একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন তিনি। সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই এখন ভারতের বিরুদ্ধে নেমেছেন শুল্কযুদ্ধে। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে বেশ খাতির করতে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। গোটা ঘটনার নেপথ্যে কি নয়াদিল্লির কূটনৈতিক ব্যর্থতা? না কি ‘বিষাক্ত সাপ’-এর গলা জড়িয়ে ভুল করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী? বিশেষজ্ঞ মহলে সেই প্রশ্নেরই চলছে কাটাছেঁড়া।
কূটনীতিকদের মতে, ট্রাম্প বন্ধু না শত্রু— তা বিচার করা বেশ কঠিন। ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তাঁর অধিকাংশ পদক্ষেপেই লাভবান হয় ভারত। উদাহরণ হিসাবে চিনা পণ্যে বিপুল পরিমাণে আমদানি শুল্ক চাপিয়ে দেওয়ার কথা বলা যেতে পারে। এতে আর্থিক লোকসানের মুখে পড়েছিল বেজিং। অন্য দিকে, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মার্কিন বাজারে আরও ভাল ভাবে পা জমানোর সুযোগ পেয়ে যায় নয়াদিল্লির পণ্য।
ট্রাম্পের প্রথম জমানায় আমেরিকা-চিন শুল্কের লড়াইয়ে আরও একটি কারণে সুবিধা পেয়েছিল ভারত। ওই সময়েই ড্রাগনভূমিতে পণ্য উৎপাদনকারী মার্কিন সংস্থাগুলি কারখানা সরানোর জন্য বিকল্প জায়গা খুঁজতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ‘শুল্ক-বাণ’-এর খোঁচা থেকে রক্ষা পেতে চাইছিল তারা। ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সম্পর্ক মধুর হওয়ায় তাদের ‘অটোমেটিক চয়েস’ হয়ে দাঁড়ায় ভারত। আমেরিকার সংস্থাগুলির এই নীতিই ‘চায়না প্লাস’ নামে পরিচিত।
পরবর্তী বছরগুলিতে ড্রাগনভূমি থেকে কিছুটা মুখ ঘুরিয়ে ভারতে পণ্য উৎপাদন শুরু করে একাধিক বহুজাতিক মার্কিন সংস্থা। সেই তালিকায় রয়েছে টেক জায়ান্ট অ্যাপ্লের নাম। বর্তমানে তাদের তৈরি আইফোনের একটা বড় অংশ তৈরি হচ্ছে এ দেশের কারখানায়। সেগুলি মূলত মার্কিন বাজারে রফতানি হওয়ায় কপাল পুড়েছে চিনের। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্য বলছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমেরিকায় আমদানি করা প্রতি তিনটি স্মার্টফোনের মধ্যে একটি ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’।
এ বছরের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বিদেশ থেকে আমদানি করা স্মার্টফোন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন বা ইউএসআইটিসি (ইউনাইটেড স্টেট্স ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশন)। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ভারত থেকে আমেরিকায় স্মার্টফোনের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণ! তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত বছর (পড়ুন ২০২৪) নয়াদিল্লি থেকে ওয়াশিংটনের স্মার্টফোন আমদানির পরিমাণ ছিল ১১ শতাংশ। এ বছরে ইতিমধ্যেই সেই সূচক ৩০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন জানিয়েছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ২ কোটি ১৩ লক্ষ ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ স্মার্টফোন আমদানি করেছে আমেরিকা। ২০২৪ সালে ৭০০ কোটি ডলারের স্মার্টফোন ভারত থেকে পৌঁছেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এ বছরে ইতিমধ্যেই সেটা ১৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৩৫ কোটি ডলার স্পর্শ করে ফেলেছে।
এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম কার্যকালের মেয়াদে পাকিস্তানের উপরে বেজায় খাপ্পা ছিলেন ট্রাম্প। ২০১৮ সালে ইসলামাবাদকে ‘নিরাপত্তা সহায়তা’ সংক্রান্ত আর্থিক অনুদান বন্ধ করেন তিনি। তাঁর সাফ বক্তব্য ছিল, ‘‘সন্ত্রাস দমনে কোনও সাহায্য করেনি পাক সরকার। তাই রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের হাতে কোটি কোটি ডলার তুলে দেওয়ার কোনও অর্থ নেই।’’ ফলে ইসলামাবাদের রক্তচাপ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
