কখনও পশ্চিম এশিয়া। কখনও আবার ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। এমনকি ইউরোপ, আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকা। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তেই মার্কিন ‘আধিপত্য’কে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে চিন। শুধু তা-ই নয়, গত শতাব্দীর মতো ফের এক বার ধীরে ধীরে দুই ‘মহাশক্তি’র তৈরি করা গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুনিয়া। তবে কি শুরু হয়ে গিয়েছে দ্বিতীয় দফার ‘শীত যুদ্ধ’? এই নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
২১ শতকের মার্কিন-চিন সংঘাতকে ‘দ্বিতীয় ঠান্ডা লড়াই’ বলার নেপথ্যে একাধিক যুক্তি দিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের অনেকেই বর্তমান পরিস্থিতিতে ‘থুসিডাইডিস ফাঁদ’ বলে উল্লেখ করেছেন। সংশ্লিষ্ট শব্দবন্ধটির জনক হলেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্রাহাম টিলেট অ্যালিসন। তাঁর লেখা ‘ডেস্টিন্ড ফর ওয়ার’ বইতে প্রথম বার এই শব্দবন্ধ ব্যবহার হওয়ার পরেই তা জনপ্রিয় হয়ে যায়।
প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসবিদ ছিলেন থুসিডাইসিস। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ৪০৪-এর মধ্যে চলা পেলোপনেসীয় যুদ্ধের কারণ খুঁজতে গিয়ে একটি অভিনব তত্ত্বের উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর যুক্তি ছিল, আথেন্সের উত্থান স্পার্টার মনে ভয় ধরিয়েছিল। সেটাই গ্রিসের দুই নগররাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষকে অনিবার্য করে তোলে। পরবর্তী কালে নিজের বইয়ে এই তত্ত্বেরই নতুন করে ব্যাখ্যা দেন অ্যালিসন। বলেন, ‘‘উদীয়মান শক্তি বিদ্যমান ‘সুপার পাওয়ার’কে স্থানচ্যুত করার চেষ্টা করবেই। একটা সময়ের পর তা লড়াইয়ের রূপ নিতে বাধ্য।’’
বিশ্লেষকদের দাবি, মার্কিন-চিন সংঘাতের ক্ষেত্রে ঠিক সেই পরিস্থিতিটাই সামনে চলে এসেছে। ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সারা বিশ্বের ক্ষমতার ভরকেন্দ্র ঝুঁকে যায় যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। কিন্তু, ২০১০ সালের পর থেকে বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। আর্থিক, সামরিক এবং মহাকাশ গবেষণার মতো বিষয়গুলিতে আমেরিকাকে সমান তালে টক্কর দেওয়া শুরু করে বেজিং। ড্রাগনভূমির এ-হেন রকেট গতির উত্থান যে ওয়াশিংটনের মনে ভয় ধরিয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।
উদাহরণ হিসাবে পশ্চিম এশিয়ার কথা বলা যেতে পারে। এত দিন পর্যন্ত ওই এলাকার আরব দেশগুলিতে সর্বাধিক প্রভাব ছিল আমেরিকার। এখনও সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, ইরাক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে সেনাঘাঁটি রয়েছে ওয়াশিংটনের। কিন্তু, বর্তমানে ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে মুখ ফিরিয়ে চিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে তারা। পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নিয়ে আরবের গরম বালিতে পা জমানোর চেষ্টা চালাচ্ছে বেজিংও।
১৯৭৯ সালে ‘ইসলামীয় বিপ্লব’-এর জেরে রাতারাতি ইরানের শাসনব্যবস্থা চলে যায় কট্টরপন্থী শিয়া ধর্মগুরুদের হাতে। এর জেরে পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক দাঁড়ায় আদায়-কাঁচকলায়। পরবর্তী দশকগুলিতে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ তেহরানের রাজনৈতিক কুর্সি বদলের কম চেষ্টা করেনি। অন্য দিকে, এই সময়কালে কূটনীতিকে ব্যবহার করে ধীরে ধীরে ইরানের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ পাতাতে সক্ষম হয় চিন।
