Ukraine Attack on Crimea Bridge

‘মারিচকা’র মারে কেঁপে উঠল ক্রাইমিয়ার কের্চ! পুতিনের ডলফিন বাহিনীকে খুন করেই কি হামলা জ়েলেনস্কি ফৌজের?

ডুবোড্রোনে হাজার কেজি বিস্ফোরকের সাহায্যে ক্রাইমিয়ার কের্চ সেতু উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে রাশিয়ার বুকে মোক্ষম ঘা দিয়েছে ইউক্রেন। কেন আঁটসাঁট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বার বার ব্যর্থ হচ্ছে মস্কো? প্রেসিডেন্ট পুতিনের ‘গুপ্তচর’ ডলফিনেরা কেন ধরতে পারল না কিভের ফন্দি?

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫ ১৬:১১
Share:
০১ ১৯

এ যেন বজ্র আঁটুনি, ফস্কা গেরো! ফের ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা’র চাদর কেটে রাশিয়ার বুকে মোক্ষম ঘা বসাল ইউক্রেন। এ বার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের গর্বের কের্চ সেতুকে নিশানা করেছে কিভ। আত্মঘাতী ডুবোড্রোনে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওই সেতু উড়িয়ে দেওয়ার ছক ছিল তাদের। যদিও তাতে চূড়ান্ত সাফল্য পায়নি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির বাহিনী। কিন্তু, ইউক্রেনের এই আক্রমণের পর প্রশ্নের মুখে পড়েছে ক্রেমলিনের যাবতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

০২ ১৯

ক্রাইমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী কের্চ সেতুর কৌশলগত গুরুত্ব অপরিসীম। যোগাযোগের একমাত্র রাস্তাটি ধসে পড়লে যুদ্ধের গতি যে রাতারাতি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে, তা ভালই জানেন রুশ কমান্ডারেরা। তাই এর নিরাপত্তায় কোনও খামতি রাখেনি মস্কো। তা সত্ত্বেও কী ভাবে সেতুটিকে নিশানা করতে সক্ষম হল ইউক্রেনীয় সেনা? বর্তমানে হন্যে হয়ে তার জবাব খুঁজছেন ক্রেমলিনের গোয়েন্দা ও গুপ্তচরেরা।

Advertisement
০৩ ১৯

কের্চের নিরাপত্তায় ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’-এর মতো ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্সকে ওই এলাকায় মোতায়েন রেখেছে রাশিয়া। ফলে সেতুটির উপরিভাগকে একরকম দুর্ভেদ্য বর্মে ঢেকে ফেলতে সক্ষম হয়েছে মস্কো। ইউক্রেনের পক্ষে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে সেতুটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা ছিল অলীক কল্পনা। সেই কারণেই ওই রাস্তায় হাঁটেনি কিভের গুপ্তচর সংস্থা ‘সিকিউরিটি সার্ভিস অফ ইউক্রেন’ বা এসবিইউ।

০৪ ১৯

এ ছাড়া, ক্রাইমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী একমাত্র সেতুটির নিরাপত্তায় কৃষ্ণসাগরে রাত-দিন টহল দিয়ে থাকে রাশিয়ার একগুচ্ছ রণতরী ও ডুবোজাহাজ। জলের নীচে আক্রমণ ঠেকানোর জন্য রয়েছে বিশেষ সোনার সিস্টেম। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিপদ এড়াতে পারল না মস্কো। কের্চ সেতুর মূল স্তম্ভের কাছে আত্মঘাতী ডুবোড্রোন দিয়ে হামলা চালাতে সক্ষম হয় ইউক্রেন। এর জন্য ১,১০০ কেজি বিস্ফোরক ব্যবহার করে কিভ।

০৫ ১৯

বিশ্লেষকদের দাবি, রাশিয়ার এ হেন পুরু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার নেপথ্যে রয়েছে ‘মারিচকা’র হাতযশ। এটি প্রকৃতপক্ষ জলের নীচে চলাচলকারী মানববিহীন যান বা ইউইউভি (আনম্যানড আন্ডারওয়াটার ভেহিকল)। প্রযুক্তিগত কারণেই একে ঠেকানোর ক্ষমতা রুশ রণতরী বা ডুবোজাহাজগুলির ছিল না। ফলে চুপিসারে সেতুর নীচে পৌঁছে বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম হয় জ়েলেনস্কির ‘মারিচকা’।