পাশাপাশি, প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের পুরো সময়টাই (পড়ুন ২০১৮ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের অক্টোবর) ‘ফিন্যানশিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’ বা এফএটিএফের ধূসর তালিকায় ছিল পাকিস্তানের নাম। মূলত সন্ত্রাসবাদে আর্থিক মদত দেওয়া বন্ধ না করায় ওই নাগপাশ থেকে বেরোতে পারেনি ইসলামাবাদ। ফলে ‘আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার’ বা আইএমএফের (ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড) ঋণের মঞ্জুরিও পায়নি তারা। এতে আর্থিক ভাবে পুরোপুরি দেউলিয়ার দরজায় চলে যায় ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী।
কিন্তু, এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার পর থেকেই ট্রাম্পের গলায় শোনা গিয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো সুর। গত এপ্রিলে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি চালু করে তাঁর প্রশাসন। সেখানে অবশ্য পাকিস্তানি পণ্যে আমদানি শুল্কের অঙ্ক ছিল ২৯ শতাংশ। আর ভারতীয় পণ্যে ২৬ শতাংশ শুল্ক বসান তিনি। কিন্তু, নয়াদিল্লির বদলে ইসলামাবাদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে একটি বিবৃতি দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। আর তাতেই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় হইচই।
এপ্রিলে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নিয়ম প্রয়োগ করে ট্রাম্প বলে বসেন, ‘‘পাক নাগরিকেরা খুবই ভাল। আমেরিকার বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য আশা করি আমাদের সঙ্গে দ্রুত চুক্তি সেরে ফেলবে ইসলামাবাদ।’’ পরবর্তী তিন মাসের মাথায় দু’পক্ষের মধ্যে সম্পন্ন হয় বাণিজ্যচুক্তি। ফলে পাকিস্তানের উপর শুল্কের অঙ্ক কমিয়ে ১৯ শতাংশ করে দেন ট্রাম্প।
সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারিতে এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাকিস্তানকে প্রায় ৪০ কোটি ডলার অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ট্রাম্প। তবে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের উপর বিশেষ শর্ত চাপিয়ে দেয় আমেরিকা। সেখানে বলা হয়, এই লড়াকু জেট কেবলমাত্র সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যবহার করতে পারবেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
ওয়াশিংটনের শর্তে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছিল। কোনও অবস্থাতেই এফ-১৬ ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার বা মোতায়েন করা যাবে না বলে পাক সেনাকর্তাদের নির্দেশ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। বিষয়টি নিয়ে দিল্লি সুর চড়াতে শুরু করলে বাধ্য হয়ে বিবৃতি দেয় আমেরিকা। মার্কিন সরকারের যুক্তি ছিল, ইসলামাবাদের এফ-১৬ বহরকে অত্যাধুনিক করা হচ্ছে না। তবে চুক্তি অনুযায়ী এর রক্ষণাবেক্ষণের অর্থ দিতে বাধ্য তারা।
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ ২৬ জন। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে-তে (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) একাধিক সন্ত্রাসী ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় ফৌজ। এই অভিযানের পোশাকি নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’।
নয়াদিল্লি ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করতেই জঙ্গিদের সমর্থনে আসরে নামে পাকিস্তান। ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং লড়াকু জেট নিয়ে ভারতের সামরিক ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করার চেষ্টা করে ইসলামাবাদ। যাবতীয় আক্রমণ ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র মাধ্যমে প্রতিহত করে পাল্টা আঘাত হানে এ দেশের বাহিনী। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ধ্বংস করা হয় পাক বায়ুসেনার অন্তত ন’টি ছাউনি। ফলে তড়িঘড়ি সংঘর্ষবিরতি চেয়ে ভারতের ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশনস’ বা ডিজিএমও-কে ফোন করেন পাকিস্তানের সম পদমর্যাদার এক সেনা অফিসার।
দুই ডিজিএমও-র মধ্যে কথা হওয়ার পর বন্ধ হয় ‘যুদ্ধ’। কিন্তু ট্রাম্পের দাবি, তাঁর মধ্যস্থতাতেই হয়েছে এই সংঘর্ষবিরতি। জুলাইয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর এই ‘অযৌক্তিক’ কথা অস্বীকার করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী মোদী। ফলে নয়াদিল্লির উপর ক্ষোভ বাড়তে থাকে বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্টের।
এই পরিস্থিতিতে জুলাইয়ে ভারতীয় পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। তাঁর যুক্তি, রাশিয়া থেকে ক্রমাগত খনিজ তেল আমদানি করছে নয়াদিল্লি। ফলে ইউক্রেনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় অর্থ হাতে পাচ্ছে মস্কো। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে কিভের বিরুদ্ধে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ বা স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে অস্থির রয়েছে পূর্ব ইউরোপ।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক রাশিয়ার উপর বিপুল নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে অর্থনীতি বাঁচাতে সস্তা দরে ভারতকে ‘তরল সোনা’ বিক্রির প্রস্তাব দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। আর্থিক লাভের কথা মাথায় রেখে পত্রপাঠ ওই ‘টোপ’ গিলে নেয় নয়াদিল্লি। বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় মোদী সরকার। উল্টে এ দেশের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলে বিষোদ্গার করেছেন ট্রাম্প।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় দফায় মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভারত-বিদ্বেষের একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, তিনি ভেবেছিলেন শুল্কের ভয়ে তড়িঘড়ি ওয়াশিংটনের শর্তে বাণিজ্যচুক্তি করবে ভারত। সে ক্ষেত্রে এ দেশের বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাবে আমেরিকার কৃষি এবং দুগ্ধজাত পণ্য। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, ভারতীয় কৃষক এবং ডেয়ারি শিল্পে জড়িতদের স্বার্থরক্ষায় যাবতীয় পদক্ষেপ করবে সরকার।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের আশা ছিল রাশিয়ার বদলে এ বার থেকে বিপুল পরিমাণে মার্কিন হাতিয়ার আমদানি করবে নয়াদিল্লি। কিন্তু, তিনি শুল্কযুদ্ধ শুরু করতেই সেখান থেকে কিছুটা সরে আসে মোদী সরকার। পাশাপাশি, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের আমেরিকা সফরও স্থগিত করে কেন্দ্র। বিশ্লেষকদের দাবি, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে মস্কো থেকে অস্ত্র আমদানি আরও বাড়াতে পারে এ দেশের বাহিনী।
গত জুনে পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে হোয়াইট হাউসের ভোজসভায় আমন্ত্রণ জানান ট্রাম্প। অগস্টের শেষে অবসরগ্রহণ করছেন মার্কিন সেনাবাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের শীর্ষ ফৌজি আধিকারিক জেনারেল মাইকেল কুরিল্লা। তাঁর বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দু’মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বার আমেরিকা গিয়েছেন মুনির। সেখানে পৌঁছেই ভারতকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দেন তিনি।
কূটনীতিকদের একাংশ অবশ্য মনে করেন ট্রাম্পের এই ভারত-বিরোধিতা সাময়িক। ইতিমধ্যেই পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠন ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ বা টিআরএফ-কে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে ঘোষণা করেছে তাঁর সরকার। আগামী ১৫ অগস্ট ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে পুতিনের সঙ্গে আলাস্কায় বৈঠকে বসছেন তিনি। তার আগে ট্রাম্পের গলায় শোনা গিয়েছে দিল্লি-স্তুতি। আমেরিকার প্রাক্তন জাতীয় নিরাপত্তা আধিকারিকদের একাংশ ইতিমধ্যেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করা নিয়ে গলা তুলতে শুরু করেছেন। এতে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনকে ঠেকানো কঠিন হবে বলে মনে করেন তাঁরা।