পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনে মধ্যাহ্নভোজ। তার পর লম্বা সময় ধরে রুদ্ধদ্বার বৈঠক। ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের মধ্যে ইসলামাবাদকে বন্ধুত্বের বার্তা দিয়ে গোটা বিশ্বকে চমকে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু সাত দিন কাটতে না কাটতেই উলটপুরাণ! পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে ‘ধমকালেন’ যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশসচিব। এতে পাক সরকার এবং সেনার রক্তচাপ বাড়ল বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
চলতি বছরের ২৭ জুন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো। সূত্রের খবর, কথোপকথনের সময় ইসলামাবাদকে কড়া হুঁশিয়ারি দেন তিনি। বলেন, ‘‘কোনও অবস্থাতেই যেন পরমাণু অস্ত্র না-তৈরি করতে পারে ইরান। সেই সুযোগ তেহরানকে দেওয়া উচিত নয়।’’ তবে কি তলে তলে এ ব্যাপারে প্রতিবেশী পারস্য দেশকে সাহায্য করছেন রাওয়ালপিন্ডি ফৌজি জেনারেলরা? ইতিমধ্যেই উঠতে শুরু করেছে সেই প্রশ্ন।
ট্রাম্প প্রশাসন অবশ্য এ ব্যাপারে স্পষ্ট কোনও জবাব দেয়নি। যদিও রুবিয়ো-শরিফ ফোনালাপের পর তা নিয়ে বিবৃতি জারি করে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস সেখানে বলেন, ‘‘ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে চিরস্থায়ী শান্তি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ ব্যাপারে যৌথ ভাবে কাজ করার গুরুত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন তিনি।’’
ইরান ইস্যুতে ইসলামাবাদকে নিয়ে আমেরিকার আশঙ্কা একেবারেই অমূলক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের অনুমান, পরমাণু বোমা তৈরির জন্য সমৃদ্ধ হওয়া (পড়ুন এনরিচ্ড) ইউরেনিয়াম লুকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের জমি ব্যবহার করতে পারে তেহরান। যুদ্ধ বন্ধ হওয়ায় এ বার তা ফিরিয়ে নিয়ে গেলে আণবিক অস্ত্র নির্মাণের দরজা খুলে যাবে কট্টরপন্থী সাবেক পারস্য দেশের সামনে। অতীতেও বহু বার এ ব্যাপারে শিয়া মুলুকটিকে সাহায্যের অভিযোগ উঠেছে পাক সরকার এবং সেনার বিরুদ্ধে।
২০০৩ সালে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে একটি গোপন রিপোর্ট প্রেসিডেন্ট অফিসে জমা করে মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি)। সূত্রের খবর, সেখানে এই সংক্রান্ত প্রযুক্তি ইসলামাবাদ থেকে তেহরান পাচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওই অভিযোগ উড়িয়ে দেয় পাক সরকার। কিন্তু পরে চাপ বৃদ্ধি পেলে গোটা বিষয়টি স্বীকার করে তারা।
ওই সময়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ইরানকে পরমাণু সমৃদ্ধিকরণ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত প্রযুক্তি সরবরাহের নেপথ্যে রয়েছেন পাক পরমাণু বিজ্ঞানী আব্দুল কাদের খান। এই খবরকে কেন্দ্র করে বিতর্কের ঝড় ওঠায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে গৃহবন্দি করে ইসলামাবাদ। সেখান থেকে আর কখনওই বেরোতে পারেননি তিনি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, পাকিস্তানের ‘আণবিক অস্ত্রের জনক’ ছিলেন এই আব্দুল কাদের খান।
পাকিস্তান এবং ইরানের মধ্যে প্রায় ৯০৯ কিলোমিটার লম্বা আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে। সাবেক পারস্য দেশ লাগোয়া ইসলামাবাদের প্রদেশটি হল বালোচিস্তান। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, গোটা এলাকাটি পাহাড়ে ঘেরা হওয়ায় সেখানে ইউরেনিয়াম লুকিয়ে রাখা তেহরানের পক্ষে খুব একটা কঠিন নয়। আর সেই সুযোগ একমাত্র তাদের দিতে পারে পাক রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সেনা।
সম্প্রতি ১২ দিন ধরে চলা যুদ্ধে বার বার ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলিকে নিশানা করে ইজ়রায়েল এবং মার্কিন বায়ুসেনা। প্রথম থেকেই খোলাখুলি ভাবে এর নিন্দা করেছে পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, ইসলামাবাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ ব্যাপারে তেহরানের পাশে থাকার কথা পার্লামেন্ট তথা ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’র ভাষণে উল্লেখও করেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচরদের মনে দানা বাঁধে সন্দেহ। আর তাই পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাওয়ার আগে শাহবাজ়কে কড়া সতর্কবার্তা দিলেন রুবিয়ো, মত বিশ্লেষকদের।
অতীতে দ্বিমুখী নীতি নিয়ে বহু বার আমেরিকাকে ‘ধোঁকা’ দিয়েছে ইসলামাবাদ। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ওসামা বিন লাদেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে ২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। চারটি যাত্রিবাহী বিমান ছিনতাই করে ‘ফিদায়েঁ’ আক্রমণ শানায় কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী আল কায়দা। ওই সময়ে হামলার মূল চক্রী তথা সংগঠনের শীর্ষনেতা বিন লাদেন লুকিয়ে ছিলেন আফগানিস্তানে। ফলে কালবিলম্ব না করে হিন্দুকুশের কোলের দেশটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেয় ওয়াশিংটন।
আফগানিস্তানে মার্কিন ফৌজের অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এনডুয়েরিং ফ্রিডম’। এতে ইসলামাবাদকে পাশে পেয়েছিল আমেরিকা। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবটাবাদে লাদেনের খোঁজ পায় মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কমান্ডো পাঠিয়ে তাঁকে নিকেশ করে ওয়াশিংটন। জানা যায়, দীর্ঘ দিন ধরেই পরিবার নিয়ে অ্যাবটাবাদে লুকিয়ে ছিলেন লাদেন। সব জেনেও সেই তথ্য যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়নি পাকিস্তান।
ইরানের ক্ষেত্রেও ইসলামাবাদ এই ধরনের দ্বিমুখী নীতি নিতে পারে বলে সন্দেহ সিআইএ-র। তবে বিশ্লেষকদের কাছে রুবিয়ো-শাহবাজ়ের মধ্যে ফোনালাপের আরও একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, তেল আভিভ এবং তেহরানের মধ্যে সংঘর্ষবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সে ক্ষেত্রে ফের পাকিস্তানকে প্রয়োজন হতে পারে ওয়াশিংটনের।
গত ২৪ থেকে ২৬ জুন নেদারল্যান্ডসের ‘দ্য হেগ’ শহরে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংগঠন’ বা নেটোর বৈঠকে যোগ দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সেখানে যে কোনও মুহূর্তে ফের ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ শুরু হতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ফলে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মধ্যে শুরু হয়েছে জল্পনা। তাঁদের অনুমান, আফগান সংঘর্ষের সময় যে ভাবে ইসলামাবাদকে আমেরিকা ব্যবহার করেছে, তেহরানের ব্যাপারে তার ‘পুনঃসম্প্রচার’ দেখতে পাবে বিশ্ব।
গত ২২ জুন তেহরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালায় আমেরিকার কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’। তার পরই গোয়েন্দা রিপোর্টকে উড়িয়ে দিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানিয়ে দেন, ওই বোমাবর্ষণে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিআইএ জানিয়েছে আক্রমণে সাবেক পারস্য দেশের পরমাণু কর্মসূচিকে কয়েক মাস পিছিয়ে দেওয়া গিয়েছে। মোটেই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি।
এ ছাড়া গত ১৩ থেকে ২৪ জুনের মধ্যে বেশ কয়েক বার ইরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্রে আক্রমণ শানিয়েছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। কিন্তু জোড়া ধাক্কা সত্ত্বেও তেহরানের কোনও আণবিক কেন্দ্র থেকেই তেজস্ক্রিয় বিকিরণের খবর পাওয়া যায়নি। এতে আরও বেশি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার রাজ্যের ডার্টমাউথ কলেজের পরমাণু বিশেষজ্ঞ নিকোলাস মিলার।
‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্স’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিলার বলেছেন, ‘‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলে তেহরান কখনওই পরমাণু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা থেকে দূরে সরে আসবে না। উল্টে এর পর আরও মরিয়া ভাবে ওই মারণাস্ত্র তৈরির চেষ্টা চালাবে তারা। তাই ইরানের আণবিক কার্যকলাপে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে।’’
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অনুমান, গত ১৩ জুন ইজ়রায়েলের প্রথম আক্রমণের পরই ইরানের শিয়া ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, তাঁদের সমৃদ্ধ করা ইউরেনিয়াম নষ্ট করতে চাইছে ইহুদি ফৌজ। তা ছা়ড়া সাবেক পারস্য দেশে হামলা নিয়ে আগাম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এই পরিস্থিতিতে সন্দেহের তালিকার শীর্ষে থাকা ইরানি পরমাণুকেন্দ্রগুলিতেই সমৃদ্ধ হওয়া ইউরেনিয়াম আইআরজিসি রেখে দিয়েছিল, এই ধারণা কষ্টকল্পিত। উল্টে দ্রুত সেখান থেকে অন্য কোনও গুপ্তঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেই কারণে মার্কিন ও ইজ়রায়েলি হামলায় আণবিক কেন্দ্রগুলির অবকাঠামো ধ্বংস হলেও তেহরানের তেমন লোকসান হয়নি। এখনও পরমাণু বোমা তৈরির সক্ষমতা রয়েছে তাদের, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
গত ১২ জুন ইরানের পরমাণু শক্তি সংস্থার প্রধান মহম্মদ ইসলামি দাবি করেন যে, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের জন্য আরও একটি গুপ্তঘাঁটি নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়ে গিয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, সে ক্ষেত্রে মার্কিন হামলার আগেই সমৃদ্ধ হওয়া উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ইউরেনিয়াম ওই গুপ্তঘাঁটিতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা তেহরানের বিশেষ আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি।
সূত্রের খবর, বর্তমানে ইরানের হাতে থাকা সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়াম ধ্বংসের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। আলাদা ভাবে বিষয়টির উপরে নজর রাখছে সিআইএ। বিশ্লেষকেরা এ ক্ষেত্রে দু’টি সম্ভাবনার কথা বলেছেন। প্রথমত, দেশের ভিতরে অন্য কোনও গুপ্ত ঘাঁটিতে ওই ইউরেনিয়াম লুকিয়ে রেখেছে তেহরান। নইলে তা সাময়িক ভাবে পাচার করা হয়েছে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানে।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, আগামী দিনে ইরান পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালালে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ যাবে পাকিস্তানের দিকে। সমৃদ্ধকৃত ইউরেনিয়াম মজুত রাখতে বালোচিস্তানকে ব্যবহার করলে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরেই স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে অস্থির হয়ে উঠেছে এই প্রদেশ। অন্য দিকে বিষয়টি জানতে পারলে চুপ করে থাকবে না ইজ়রায়েল। ফলে পশ্চিম এশিয়ার পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।