ঠিক যেন সিনেমার টানটান দৃশ্য। হাসপাতালের আইসিইউয়ে ভর্তি রয়েছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সটান রোগীর কেবিনে ঢুকে পর পর গুলি করে হত্যা। পাঁচ দুষ্কৃতী নির্বিঘ্নে খুন করে বুক ফুলিয়ে পালিয়ে গেল সকলের সামনে দিয়েই। বেশ কয়েকটি খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি চন্দন মিশ্রকে বৃহস্পতিবার সকালে পটনার একটি হাসপাতালে ঢুকে খুন করে তাঁরই বিপক্ষ দলের সদস্যেরা।
হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল চন্দনকে। প্যারোলে ছাড়া পেয়েছিলেন তিনি। সেই সুযোগকে কাজে লাগায় চন্দনের বিরোধী গ্যাং শেরু। গ্যাংস্টার ছিলেন চন্দনও। একাধিক খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা ভোগ করছিলেন তিনি।
চন্দনকে বেউর সেন্ট্রাল কারাগারে রাখা হয়েছিল এবং সম্প্রতি চিকিৎসার জন্য ১৫ দিনের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সেইমতো পটনার রাজাবাজারের কাছে এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় চন্দনকে। প্যারোলের মেয়াদ ১৮ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল।
পাঁচ জনের একটি দল দিনের বেলায় হাসপাতালে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে নিয়ে চন্দনের ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করে। পালিয়ে যাওয়ার আগে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় টুপি পরা পাঁচ় জন। সিসিটিভি ফুটেজে এই পাঁচ জন দুষ্কৃতীর ছবি স্পষ্ট ভাবে লক্ষ করা গিয়েছে।
সিসিটিভি থাকার কথা জানা সত্ত্বেও দুষ্কৃতীরা কেউই মুখ লুকোতে চায়নি বলে মনে হয়েছে। হামলার পর প্রকাশিত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে হাতে বন্দুক নিয়ে একে একে পাঁচ জন টুপি পরা তরুণ তিন তলায় উঠে খুন করে কুখ্যাত গ্যাংস্টারকে। হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তারা হেলায় খুন করে আইসিইউতে থাকা রোগীকে।
ফুটেজে ধরা পড়েছে, খুন করার সময় কোনও তাড়াহুড়ো দেখায়নি চন্দনের শত্রুরা। ধীরেসুস্থে করিডর ধরে হেঁটে এসে অস্ত্র বার করে চন্দনের কেবিনের দরজা খুলে ঢোকে। পর পর কয়েক রাউন্ড গুলি চালিয়ে হত্যা করে চন্দনকে। সকাল ৮টা নাগাদ হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ পাঁচ জন অভিযুক্তকে শনাক্ত করেছে বলে জানা গিয়েছে।
চন্দনকে হত্যার জন্য যে দল পাঠানো হয়েছিল সেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সাদা জামা পরা এক যুবক। তৌসিফ বাদশা নামের সেই যুবককে পুলিশ শনাক্ত করেছে। দলের অন্যদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ধীর। ডান হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একেবারে সামনে ছিলেন তৌসিফ নামের সন্দেহভাজন তরুণ। খুনের পর অকুস্থল ছেড়ে বাকিরা তড়িঘড়ি পালালেও তৌসিফ কিছু ক্ষণ পর বেরিয়ে এসে শান্তশিষ্ট ভাবে করিডর ধরে হেঁটে যায়।
গুলির আওয়াজে আতঙ্কে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় হাসপাতালে। সেই সুযোগে ভিড়ে মিশে হাসপাতালের বাইরে বেরিয়ে এসেছিল পাঁচ দুষ্কৃতী। চন্দনকে খুনের পর হাসপাতালের বাইরে বন্দুক উঁচিয়ে তারা উল্লাস করছে, এমন ছবিও পরে প্রকাশ্যে এসেছে। তৌসিফকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকি চার জনের খোঁজ চলছে।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রাথমিক তদন্তে মনে হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডটি দু’টি গ্যাংয়ের মধ্যে রেষারেষির ফল। ইনস্পেক্টর জেনারেল জীতেন্দ্র রানা জানান, দুষ্কৃতীরা খুনের আগে আটঘাট বেঁধে নেমেছিল। চন্দনকে খুনের আগে হাসপাতালে রেকিও করা হয়েছিল বলে ধারণা তাঁদের। তার পরই পরিকল্পনা করে হাসপাতালে ঢুকে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা।