ধর্মীয় মতপার্থক্যের জেরে সুন্নিবহুল সৌদি আরবের সঙ্গে শিয়াপন্থী ইরানের সম্পর্ক কোনও কালেই সরলরেখায় চলেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই ২০২৩ সালের ১০ মার্চ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার লক্ষ্যে একটি চুক্তিতে সই করে রিয়াধ ও তেহরান। সংশ্লিষ্ট সমঝোতায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে চিন। ফলে পশ্চিম এশিয়ার বেজিঙের গুরুত্ব কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। অন্য দিকে এই ঘটনাকে সৌদির উপরে যুক্তরাষ্ট্রের রাশ কিছুটা আলগা হাওয়ার প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরেন বিশ্লেষকেরা।
গত বছরের জুনে আমেরিকার সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ দশকের ‘পেট্রোডলার চুক্তি’ বাতিল করে সৌদি আরব। ফলে আগামী দিনে স্থানীয় বা অন্য মুদ্রায় অপরিশোধিত খনিজ তেল বিক্রি করতে পারবে রিয়াধ। ১৯৭৪ সালের ৮ জুন সংশ্লিষ্ট আরব দেশটির সঙ্গে এই নিয়ে সমঝোতা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে এত দিন শুধুমাত্র ডলারে ‘তরল সোনা’ রফতানি করতে বাধ্য ছিল সৌদি সরকার। ২০২৪ সালের ৯ জুন শেষ হয় ওই চুক্তির মেয়াদ। তার পর আর চুক্তিটির পুনর্নবীকরণে আগ্রহ দেখায়নি তারা।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ‘পেট্রোডলার চুক্তি’ বাতিল হওয়ায় ধাক্কা খেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। পশ্চিম এশিয়ায় এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ দিকে আবার আরব দেশগুলিকে কাছে টানতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্প চালু করেছে বেজিং। এর মূল উদ্দেশ্যই হল চিনের সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার উন্নত সড়ক যোগাযোগ গড়ে তোলা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে বিপুল টাকা লগ্নি করছে ড্রাগন সরকার।
বিআরআই প্রকল্পের জেরে পরিকাঠামোগত উন্নতিতে সক্ষম হয়েছে আরব দুনিয়ার একাধিক দেশ। ফলে চিনের ‘মেগা অফার’-এ সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছে তারা। বর্তমানে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, জর্ডন, ইরান এবং কুয়েতের মতো দেশে চালু রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যবৃদ্ধিতে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মাধ্যমে পশ্চিম এশিয়াকে আফ্রিকা এবং ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইছে বেজিং।
পশ্চিম এশিয়ার পাশাপাশি মহাকাশের লড়াইয়েও মার্কিন ‘একাধিপত্য’কে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে চিন। ২০২১ সালের এপ্রিলে পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশ স্টেশনকে সফল ভাবে স্থাপন করতে সক্ষম হন বেজিঙের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। ওই নভোযানের নাম ‘তিয়ানগং’, মান্দারিন ভাষায় যার অর্থ ‘স্বর্গীয় প্রাসাদ’। সূত্রের খবর, বর্তমানে ড্রাগনভূমির মহাকাশ স্টেশনটিতে তিন থেকে চার জন নভশ্চর রয়েছেন। একক ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত এই ধরনের কোনও মহাকাশ স্টেশন তৈরি করতে পারেনি।
গত শতাব্দীর যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা ‘ঠান্ডা যুদ্ধে’ সব সময়ে খবরের শিরোনামে থেকেছে যুযুধান দু’পক্ষের সামরিক শক্তি। এ বার চিনের সঙ্গে লড়াইয়ে সেখানেও রয়েছে ‘কাঁটে কা টক্কর’। আয়তনের নিরিখে বিশ্বের সর্ববৃহৎ নৌসেনার অধিকারী বেজিং। বিমানবাহিনীর নিরিখেও আমেরিকাকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে ড্রাগনের লালফৌজ। গত কয়েক বছর ধরেই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা।
