কখনও ‘অপারেশন সিঁদুর’। কখনও আবার শুল্ক-যুদ্ধ। সঙ্গে বাড়তি পাওনা পাকিস্তান-প্রেম। দ্বিতীয় বার কুর্সিতে বসা ইস্তক ভারত-আমেরিকার ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ যেন ভেঙে ফেলতে চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর ঠিক সেই কারণেই এ দেশের অর্থনীতিকে ‘মৃতবৎ’ বলে তোপ দেগেছেন তিনি। একটা সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘বন্ধু’ বলা ট্রাম্পের হঠাৎ কেন এতটা পরিবর্তন? এর নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য সারা দুনিয়াকে নিজের আঙুলে নাচাতে চান ট্রাম্প। আর তাই আমেরিকার শর্তে ভারতকে বাণিজ্য চুক্তিতে রাজি করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তিনি। ট্রাম্প চান, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৃষি এবং দুগ্ধজাত পণ্যের বাজার খুলে দিক নয়াদিল্লি। কিন্তু, কেন্দ্রের মোদী সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, এ দেশের কৃষক এবং দুগ্ধশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের লোকসান করে কোনও সমঝোতা সম্ভব নয়। ফলে বেজায় চটেছেন তিনি।
দ্বিতীয়ত, পূর্বসূরি বারাক হুসেন ওবামার মতো নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে আগ্রহী ট্রাম্প। সেই কারণে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু করে গত সাত মাসে অন্তত ছ’টি জায়গায় যুদ্ধ থামাতে তিনি সমর্থ হয়েছেন বলে প্রচার শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট মনে করেন ভারতের জন্যই হাতছাড়া হতে বসেছে তাঁর ওই পুরস্কার। পূর্ব ইউরোপের সংঘাতে সমানে ঘি ঢালছে নয়াদিল্লি। ফলে চেষ্টা করেও যুযুধান দু’পক্ষকে সংঘর্ষবিরতিতে রাজি করাতে পারছেন না তিনি।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছর ধরে রাশিয়ার থেকে সস্তা দরে খনিজ তেল কিনছে নয়াদিল্লি। ট্রাম্পের যুক্তি, এর ফলে মস্কোর উপরে ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় অর্থ পেয়ে যাচ্ছে ক্রেমলিন। এর জেরে সংঘর্ষ থামাতে না পারায় নিজের ‘শান্তিকামী’ ভাবমূর্তি গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে পারছেন না তিনি। গত বছরের নির্বাচনী প্রচারে ক্ষমতায় এলে মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ থামিয়ে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন ট্রাম্প।
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ট্রাম্প। তখনও কিন্তু মোদীকে ‘বন্ধু’ বলেই উল্লেখ করছিলেন তিনি। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতেই সেই আচরণে সামান্য বদল লক্ষ্য করা যায়। ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান প্রধানমন্ত্রী। তিনি ওয়াশিংটনে পৌঁছোনোর ঠিক আগের মুহূর্তে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে বিবৃতি দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘‘আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও মার্কিন পণ্যে বিপুল পরিমাণে শুল্ক নিয়ে থাকে ভারত।’’ নয়াদিল্লি নীতি না বদলালে ‘শাস্তিমূলক’ ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
গত ২ এপ্রিল আরও জটিল হয় পরিস্থিতি। ওই তারিখ থেকে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতি চালু করেন ট্রাম্প। ফলে নয়াদিল্লির পণ্যে চাপে ২৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক। এর পরেই দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা। ফলে ওই আমদানি শুল্ককে স্থগিত রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু, দ্রুত সমঝোতায় না এলে ফের শুল্ক চাপানোর হুমকি সমানে দিতে থাকেন তিনি।
এর পর ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ ২৬ জন। ওই ঘটনার প্রত্যাঘাত হানতে মে মাসের গোড়াতেই ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে ভারতীয় সেনা। ফলে টানা চার দিন ধরে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চলে ‘যুদ্ধ’। ওই সংঘর্ষে ইসলামাবাদের বিমানবাহিনীর ২০ শতাংশ পরিকাঠামো ধ্বংস করে দেয় এ দেশের ফৌজ। তখনই বাধ্য হয়ে সংঘর্ষবিরতি করে পাকিস্তান। লড়াই বন্ধ করতে ভারতের ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন’ বা ডিজিএমও-র সঙ্গে কথা বলেন রাওয়ালপিন্ডির সম পদমর্যাদার একজন ফৌজি অফিসার।
ভারত-পাক সংঘর্ষবিরতি হতে না হতেই আসরে নেমে পড়েন ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই পরমাণু শক্তিধরের মধ্যে ‘যুদ্ধ’ থামাতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছেন বলে ক্রমাগত দাবি করতে থাকেন তিনি। এর জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেনি পাক সরকার। অন্য দিকে, ট্রাম্পের দাবি মিথ্যা বলে স্পষ্ট করে দেয় ভারত। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এই নিয়ে প্রচার চালানো বন্ধ করেননি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট।
পহেলগাঁও হামলার ঠিক আগে উস্কানিমূলক মন্তব্য করে খবরের শিরোনামে আসেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ঘটনার নেপথ্যে তাঁর হাত থাকার সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না গোয়েন্দাদের একাংশ। কিন্তু, গত জুনে ট্রাম্পের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসের ভোজসভায় যোগ দেন মুনির। সূত্রের খবর, তাঁর কাঁধে পাকিস্তানে নিজের ক্রিপ্টো ব্যবসার যাবতীয় দায়িত্ব দিতে চান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এতে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক আরও কিছুটা খারাপ হয়েছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
