যেই এই অভিযান ছিল? না কি অন্য কারণও ছিল? এই নিয়ে রয়েছে নানা ধোঁয়াশা।
‘অপারেশন হাইজাম্প’ শুরু হয় ১৩টি জাহাজ, ২৩টি বিমান এবং প্রায় ৪,৭০০ সেনা ও গবেষক নিয়ে। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল রিচার্ড ই বার্ড এবং রিয়াল অ্যাডমিরাল রিচার্ড এইচ ক্রুজ়েন। অভিযানের আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয় ‘দ্য ইউনাইটেড স্টেটস নেভি আন্টার্কটিক ডেভেলপমেন্টস প্রোগ্রাম, ১৯৪৬-১৯৪৭’। যদিও এই অভিযান ‘টাস্ক ফোর্স ৬৮’ নামেও পরিচিত। বেশ কিছু গবেষণায় এই অভিযান আন্টার্কটিকায় সবচেয়ে বড় সামরিক অভিযান হিসাবে দাবি করা হয়েছে।
‘অপারেশন হাইজাম্প’ অভিযানের মধ্যে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী একটি গবেষণাঘাঁটি তৈরি করে, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘লিটল আমেরিকা ৪’। আন্টার্কটিকার দক্ষিণ অংশে রস আইস শেল্ফে তৈরি করা হয় এটি। ‘লিটল আমেরিকা ৪’ তৈরির মাধ্যমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্টার্কটিক মহাদেশে বৈজ্ঞানিক ও সামরিক কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করে।
‘অপারেশন হাইজাম্প’-এ নৌবাহিনীর তিনটি প্রধান দল কাজ করেছিল— ইস্টার্ন গ্রুপ, ওয়েস্টার্ন গ্রুপ এবং সেন্ট্রাল গ্রুপ। এদের মোট ১৩টি জাহাজ এই অভিযানে কাজ করেছিল। এর মধ্যে নৌবাহিনীর অভিযানে কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার হিসাবে কাজ করেছিল ইউএসএস মাউন্ট অলিম্পাস। এটি সেন্ট্রাল গ্রুপের জাহাজ ছিল।
১৯৪৬-র ১২ ডিসেম্বর ওয়েস্টার্ন গ্রুপের জাহাজগুলি মার্কেসাস দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছোয়। সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস হেন্ডারসন এবং তেলবাহী জাহাজ ইউএসএস ক্যাকাপন প্রথমে একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ স্টেশন স্থাপন করে। ইউএসএস কারিটাক নামক আরও একটি জাহাজ আন্টার্কটিকার উপকূলীয় অঞ্চলে বিমান পরিচালনার গবেষণায় সাহায্য করেছিল।
এই অভিযানে মূল উদ্দেশ্য ছিল নৌ ও বিমানবাহিনীকে শীতকালীন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া। এ ছাড়াও বৈজ্ঞানিক গবেষণা, আবহাওয়ার পর্যালোচনা এবং সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া। মূলত শীতল অঞ্চলে টিকে থাকার পরীক্ষা করার জন্যই এই অভিযান চালানো হয়।
‘অপারেশন হাইজাম্প’ চলাকালীন আন্টার্কটিকার ভৌগোলিক পর্যালোচনার জন্য বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন গবেষকেরা। যেখানে প্রায় ১৫ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা মানচিত্রে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়াও অনেক অজানা উপকূলরেখা ও বরফঢাকা অঞ্চল প্রথম বারের মতো নথিভুক্ত হয় এই অভিযানের মধ্যে দিয়ে।
ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন দিক নিয়েও গবেষণা করা হয়। তার মধ্যে আন্টার্কটিকার মাটির গঠন, শিলা, খনিজ, তুষার ও বরফের স্তর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। এর ফলে বরফের ওপর কী ভাবে গবেষণাঘাঁটি তৈরি করা যায়, কী ভাবে যোগাযোগ রাখা যায়, তা নিয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন সেনারা।
যে হেতু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবহাওয়া সবচেয়ে নেতিবাচক কারণ ছিল, তাই সেনারা এই অভিযানের মধ্যে দিয়ে আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে বিশেষ গবেষণা করেন। আন্টার্কটিকার চরম ঠান্ডা, ঝোড়ো হাওয়া ও আবহাওয়ার ধরন নিয়ে গবেষণা করেন।
আন্টার্কটিক অঞ্চলে রেডিয়ো যোগাযোগ কেমন কাজ করে, কোন কোন জায়গায় সমস্যা হয়, সে সব বিষয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছিল এই অভিযানে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সেনাদের সঙ্গে কী ভাবে যোগাযোগ রাখা যাবে, আদৌ সেখানে কোনও যোগাযোগ ব্যবস্থা কাজ করবে কি না, করলেও কী ভাবে— সেই দিকগুলি নিয়েও গবেষণা চালান সেনারা। গবেষণায় রাডার ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ ও বিমানগুলি বিকল হয়ে যায় ঠান্ডার কারণে। তাই এই অভিযানের শুরুতেই ঠান্ডা পরিবেশে বিমান, হেলিকপ্টার, জাহাজ ও যানবাহন কেমন কাজ করে তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এর ফলে অনেক যন্ত্র বিকল হয়ে পড়লেও তা কী ভাবে পুনরায় ব্যবহার করা যায় তার কারণও খুঁজে পান গবেষকেরা।
বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে দক্ষিণ মহাসাগরের বিভিন্ন জায়গার গভীরতা মাপা হয়েছিল, যার ফলে আন্টার্কটিকার চারপাশের সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়। সমুদ্রে ভাসমান বরফের চাঁই কী ভাবে তৈরি হয়, ভাঙে এবং স্রোতের সঙ্গে কোথায় যায়, তা পর্যবেক্ষণ করা হয়। এর দ্বারা জাহাজ চলাচলের ঝুঁকি সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন গবেষকেরা। এ ছাড়া কয়লার বড় ভান্ডারও গবেষকেরা খুঁজে পেয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়।
দক্ষিণ মেরুর উপকূলে জোয়ার-ভাটার প্রকৃতি এবং সমুদ্রতরঙ্গ কেমন হয় তা নিয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। কোন কোন অঞ্চল জাহাজ চলাচলের জন্য বিপজ্জনক তার মানচিত্র তৈরি হয় ‘অপারেশন হাইজাম্প’-এর মধ্যে দিয়ে। বিভিন্ন স্তরের সমুদ্রজল কতটা লবণাক্ত এবং তাপমাত্রার তারতম্য কেমন, তা মাপা হয়েছিল এই গবেষণায়। বরফ গলে যাওয়া এবং নতুন বরফ তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া সম্বন্ধেও জানা যায়।
এই অভিযানে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। গবেষণা চলাকালীন থার্স্টন আইল্যান্ডে বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৪৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঘটনাটি ঘটে। ইউএসএস কারিটাক থেকে তিনটি মার্টিন পিবিএম-৫ সমুদ্রবিমান পাঠানো হয়। এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘জর্জ ১’। বিমান থেকে মার্কিন নৌবাহিনী আন্টার্কটিকার বিভিন্ন জায়গা জরিপ করছিল সে দিন। সেই সময় প্রবল তুষারঝড় এবং ঘন কুয়াশায় দৃশ্যমানতা হারাতে থাকে সেনারা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তিন জন সেনার। ছ’জন আহত হন।
এই দুর্ঘটনার পর আরও একটি মৃত্যু হয়। ১৯৪৭ সালের ২১ জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট ভ্যান্স এন উডালের মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর সঠিক কারণ স্পষ্ট করেনি মার্কিন সেনা। লেফটেন্যান্ট ভ্যান্স মার্কিন নৌবাহিনীর অফিসার ছিলেন। খারাপ আবহাওয়ার কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে শোনা যায়।
উদ্দেশ্যে একাধিক হলেও হঠাৎ করেই থমকে যায় ‘অপারেশন হাইজাম্প’। ১৯৪৬-এর ২৬ অগস্ট আনুষ্ঠানিক ভাবে এই অভিযানের সূচনা হলেও কাজ শুরু হতে হতে ওই বছরের ডিসেম্বর হয়ে যায়। কিন্তু খারাপ আবহাওয়া, পর পর দু’টি দুর্ঘটনার কারণেই নাকি বেশি দিন চলেনি অভিযানটি। মাত্র দু’মাসেই শেষ হয়ে যায়। বিভিন্ন রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয় ‘অপারেশন হাইজাম্প’।
যদিও ‘অপারেশন হাইজাম্প’ ঘিরে রয়েছে বহু জল্পনা। অনেকেই মনে করেন, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। প্রকাশ্যে আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণার কথা বললেও আসলে আন্টার্কটিকার মতো জায়গায় ঘাঁটি তৈরি করতেই এই অভিযান চালানো হয়। কেউ কেউ বলেন সরকারের কোনও গোপন পরিকল্পনা চাপা দেওয়ার জন্যই ছিল এই অভিযান। আবার, এটি নাৎসিদের গোপন ঘাঁটি খুঁজে বার করার অভিযান বলেও দাবি করেন অনেকে। ‘আইস ওয়্যাল’ খুঁজে বার করার কারণেও ‘অপারেশন হাইজাম্প’ হতে পারে বলে বিশ্বাস একদল ষড়যন্ত্রতত্ত্ববিদের।
কিন্তু ‘অপারেশন হাইজাম্প’-ই নাম কেন? মূলত এটি মার্কিন নৌসেনার ব্যবহৃত সাঙ্কেতিক নাম ছিল। সে সময় মার্কিন নৌবাহিনীতে ‘হাইজাম্প’, ‘ডিপফ্রিজ়’-এর মতো আরও একাধিক সাঙ্কেতিক নাম ব্যবহার করা হত বিভিন্ন অভিযানের ক্ষেত্রে। তবে অনেকে মনে করেন, নামটি ইঙ্গিত করেছিল কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ একটি অভিযানের দিকে। আন্টার্কটিকার কঠিন পরিবেশে প্রবেশ করাটাকেই একধরনের ‘হাইজাম্প’ হিসাবে দেখা যেতে পারে। সে কারণেই এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন হাইজাম্প’।