প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে আমেরিকাকে পিছনে ফেলছে ড্রাগন। মার্কিন টেক জায়ান্ট গুগ্লের মতো নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন রয়েছে বেজিঙের। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কম দামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) মডেল ‘ডিপসিক-আর১’ তৈরি করে বিশ্বে হইচই ফেলে দেয় চিন। ফলে কৃত্রিম মেধার জগতে ওয়াশিংটনের ‘দাদাগিরি’ শেষ হতে চলেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া আর্থিক দিক থেকেও আমেরিকার ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে চিন। বর্তমানে অর্থনীতির বিচারে বিশ্বের প্রথম স্থানে রয়েছে আমেরিকা। দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে বেজিং। পণ্য উৎপাদনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছে মান্দারিনভাষীরা। আর তাই সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্কযুদ্ধে নামলে, সমান তালে কর চাপাতে দেখা গিয়েছে তাদেরও।
বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের যতটা চিনকে প্রয়োজন, বেজিঙের ততটা নয়। বেজিং থেকে বিপুল পরিমাণে বিরল খনিজ আমদানি করে আমেরিকা। বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকল) থেকে শুরু করে সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। অধিকাংশ ধনকুবের মার্কিন শিল্পপতির পণ্য উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে ড্রাগনভূমিতে।
সামরিক সমঝোতার দিক থেকে অবশ্য কিছুটা এগিয়ে আছে আমেরিকা। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী। যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিলে এতে রয়েছে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো দু’টি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। বিশ্বের সেরা সাতটি অর্থনৈতিক দেশকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ বা জি-৭। ওই সংগঠনটিরও মধ্যমণি হল আমেরিকা।
অন্য দিকে ‘ব্রিকস’ এবং ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) মতো সংগঠনের অন্যতম সদস্য রাষ্ট্র হল চিন। এই দুই গোষ্ঠীরই সদস্যপদ রয়েছে ভারত ও রাশিয়ার। ব্রিকস ও এসসিওর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমি দুনিয়াকে বাদ দিয়ে একটি পৃথক অর্থনৈতিক বলয় গড়ে তুলতে চাইছে বেজিং ও মস্কো। এতে সাফল্য পেলে আমেরিকার অর্থনীতি যে চাপের মুখে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু তার পরেও মার্কিন-চিন সংঘাতকে অনেক বিশ্লেষকই ‘দ্বিতীয় শীত যুদ্ধ’ বলতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, বর্তমানে সুনির্দিষ্ট ভাবে দু’টি রাষ্ট্রকে ‘মহাশক্তিধর’ বলা সম্ভব নয়। কারণ, বিশ্ব রাজনীতিতে একাধিক খেলোয়াড়ের উত্থান ঘটে গিয়েছে। সেই তালিকায় অবশ্যই আসবে ভারতের নাম। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বেজিঙের পণ্যকে প্রতিযোগিতার মুখে ফেলছে নয়াদিল্লিও।
তা ছাড়া লেনেদেনের ক্ষেত্রে ভারতের ‘ইউনিফায়েড পেমেন্টস ইন্টারফেস’ বা ইউপিআই পদ্ধতিটি গ্রহণ করেছে ফ্রান্স ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-সহ বিশ্বের আটটি দেশ। পশ্চিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হল ইজ়রায়েল। আয়তনে ছোট হলেও সামরিক শক্তির নিরিখে যথেষ্ট শক্তিশালী ওই ইহুদি রাষ্ট্র।
তৃতীয়ত, এখনও পর্যন্ত কোনও দেশের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করেনি চিন। দেশের বাইরে আফ্রিকার জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিরিখে তা কিছুই নয়। বিশ্ব জুড়ে ৮০০-র বেশি সেনাছাউনি রয়েছে আমেরিকার। দু’তরফে পার্থক্য রয়েছে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে। এর জন্য সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি কতটা বেজিং বা ওয়াশিংটন নেবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।