০৬ ১৯

ছ’মিটার লম্বা কালো রঙের জলের নীচের এই ড্রোনটিকে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করেছেন ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। ‘মারিচকা’র অনুমানিক পাল্লা হাজার মিটার। রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে অনেক দূর থেকে একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। জ়েলেনস্কির এই হাতিয়ারের সঙ্গে ডুবোজাহাজের টর্পেডোর বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু অস্ত্রটি ইউইউভি হওয়ায় সোনার সিস্টেম ব্যবহার করে তাকে চিহ্নিত করতে পারেনি কোনও রুশ রণতরী বা ডুবোজাহাজ।

০৭ ১৯

কিভের গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘এএমএমও ইউক্রেন’ নামের একটি প্রকল্পের অধীনে স্বেচ্ছাসেবক ইঞ্জিনিয়ারদের হাত ধরে জন্ম হয় ‘মারিচকা’র। আমজনতার অনুদানে এই হাতিয়ারটিকে তৈরি করেন প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কি। এর এক একটি ইউনিটের অনুমানিক খরচ ৪.৩৩ লক্ষ ডলার বলে জানা গিয়েছে। মূলত, কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌসম্পত্তিকে ধ্বংস করার লক্ষ্য নিয়েই মারণাস্ত্রটিকে তৈরি করেছেন স্বেচ্ছাসেবী ইউক্রেনীয় ইঞ্জিনিয়ারেরা।

০৮ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, মানববিহীন উড়ুক্কু যান বা ড্রোনকে চিহ্নিত করা বেশ কঠিন। এর জন্য রেডার ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাচ্ছে বহু দেশ। সেই তালিকায় রয়েছে মস্কোর নামও। কিন্তু জলের নীচের ড্রোনকে খুঁজে পাওয়ার মতো সোনার সিস্টেম এখনও আবিষ্কার হয়নি। এই ফাঁক কাজে লাগিয়ে হামলা চালায় জ়েলেনস্কির ‘মারিচকা’।

০৯ ১৯

দ্বিতীয়ত, ২০২২ সালে এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার গোড়ার দিকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে কৃষ্ণসাগরে রুশ যুদ্ধজাহাজ ‘মস্কোভা’কে ডুবিয়ে দেয় কিভ। তার পর থেকে ইউক্রেনীয় উপকূলের দিকে খুব একটা ঘেঁষার সাহস করেনি মস্কোর কোনও রণতরী। সেখানে ক্রেমলিনের নজরদারি সে ভাবে না থাকায় ‘মারিচকা’কে জলে নামাতে জ়েলেনস্কির বাহিনীকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

১০ ১৯

তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইউক্রেনের এই পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল রুশ ‘গুপ্তচর’ ডলফিনের। ষাটের দশকেই এই বুদ্ধিমান প্রাণীগুলিকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে তৎকালীন সোভিয়েত নৌবাহিনী। ক্রাইমিয়ার সেভাস্তিপোলেই ছিল সেই প্রশিক্ষণকেন্দ্র। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধতেই তাদের কৃষ্ণসাগরের কয়েকটি রুশ নৌঘাঁটির নিরাপত্তায় নিয়োগ করে মস্কো।

১১ ১৯

শত্রুপক্ষের ডুবুরিকে চিহ্নিত করা, সমুদ্রের নীচে বিস্ফোরক চিহ্নিত করা এবং তা উদ্ধার করে নিয়ে আসার কাজে রুশ ডলফিনগুলির জুড়ি মেলা ভার। এমনকি, সমুদ্র্রের তলায় বিস্ফোরক বসানোর প্রশিক্ষণও রয়েছে তাদের। ২০২২ সালের মে মাসে ক্রাইমিয়ার স্নেক আইল্যান্ড-সহ কৃষ্ণসাগরের কয়েকটি রুশ নৌঘাঁটি দখলের জন্য অভিযানে নামে ইউক্রেন। ঠিক তখনই পরিকল্পিত ভাবে ক্রেমলিনের একগুচ্ছ ‘গুপ্তচর’ ডলফিনকে খুন করার অভিযোগ ওঠে কিভ ফৌজের বিরুদ্ধে।

১২ ১৯

২০২২ সালের মে মাসে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে শতাধিক ডলফিনের মৃত্যু হয়। তুরস্কের গবেষকদের দাবি, প্রাণীগুলির দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। তবে তাদের মৃতদেহ উপকূলে ভেসে আসে। এর জন্য ইউক্রেনীয় সেনা বিশেষ ধরনের কোনও বিষ বা রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। একসঙ্গে এতগুলো ডলফিনের মৃত্যু হওয়ায় নতুন করে ওই বাহিনীকে মজবুত করার সময় ও সুযোগ পায়নি রাশিয়া।

১৩ ১৯

২০১৪ সালে ইউক্রেনের থেকে ক্রাইমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। কৃষ্ণসাগর সংলগ্ন এই উপদ্বীপটিকে হাতের তালুর মতো চেনেন ইউক্রেনীয় কমান্ডারেরা। কের্চ সেতুতে নিখুঁত নিশানায় হামলা করার নেপথ্যে একেও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে ১৯ কিলোমিটার লম্বা এই সেতুটির উদ্বোধন করেন স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এর মাধ্যমে ট্রেন ও সড়কপথে উপদ্বীপটিকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়েছে মস্কো।

১৪ ১৯

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ইউক্রেন এই সেতুকে উড়িয়ে দিতে সক্ষম হলে ক্রাইমিয়ার রুশ বাহিনীর কাছে হাতিয়ার, গোলাবারুদ এবং রসদ সরবরাহ কঠিন হত। কৃষ্ণসাগরের দিক থেকে ইউক্রেনে হয়তো আক্রমণও শানাতে পারবে না মস্কো। শুধু তা-ই নয়, পরিস্থিতি সে দিকে গেলে বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করতে পারেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। তখন হাতছাড়া হওয়া এলাকা পুনর্দখলে ঝাঁপাতে পারবে জ়েলেনস্কির ফৌজ।

১৫ ১৯

তবে এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, কের্চকে নিশানা করে যুদ্ধের আগুনে নতুন করে ঘি ঢেলেছে ইউক্রেন। এর বদলা নিতে পুতিনের পরবর্তী নিশানা হবে রাজধানী কিভ। সেই লক্ষ্যে এখন থেকে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছেন রুশ সেনাবাহিনীর পদস্থ কর্তারা।

১৬ ১৯

যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গত তিন বছরে এই নিয়ে মোট তিন বার কের্চ সেতুকে ধ্বংস করার চেষ্টা করল ইউক্রেন। ২০২২ সালে ট্রাক-বিস্ফোরণে সেতুটির উপরিভাগের গার্ডারকে নাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল কিভের গুপ্তচরদের। এর পর ২০২৩ সালে ফের ওই সেতুতে হামলা করে জ়েলেনস্কির বাহিনী। তবে কোনও বারই লক্ষ্যপূরণ হয়নি।

১৭ ১৯

তবে আগের দু’বারের থেকে এ বছরের আক্রমণ যে আরও সঠিক এবং শক্তিশালী ছিল, তা এককথায় মেনে নিয়েছে ক্রেমলিন। রুশ গোয়েন্দাদের অনুমান, কের্চকে ধসিয়ে দিতে একাধিক ইউইউভি ব্যবহার করেছে ইউক্রেনীয় সেনা। সূত্রের খবর, এর জন্য টানা ১৪ মাস ধরে পরিকল্পনা করেন জ়েলেনস্কির গুপ্তচরেরা।

১৮ ১৯

কের্চ সেতুতে হামলার পর দ্রুত তা বন্ধ করে দেয় ক্রেমলিন। এর পর বিস্ফোরণে সেতুটি কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন রুশ ইঞ্জিনিয়ারদের দল। সূত্রের খবর, আপাতত সেতুটি ব্যবহার করতে পারবে মস্কো। কারণ, বিস্ফোরণে সেতুটির স্তম্ভ ভেঙে না পড়ায় আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই বলে স্পষ্ট করা হয়েছে।

১৯ ১৯

গত ১ জুন ড্রোন হামলা চালিয়ে রাশিয়ার ভিতরে পাঁচটি বিমানঘাঁটিকে তছনছ করে দেয় ইউক্রেন। ওই ঘটনায় ৪১টি যুদ্ধবিমান হারায় মস্কো। জ়েলেনস্কির গুপ্তচরেরা এই অপারেশনের নাম রাখেন ‘মাকড়সার জাল’ বা ‘স্পাইডার্স ওয়েব’। সেই ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই একই দিনে ভোর ৪টে ৪৪ মিনিটে কের্চ সেতু টলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে কিভ। এই জোড়া আক্রমণে গোটা ইউরোপে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হল বলে সতর্ক করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement