‘ঈশ্বরের নিজের রাজ্যে’ ঘনাচ্ছে সঙ্কট। সেখানকার আমজনতা বেশ বড়লোক। কিন্তু, সরকারের ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা! ফলে দিন দিন কমছে উন্নয়নমূলক কর্মসূচি। উল্টে বাড়ছে ঋণের বোঝা। এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরাও। এতে দেশের অর্থনীতির উপর বড় রকমের চাপ পড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।
সম্প্রতি কেরলের আর্থিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘গুলাটি ইনস্টিটিউট অফ ফিন্যান্স অ্যান্ড ট্যাক্সেশন’ নামের একটি সংস্থা। সেখানেই দক্ষিণী রাজ্যটির বাসিন্দাদের ধনী এবং সেখানকার সরকারকে দরিদ্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি তথ্যও এই রিপোর্টকে মান্যতা দিচ্ছে। এর নেপথ্যে একাধিক কারণ খুঁজে বার করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
গুলাটির গবেষণা অনুযায়ী, কেরলের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিএসডিপি) জাতীয় মাথাপিছু জিডিপির অন্তত ১.৬ গুণ। কিন্তু সেখানকার করে জিএসডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে প্রবল অসঙ্গতি রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক সুরক্ষা খাতে ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলির মতো খরচ করে এই দক্ষিণী রাজ্য। কিন্তু কেরল সরকারের কর বাবদ আয় আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলির থেকেও কম।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (আরবিআই) রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে কেরলের জিএসডিপির বার্ষিক গড় মাত্র ৩.৬ শতাংশে ঘোরাফেরা করেছে। এর পিছনে রয়েছে দেশের মাত্র তিনটি রাজ্য। কোভিড অতিমারি কেটে যাওয়ার পর ২০২২-’২৩ আর্থিক বছরে কেরলের আর্থিক বৃদ্ধির হার এক লাফে বেড়ে ১৩ শতাংশে পৌঁছে যায়।
কিন্তু আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, সূচকের এই দৌড় দেখে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। কারণ, কোভিড অতিমারির সময়ে অর্থনীতি একেবারে থমকে গিয়েছিল। ফলে ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে সূচকের এই ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। কিন্তু পরের আর্থিক বছরে সেটা নেমে ছ’শতাংশে চলে আসে। কেরল সরকারের আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার প্রথম কারণ হিসাবে ভর্তুকি অর্থনীতিকে দায়ী করেছেন তাঁরা।
কেরলে মূলত দু’টি জোটকে বার বার ক্ষমতায় আসতে দেখা গিয়েছে। তার মধ্যে একটি হল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউডিএফ)। অপরটির নাম লেফ্ট ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এলডিএফ), যাতে রয়েছে অধিকাংশ বাম দল। দু’টি জোটই জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে সামাজিক সুরক্ষায় জোর দিয়েছে। সেই কর্মসূচি চালিয়ে নিয়ে যেতে বাজেটের বাইরে ঋণ (অফ বাজেট বরোয়িং) করতেও পিছপা হয়নি দক্ষিণী রাজ্যটির সরকার।
গত শতাব্দীর ৭০ ও ৮০-র দশক থেকে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে বিপুল খরচ করে এসেছে কেরল। এর পুরোটাই হয়েছে সরকারি আনুকূল্যে। কিন্তু এর ফলে কর্মচারীর সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণী রাজ্যটির খরচ বেড়ে যায় বহু গুণ। বর্তমানে পেনশন খাতে সর্বাধিক খরচের তালিকায় থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে পঞ্চম স্থানে রয়েছে কেরল। ২০২৩-’২৪ আর্থিক বছরে এতে দক্ষিণী রাজ্যটির ব্যয়ের অঙ্ক ছিল ২৮ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-’২৩ অর্থবর্ষে কেরলের রাজস্ব খাতে খরচের পরিমাণ ছিল ১.৪২ লক্ষ কোটি টাকা। সেখানে মাত্র ১৪ হাজার কোটি টাকা মূলধনী ব্যয় ছিল এই দক্ষিণী রাজ্যের। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, রাজস্বের ৯০ শতাংশই সরকারের দৈনন্দিন খরচ, ভর্তুকি এবং ঋণের পিছনে দিয়ে চলেছে কেরল সরকার। তাদের দীর্ঘমেয়াদি আয়ের কোনও পরিকল্পনা নেই।
নীতি আয়োগের রাজস্ব ঘাটতির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২-’২৩ আর্থিক বছরে মূলধনী ব্যয় মোট খরচের মাত্র ৮.৮ শতাংশ ধার্য করে কেরল সরকার। দেশের অন্য রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এটি ছিল ১৫.২ শতাংশ। গত অর্থবর্ষের (পড়ুন ২০২৪-’২৫) বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-পেনশন, ভর্তুকি এবং আগের ঋণের টাকা মেটাতে বিপুল ব্যয় বরাদ্দ করে পিনারাই বিজয়নের মন্ত্রিসভা।
কিছু দিন আগে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের নজরে আনে কেন্দ্র। আদালতকে নরেন্দ্র মোদী সরকার জানিয়েছে, ঋণের সুদ মেটাতে সরকারি আয়ের প্রায় ২০ শতাংশ অর্থ খরচ করছে কেরল প্রশাসন। আইন মোতাবেক এই পরিমাণ কখনওই ১০ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। ২০২২ সালে বিজয়ন সরকারের বাজেট-বহির্ভূত ঋণ নেওয়া বন্ধ করতে কড়া আইন প্রয়োগ করে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় এই দক্ষিণী রাজ্য।
দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতার পর থেকে শিল্পবান্ধব নীতি তৈরি করতে ব্যর্থ হয় কেরল সরকার। উল্টে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু শিল্প সংস্থা এই রাজ্য ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। ফলে শিক্ষার হার ৯৬ শতাংশ হলেও সেখানে বেকারত্বের হার বেশি। সরকারি তথ্য বলছে, গুজরাত যেখানে যুবক-যুবতীদের জন্য পাঁচ থেকে ছ’লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম, সেখানে কেরল দাঁড়িয়ে রয়েছে ৫২ হাজারে।
‘ঈশ্বরের নিজের রাজ্যে’ বেকারত্বের হার প্রায় ৩০ শতাংশ। সারা ভারতের নিরিখে এটি প্রায় তিন গুণ বেশি। কেরলের ৪৭ শতাংশ মহিলা কোনও চাকরি বা ব্যবসা করেন না। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এর জেরে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্ট বা এফডিআই) দক্ষিণী রাজ্যটিতে আসে অনেক কম।
২০২১ সালে কেরলে লগ্নি হওয়া এফডিআই ইকুইটির পরিমাণ ছিল ৩১ কোটি ৭ লক্ষ ডলার। সারা দেশের নিরিখে অঙ্কটা মাত্র ০.০৫ শতাংশ। ওই বছর এফডিআই ইকুইটি বাবদ কর্নাটকে লগ্নির পরিমাণ ছিল ১,৮৫০ কোটি ডলার, যা কেরলের থেকে ৬০ গুণ বেশি। গুজরাত এবং তামিলনাড়ুতে বিনিয়োগ পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৭০ কোটি এবং ৩০০ কোটি ডলার।
কেরলে বামেরা শক্তিশালী হওয়ায় সেখানকার শ্রমিক সংগঠনগুলি খুবই শক্তিশালী। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁদের আন্দোলনকে ‘জঙ্গি’ তকমা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন দেশের তাবড় শিল্পপতিরা। দক্ষিণী রাজ্যটিতে লগ্নির থেকে তাঁদের মুখ ফিরিয়ে থাকার এটা অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তিন বছরে ২০টির বেশি শিল্প ধর্মঘট দেখেছে কেরল। এর ফলে দক্ষিণী রাজ্যটিতে নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণে শ্রম দিবস। শ্রমিক সংগঠনগুলির ‘জঙ্গি’ আন্দোলনের জেরে নতুন শিল্প কেরলে আসছে না বলে জানিয়েছেন সমীক্ষকেরা।
এ ছাড়া নতুন শিল্প টেনে রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য ঠিক করার ক্ষেত্রে আরও একটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে বিজয়ন সরকারের সামনে। দক্ষিণী রাজ্যটির প্রায় ৫৫ শতাংশ এলাকায় রয়েছে ঘন জঙ্গল। বাকি প্রায় ৪৭ শতাংশ এলাকা আবার অতিরিক্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে শিল্পের জন্য সরকারের পক্ষে জমি অধিগ্রহণ করা বেশ কঠিন।
কেরলে যে একেবারেই শিল্প পার্ক নেই, তা নয়। কিন্তু, কর্নাটক বা গুজরাতের মতো বিশাল এলাকা জুড়ে ভারী শিল্পের এলাকা গড়ে তুলতে পারেনি সেখানকার সরকার। অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় জমির দাম কেরলে বেশি। শিল্পপতিদের সেখানে যাওয়ার অনীহার এটাও অন্যতম প্রধান কারণ।
কেরলের শিল্পক্ষেত্র দেশের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। ফলে কর বাবদ সরকারের মোট আয়ের মাত্র ২২ শতাংশ আসে সেখান থেকে। রাজ্যটির আর্থিক স্বাস্থ্য খারাপের জন্য একেও দায়ী করেছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক।