ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী হিসাবে ‘নাম কিনেছেন’ ডোনাল্ড ট্রাম্প। নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের দ্বন্দ্বে হঠাৎ কেন উদ্বিগ্ন হলেন ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের প্রেসিডেন্ট? নেপথ্যে পরমাণু যুদ্ধের আতঙ্ক, না কি ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি? যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তার সৌদি আরব সফরের মধ্যে এই নিয়ে কাটাছেঁড়া চালাচ্ছেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ১৩ মে সৌদি আরবের মাটিতে পা রাখেন ট্রাম্প। দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর এটাই তাঁর প্রথম বিদেশ সফর। কিন্তু, তিনি আরব মুলুকটিতে পৌঁছোনোর মুখে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে পরমাণু শক্তিধর ভারত ও পাকিস্তান। সংঘর্ষ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকায় প্রমাদ গোনেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ফলে দ্রুত লড়াই থামাতে উদ্যোগী হন এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদের মধ্যে সংঘর্ষবিরতিতে ট্রাম্পের উদ্যোগী হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এক ঢিলে একাধিক পাখি মারতে চেয়েছেন তিনি। আরবের গরম বালিতে পা রাখার আগে অধিকাংশ ইসলামীয় দেশের সমর্থন ছিল তাঁর প্রথম লক্ষ্য। আর সেই কারণে ‘মধ্যস্থতা’ করতে দেখা গিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে।
গত বছর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ইস্তক, চাঁছাছোলা ভাষায় ইসলামীয় কট্টরপন্থা, মৌলবাদী চিন্তাভাবনা এবং সন্ত্রাসবাদের কড়া সমালোচনা করে এসেছেন ট্রাম্প। এগুলির সব ক’টি পাকিস্তানের গায়ে এঁটুলির মতো লেগে রয়েছে। তা সত্ত্বেও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লির চাবুকের ঘা পড়তেই সরব হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর প্রথম কারণ হিসাবে বাণিজ্যকে তুলে ধরেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, ভারত-পাক ‘যুদ্ধ’ চলতে থাকলে ট্রাম্পের পক্ষে সৌদি আরবের বিশ্বাস অর্জন করা কঠিন হত। কারণ, এত দিনে তাঁর ইসলাম-বিরোধী ছবি উপসাগরীয় দেশগুলিতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। আরব মুলুকে যাওয়ার আগে সেটা মেরামত করার প্রয়োজন ছিল। সেই কারণে লড়াই থামিয়ে পাকিস্তানের রক্ষাকর্তা হিসাবে নিজেকে তুলে ধরেছেন তিনি। বিনিময়ে, রিয়াধ থেকে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ আদায় করতে ভোলেননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
ট্রাম্পের আগমন অবশ্য রাজকীয় ভাবে বরণ করে নেয় মক্কা-মদিনার দেশ। সেখানে পৌঁছে সৌদি যুবরাজ তথা প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমনের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। এর পরেই রিয়াধ যে ৬০ হাজার কোটি ডলার লগ্নি করতে চলেছে, তা ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। দুই দেশের মধ্যে একাধিক বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ট্রাম্পের সঙ্গে ছিলেন একাধিক ধনকুবের শিল্পপতি। তাঁদের সঙ্গেও যুবরাজ সলমনের আলাপ করিয়ে দেন তিনি।
ট্রাম্পের সৌদি সফরে ওয়াশিংটন ও রিয়াধের মধ্যে ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষাচুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আকাশ-যুদ্ধের একাধিক সরঞ্জাম, বিভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, মহাকাশে শক্তি অর্জন এবং নৌশক্তি বৃদ্ধি। বিশ্লেষকদের দাবি, এর ফলে এক ডজন মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা ব্যাপক ভাবে লাভবান হবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই অব্যাহত থাকলে যুবরাজ সলমন এতে রাজি হতেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। পারস্য উপসাগরের ওই শিয়া মুলুকটি পরমাণু হাতিয়ার তৈরি করে ফেলুক, তা একেবারেই চান না মার্কিন প্রেসিডেন্ট। অন্য দিকে তেহরান আণবিক মারণাস্ত্র নির্মাণের খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি জটিল হলে পড়শি দেশ পাকিস্তানের প্রয়োজন হতে পারে। লড়াই থামানোর ক্ষেত্রে এটাও কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
অতীতে আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় বিভিন্ন ভাবে ‘নিজের ক্ষতি’ করেও ওয়াশিংটনের পাশে থেকেছে ইসলামাবাদ। এতে অবশ্য কাবুলের সঙ্গে বেড়েছে তাঁদের শত্রুতা। ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির স্বপ্ন পরিত্যাগ না করলে, সেখানেও যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফৌজি অভিযান পাঠাবেন না, তা জোর দিয়ে বলা সম্ভব নয়। তখন পাকিস্তান পাশে থাকলে সুবিধা হবে মার্কিন সেনা সদর দফতর পেন্টাগনের।
তৃতীয়ত, স্বল্প পরিসরের এই ‘যুদ্ধে’ পাকিস্তানের একাধিক বায়ুসেনাঘাঁটিকে গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় বিমানবাহিনী। এর পরই লড়াই ‘নাটকীয় মোড়’ নিতে পারে বলে গোয়েন্দা সূত্রে রিপোর্ট পান মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। তড়িঘড়ি গোটা বিষয়টি ট্রাম্পকে জানান তিনি। শুধু তা-ই নয়, ওই সময়ই সংঘর্ষবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে আমেরিকা। যদিও গোয়েন্দা রিপোর্টে ঠিক কী ছিল, তা প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে আমেরিকার মনে চেপে বসে পরমাণু যুদ্ধের ভয়। ওয়াশিংটনের মনে হয়েছিল, যে কোনও মুহূর্তে একে অপরের উপরে আণবিক অস্ত্র প্রয়োগ করবে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী। লড়াই বাধার আগে থেকেই অবশ্য পরমাণু হামলার হুমকি দিচ্ছিলেন ইসলামাবাদের সেনা এবং রাজনৈতিক নেতারা।
ভারতীয় বিমানবাহিনীর মুহুর্মুহু আক্রমণে সর্বাধিক ক্ষতি হয়েছে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি সেনা সদর দফতর সংলগ্ন নূর খান ছাউনির। ইসলামাবাদের খুব কাছে সরগোধা বায়ুসেনা ঘাঁটির অবস্থাও তথৈবচ। এর ২০ কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে কিরানা পাহাড় (কিরানা হিল্স)। বিশেষজ্ঞদের দাবি, নুর খান এবং কিরানা পাহাড়ের ভূ-গর্ভস্থ সুড়ঙ্গে রয়েছে পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রভান্ডার।
এই দুই জায়গায় ভারতের হামলা হওয়ার পরেই আণবিক অস্ত্রভান্ডারের ক্ষতি হয়েছে বলে সমাজমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ হওয়ার আশঙ্কাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়নি পশ্চিমি সংবাদমাধ্যম। যুদ্ধবিরতির জন্য আমেরিকার উদ্যোগী হওয়ার নেপথ্যে একে অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
তা ছাড়া সব সময় খবরের শিরোনামে থাকতে পছন্দ করেন ট্রাম্প। কিন্তু, তাঁর সৌদি আরব সফরের মুখে দুনিয়ার যাবতীয় সংবাদমাধ্যমের নজর ছিল ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের দিকে। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এটা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ফলে যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি কাশ্মীর সমস্যা মেটাতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি।
চলতি বছরের ১৩ মে এই ইস্যুতে বিবৃতি দেয় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, ‘‘জম্মু-কাশ্মীরের ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার কোনও প্রয়োজন নেই।’’ অন্য দিকে, জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদী স্পষ্ট করে দেন যে, ভবিষ্যতে শুধুমাত্র পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) ফেরানোর ব্যাপারে কথা বলবে নয়াদিল্লি, অন্য কিছু নিয়ে নয়।
টানা চার দিন সংঘাত চলার পর গত ১০ মে সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয় দুই প্রতিবেশী দেশ। নয়াদিল্লির দাবি, এর জন্য ভারতের ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন্সের (ডিজিএমও) সঙ্গে ফোনে কথা বলেন পাকিস্তানের ডিজিএমও। সেখানেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যদিও রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের দাবি, এর জন্য কোনও আবেদন করেনি পাক ফৌজ।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ১০ মে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই নিজের সমাজমাধ্যম সংস্থা ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ এই বিষয়ে পোস্ট করেন ট্রাম্প। ঠিক তার পরের দিন (প়ড়ুন ১১ মে) হোয়াইট হাউসের বক্তৃতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আমরা সংঘাত বন্ধ করতে বলেছিলাম। সেটা না হলে আমরা কোনও বাণিজ্য করব না, এটা বলেছিলাম। ভারত-পাক যুদ্ধ বন্ধ করার নেপথ্যে অন্যতম বড় কারণ হল ব্যবসা।’’
কিন্তু ট্রাম্পের এই দাবিকে নাকচ করে দিয়েছে নয়াদিল্লি। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র জয়সওয়াল বলেন, ‘‘১০ মে পর্যন্ত উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বহু বার মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে। তবে সেখানে কখনওই বাণিজ্যের প্রসঙ্গ ওঠেনি।’’