জুলাইয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধানী ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) প্রধান মার্ক রাটের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ভারত এবং চিনের নাম করে হুমকি দেন তিনি। রাট বলেন, ‘‘অবিলম্বে রাশিয়ার থেকে তেল কেনা বন্ধ না করলে নয়াদিল্লি এবং বেজিঙের উপরে চাপবে বড় আকারের শুল্ক।’’ তাঁর হুঁশিয়ারির দু’দিনের মাথায় গুজরাটের একটি সংশোধনাগারের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।
জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে সংসদে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানে ট্রাম্পের নাম না করে তিনি বলেন, ‘‘কোনও বিদেশি রাষ্ট্রনেতার কথায় অপারেশন সিঁদুর স্থগিত করা হয়নি।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পরেই নয়াদিল্লির উপরে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পাশপাশি, ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ বলেও সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন তিনি।
গত ৩০ জুলাই নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট লেখেন, ‘‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। ওরা ‘মৃত অর্থনীতি’কে একসঙ্গে ধ্বংস করতে পারে। আমি সব কিছুর জন্য চিন্তা করি। আমরা ভারতের সঙ্গে খুব কম ব্যবসা করেছি। কারণ, নয়াদিল্লির শুল্ক অনেক বেশি। একে বিশ্বের সর্বোচ্চ বলা যেতে পারে। রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে প্রায় কোনও ব্যবসা নেই বললেই চলে।’’ তাঁর এই পোস্টের পরেই শুরু হয় হইচই।
পাশাপাশি, সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে ট্রাম্প জানান যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলেছে আমেরিকা। আর তাই ইসলামাবাদের উপরে শুল্ক কমে দাঁড়াচ্ছে ১৯ শতাংশ। শুধু তা-ই নয়, পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটি থেকে খনিজ তেল উত্তোলনের জন্য বিপুল লগ্নি করার কথাও ঘোষণা করেন তিনি। বলেন, ‘‘আগামী দিনে হয়তো পাকিস্তানের থেকে তেল কিনবে ভারত।’’
বিশ্লেষকদের একাংশ আবার মনে করেন প্রতিরক্ষা ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করতে উদ্যোগী হয়েছেন ট্রাম্প। গত ফেব্রুয়ারিতে মোদীর মার্কিন সফরের সময়ে হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আমরা নয়াদিল্লির হাতে স্টেল্থ শ্রেণির এফ-৩৫ লাইটনিং টু যুদ্ধবিমান দিতে ইচ্ছুক।’’ কিন্তু সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেট কেনার ব্যাপারে কোনও উৎসাহ দেখায়নি কেন্দ্র। উল্টে রাশিয়ার থেকে পঞ্চম প্রজন্মের এসইউ-৫৭ ফেলন যুদ্ধবিমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কিনতে চলেছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে।
গত শতাব্দীতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘শীত যুদ্ধ’ চলাকালীন পাকিস্তানকে পুরোপুরি পাশে পেয়েছিল আমেরিকা। ওই সময়ে জোট নিরপেক্ষতা বজায় রাখলেও মস্কোর সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ককে যথেষ্ট সন্দেহের চোখে দেখত ওয়াশিংটন। সেখানে বড় বদল আনেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। ভারতের সঙ্গে অসামরিক পরমাণু চুক্তি সেরে ফেলেন তিনি।
পরবর্তী কালে বারাক ওবামা এবং জো বাইডেনের সময়কালে ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠতে থাকে দু’দেশের সম্পর্কের গ্রাফ। আমেরিকার সঙ্গে বেশ কিছু প্রতিরক্ষা চুক্তিও করে ভারত। প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম কার্যকালের মেয়াদে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে টেক্সাসে ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন স্বয়ং ট্রাম্প। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত সফরে আসেন তিনি। ওই সময়ে তাঁর সম্মানার্থে গুজরাটের অহমদাবাদ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আয়োজিত হয় ‘নমস্তে ট্রাম্প’ শীর্ষক অনুষ্ঠান।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে ফিদায়েঁ হামলা চালায় পাক মদতপুষ্ট এক জঙ্গি। বদলা নিতে পাকিস্তানের বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক চালায় ভারতীয় বায়ুসেনা। ২০২০ সালে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চিনা লালফৌজের সঙ্গে সংঘর্ষে কর্নেল বি সন্তোষ বাবু-সহ ২০ জন সৈনিককে হারায় নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, পাল্টা প্রত্যাঘাতে মৃত্যু হয় বেজিঙের ৪০-এর বেশি ফৌজির।
এই দুই ঘটনার সময়ে ট্রাম্পের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ফলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আমেরিকা, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে তৈরি চতুঃশক্তি জোটকে আরও মজবুত করার পরিকল্পনা করতে থাকে নয়াদিল্লি। এতে চিনের রক্তচাপ বেড়েছিল।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আরও তলানিতে গেলে চতুঃশক্তি জোট কোয়াড ছাড়তে পারে নয়াদিল্লি। তবে এখনই সে ব্যাপারে কোনও হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে রাজি নয় সাউথ ব্লক। ট্রাম্প যে দিকে ঠেলছেন তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকেরা।