জঙ্গি হামলার কড়া জবাব আগেও দিয়েছে ভারত। পাকিস্তানি জঙ্গি এবং তাদের ঘাঁটি সাফ করেছে ভারতীয় সেনা। এ বারও তার অন্যথা হল না। ২২ এপ্রিল পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের ১৪ দিন পরে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে জঙ্গি হামলার বদলা নিল ভারত।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে ‘ঘরে ঢুকে’ জঙ্গিঘাঁটি সাফ করা ছাড়া ২০১৬ সালের উরি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, ২০১৯ সালের বালাকোট বিমান হামলা বা অন্যান্য ভারতীয় অভিযানের থেকে চরিত্রগত দিক থেকে অনেকটাই আলাদা ‘অপারেশন সিঁদুর’। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন সমর বিশেষজ্ঞেরা।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর আগের অভিযানগুলি সীমিত পরিসরে পরিচালিত হয়েছিল। কিন্তু ‘অপারেশন সিঁদুর’ প্রযুক্তিগত ভাবে শক্তিশালী, বিস্তৃত এবং ভারত পরিচালিত অন্য অভিযানের থেকে আলাদা।
এর আগের অভিযানগুলিতে মূলত পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী জঙ্গিঘাঁটিগুলিকেই নিশানা করেছিল ভারতীয় বাহিনী। তবে সেই অবস্থান থেকে নয়াদিল্লি যে অনেকটাই সরে এসেছে, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে সেটাই প্রমাণিত হল। কারণ, মঙ্গলবার মধ্যরাতের অভিযানে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের অনেকটা ভিতরে গিয়ে জঙ্গি নিধন করেছে ভারতীয় সেনা।
‘অপারেশন সিঁদুর’ ভারতের দ্বারা পরিচালিত অন্যতম বিস্তৃত আন্তঃসীমান্ত হামলা। এই প্রত্যাঘাতে ভারতের কৌশলগত অবস্থানের একটি বিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই হামলার ফলে জঙ্গিদের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা, তাদের নেটওয়ার্ক এবং তাদের সহযোগীদের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা গিয়েছে। কোনও জায়গাই যে এখন আর ভারতের নাগালের বাইরে নয়, প্রমাণ করা গিয়েছে তা-ও।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের ‘মিনি সুইৎজ়ারল্যান্ড’ হিসাবে পরিচিত সবুজে ঢাকা বৈসরন উপত্যকায় ঘুরতে গিয়ে জঙ্গিহানায় নিহত হন এক দল পর্যটক। হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল চার থেকে ছ’জন। হঠাৎই তারা রাইফেল উঁচিয়ে এলাকা ঘিরে ফেলে পর্যটকদের এক এক করে পরিচয় জানতে শুরু করে। গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় কয়েক জন পর্যটককে।
জঙ্গিদের হাত থেকে বিদেশিরাও রেহাই পাননি। পর্যটকদের অনেককেই পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি করে মারা হয়। পালাতে গিয়ে গুলির শিকার হন অনেকে। শতাধিক রাউন্ড গুলি চালিয়ে জঙ্গলে গা-ঢাকা দেয় জঙ্গিরা। অজ্ঞাত বন্দুকধারীদের গুলিতে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
সেনাকর্তারা পরে নিশ্চিত করেন, বৈসরন উপত্যকায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের দলকে লক্ষ্য করেই হামলাটি চালানো হয়েছিল। ২২ এপ্রিল দুপুরের ওই ঘটনার দায় নিয়েছিল ‘দ্য রেজ়িস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (টিআরএফ)। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের রাজনৈতিক অস্থির পরিস্থিতির আবহে জন্ম হয়েছিল এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। সে সময় পাক জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার ‘ছায়া সংগঠন’ হিসাবে উঠে আসে টিআরএফ।
সেই জঙ্গিহানার প্রত্যাঘাতই ‘অপারেশন সিঁদুর’। তবে বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ‘অপারেশন সিঁদুর’ কেবল প্রতিশোধমূলক শক্তি প্রদর্শন হিসাবে নয়, বরং পাকিস্তানের মাটি থেকে সন্ত্রাসবাদের মদতকারী ভিতকে দুর্বল করার প্রচেষ্টা হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল।
‘অপারেশন সিঁদুর’-এ পাকিস্তান এবং পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ন’টি জঙ্গি পরিকাঠামোয় আঘাত হেনেছে ভারতীয় সেনা। এর মধ্যে রয়েছে মুজফ্ফরাবাদ, কোটলি, বহওয়ালপুর, রাওয়ালকোট, চক্সওয়ারি, ভিম্বার, নীলম উপত্যকা, ঝিলম এবং চকওয়াল। ছোড়া হয়েছে মোট ২৪টি ক্ষেপণাস্ত্র।
রাত ১টা বেজে পাঁচ মিনিটে শুরু হওয়া এই অভিযানের সময়সীমা ছিল ২৫ মিনিট। লশকর-এ-ত্যায়বা ও জইশ-ই-মহম্মদের প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলিই ছিল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর লক্ষ্য।
সরকারি সূত্র জানিয়েছে, ভারতের সমন্বিত আক্রমণে ৭০ জনেরও বেশি জঙ্গি নিহত এবং ৬০ জনেরও বেশি জঙ্গি আহত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছে। হামলা চালানো প্রতিটি জায়গাই নজরদারির অধীনে ছিল।
অভিযানে সফলতা এসেছে উন্নত নির্ভুল অস্ত্রশস্ত্র এবং রিয়্যাল-টাইম গোয়েন্দা তথ্য ব্যবহার করে। এই ঘাঁটিগুলির উল্লেখ বহু বার গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে। সেই তথ্য অনুসন্ধান করে দূরপাল্লার অস্ত্র ব্যবহার করে একযোগে হামলা চালানো হয় মধ্যরাতে।
আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম না করেই বহওয়ালপুর, মুরিদকে, গুলপুর, ভিম্বর, চক আমরু, বাগ, কোটলি, শিয়ালকোট এবং মুজফ্ফরাবাদের ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করা হয়।
পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে যে ইমারতগুলি ধ্বংস করা হয়েছে সেগুলি মূলত জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অস্ত্রাগার এবং বিভিন্ন জঙ্গি পরিকল্পনার ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হত বলেই ভারতের তরফে জানানো হয়েছে।
অভিযান চলাকালীন ভারতীয় বাহিনীর প্রথম নিশানা ছিল শুভান আল্লা মসজিদ। সেখানে লশকর-এ-ত্যায়বার ঘাঁটি এবং প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছিল। বিলাল মসজিদে ছিল জইশ-ই-মহম্মদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র। কোটলিতে যে মসজিদে হামলা হয়েছে, তা লশকরের ঘাঁটি। এই ঘাঁটি পুঞ্চে সক্রিয়। এগুলি পাক অধিকৃত কাশ্মীরে রয়েছে।
এই ধরনের অভিযানের ক্ষেত্রে সাধারণত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। একেবারে নির্ভুল ভাবে দূরপাল্লার লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম এমন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। যে ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্ক্যাল্প ক্রুজ় এবং হ্যামার। স্ক্যাল্প ক্রুজ় ‘স্টর্ম শ্যাডো’ নামেও পরিচিত।