চন্দন সিংহ নামেও পরিচিত ছিলেন চন্দন মিশ্র। তাঁর বিরুদ্ধে ২০টিরও বেশি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। খুন-সহ, ব্যাঙ্ক ও সোনার গয়নার দোকানে ডাকাতির মতো একাধিক মামলায় নাম জড়ায় চন্দনের। তাঁকে একসময়ে ডাকাত সন্তোষ সিংহের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হত।
২০১১ সালে ব্যবসায়ী রাজেন্দ্র কেশরী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয় চন্দনকে। চুন ব্যবসায়ী রাজেন্দ্র তোলাবাজির টাকা দিতে অস্বীকার করলে চন্দন তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘আমি আগামী কাল তোমায় মেরে ফেলব।’’ পরের দিন রাজেন্দ্রর গুলিবিদ্ধ দেহ উদ্ধার হয়। সেই মামলায় যুক্ত হয় চন্দনের নাম।
পরবর্তী কালে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পটনা আদালত সেই সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তন করে। পুলিশ সূত্রে খবর বক্সার জেলার ত্রাস ছিল কুখ্যাত দুষ্কৃতী এই চন্দন।
বক্সার জেলায় এক সময় বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত চন্দনের নামে। তাঁর সঙ্গে অনেকেরই শত্রুতা ছিল। প্যারোলে মুক্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। সেই সুযোগ কাজে লাগায় বিপক্ষ দলের দুষ্কৃতীরা।
পুলিশের মতে, চন্দন এবং শেরু নামে এক গ্যাংস্টারের মধ্যে পুরনো শত্রুতার জেরেই এই হত্যাকাণ্ড। বর্তমানে দুই যুযুধান পক্ষ হলেও একসময়ে চন্দন এবং শেরুর বন্ধুত্ব বিহারের অপরাধজগতে মুখে মুখে ফিরত। বক্সারে রাজত্ব চালানোর জন্য বালিহার গ্রামের দুল্লাপুরের বাসিন্দা ওঙ্কারনাথ সিংহ ওরফে শেরু সিংহের সঙ্গে জোট বাঁধেন চন্দন।
বক্সারে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে চন্দন-শেরু গ্যাং। পশ্চিম বিহার জুড়ে সংগঠিত অপরাধের একটি প্রভাবশালী শক্তি হয়ে ওঠে এই দলটি। এই গ্যাংয়ের কার্যকলাপ পুলিশের নজর কেড়েছিল। চন্দন এবং শেরু দু’জনের মাথার দাম ৫০ হাজার টাকা করে ঘোষণা করেছিল বিহার প্রশাসন।
বখরা ও দলের নেতৃত্ব কে দেবে সেই বিবাদ নিয়ে দু’জনের বন্ধুত্বে চিড় ধরে। পরে চন্দন দল ছেড়ে বেরিয়ে যান এবং স্বাধীন ভাবে অপরাধমূলক কাজকর্ম শুরু করেন। বক্সার, ভাগলপুর এবং পরে পটনার বেউর সেন্ট্রাল জেল-সহ বেশ কয়েকটি জেলে সাজা ভোগ করার পরেও চন্দন সেখানে বসেই সমান্তরাল ভাবে তাঁর ‘সাম্রাজ্য’ পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ। অস্ত্র আইন-সহ দু’ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে চন্দনের বিরুদ্ধে।
বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক আক্রমণও শুরু হয়েছে। আরডেজি নেতা তথা বিহারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী লালু-পুত্র তেজস্বী যাদব বলেন, ‘‘অপরাধীদের নিরাপত্তা দিচ্ছে সরকার। হাসপাতালে দুষ্কৃতীরা ঢুকল, রোগীকে খুন করে আবার চম্পটও দিল! বিহারে কি কেউ আর নিরাপদ? এ ধরনের ঘটনা আরজেডির শাসনকালে কেউ দেখেছেন?’’