দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০ বছর পার। গত আট দশকে অনেকটাই বদলে গিয়েছে বিশ্বের মানচিত্র। পুরনো সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়ে জন্ম হয়েছে একগুচ্ছ নতুন রাষ্ট্রের। কেউ কেউ আবার ঔপনিবেশিকতার জাল কেটে পেয়েছে স্বাধীনতা। পাশাপাশি, এখনও কিছু দেশ বিস্তারবাদী নীতিকে আঁকড়ে আছে। তাদের আক্রমণে ক্রমাগত বদলাচ্ছে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র।
১৯৪৫ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পৃথিবী জুড়ে ওঠে স্বাধীনতার আওয়াজ। ওই সময়ে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো ইউরোপের দেশগুলির ছিল সবচেয়ে বড় উপনিবেশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিরাট সাম্রাজ্য তৈরি করে জাপান। কিন্তু, লড়াই থামার তিন থেকে চার বছরের মধ্যেই সে সব ভেঙে পড়ে। ফলে এশিয়া এবং আফ্রিকায় জন্ম হয় একগুচ্ছ নতুন রাষ্ট্রের।
বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় রাতারাতি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় জার্মান সাম্রাজ্য। শুধু তা-ই নয়, লড়াই পরবর্তী সময়ে দু’টি ভাগে বিভক্ত করা হয় জার্মানিকে। অন্য দিকে, পূর্ব ইউরোপে একাধিক দেশকে সঙ্গে নিয়ে সীমানা সম্প্রসারণ করে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া। এতে ব্যাপক ভাবে বদলে যায় ইউরোপের মানচিত্র।
কিন্তু, ১৯৯১ সালে সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হলে জন্ম হয় ১৫টি নতুন রাষ্ট্রের। পূর্ব ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া মাইনর পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে সেই সমস্ত দেশ। অন্য দিকে, ১৯৯০ সালে দু’টি অংশ জুড়ে গিয়ে ফের আত্মপ্রকাশ করে অবিভক্ত জার্মানি। ফলে আবারও রাজনৈতিক চালচিত্র বদলায় ইউরোপের।
২১ শতকের গোড়ার দিকে বিশ্ব মানচিত্রের তেমন কোনও পরিবর্তন অবশ্য লক্ষ করা যায়নি। কিন্তু, গত এক দশকে ফের দ্রুত গতিতে বদলাতে শুরু করেছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সীমা। ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া ছিনিয়ে নেয় রাশিয়া। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ফের এই প্রতিবেশী দেশটিকে আক্রমণ করে মস্কো, যার জেরে গত তিন বছর ধরে পূর্ব ইউরোপে চলছে যুদ্ধ।
ইউক্রেনের ডোনেৎস্ক ও লুহানস্ক এলাকা (যাদের একত্রে ডনবাস বলা হয়) এবং খেরসন এবং জ়াপোরিজায়া ইতিমধ্যেই দখল করেছে রুশ ফৌজ। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সেখানে গণভোটের আয়োজন করে মস্কো। নির্বাচনের ফলাফল ক্রেমলিনের পক্ষে যাওয়ায় ওই ভূখণ্ডকে নিজের দেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে ডনবাস, খেরসন ও জ়াপোরিজায়া মিলিয়ে ইউক্রেনের ১৫ শতাংশ জমি দখল করেছিল মস্কো। গত তিন বছরে সেই পরিমাণ আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। অন্য দিকে সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ার কুর্স্ক এলাকার ভিতরে ঢুকে হামলা চালিয়েছে ইউক্রেনীয় সেনা। ওই রুশ জমির কিছুটা দখলে রয়েছে কিভের। কুর্স্ক পুনরুদ্ধার করতে উত্তর কোরিয়ার সেনাকে সঙ্গে নিয়ে প্রত্যাঘাত শানাচ্ছে মস্কো।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে পূর্ব ইউরোপের মানচিত্র যে অনেকটা বদলে যাবে তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি, মানচিত্র বদলাচ্ছে মধ্য এশিয়ার আর্মেনিয়া এবং আজ়ারবাইজানেরও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এই দুই দেশই ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার অংশ। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে গেলে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তারা।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা স্বশাসিত নাগোর্নো-কারাবাখ আক্রমণ করে আজ়ারবাইজান। ৪৪ দিনের যুদ্ধে পরাজয় হয় আর্মেনীয় বাহিনীর। ফলে নাগোর্নো-কারাবাখ চলে যায় বাকুর দখলে। মধ্য এশিয়ার মানচিত্রের বদল এখানেই থামবে বলে ভাবলে, ভুল করা হবে। কারণ, দুই দেশের সংঘর্ষের আরও একটি জায়গা রয়েছে। তার নাম নাখচিভান।
আজ়ারবাইজানের মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা আর্মেনিয়া সংলগ্ন এই নাখচিভানেও রয়েছে নাগোর্নো-কারাবাখের মতোই স্বশাসিত সরকার। ২০২০ সালের যুদ্ধের প্রতিশোধ নিতে সেখানে যখন-তখন হামলা চালাতে পারে আর্মেনিয়া। এই আশঙ্কা করেই নাখচিভান পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে বাকু। লাইন অবশ্য আর্মেনীয় ভূখণ্ডের উপর দিয়েই নিয়ে যেতে হবে। ফলে যে কোনও সময়ে বাধতে পারে যুদ্ধ।
আর্মেনিয়ার পিছনে রয়েছে ইরান ও রাশিয়ার সমর্থন। অন্য দিকে তুরস্ক এবং ইজ়রায়েলের সাহায্য পাচ্ছে আজ়ারবাইজান। ফলে ককেসাস এলাকার যুদ্ধ এশিয়া মাইনর ছাড়িয়ে মহাদেশটির পশ্চিম অংশ তথা আরব ভূখণ্ডে ছড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে যে সেখানকার মানচিত্রে বদল ঘটবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
গত বছরের ডিসেম্বর দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী জইশ আল-ইজ্জার যৌথবাহিনী সিরিয়া থেকে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাত করে। রাজধানী দামাস্কাস চলে যায় তাঁদের দখলে। প্রাণ বাঁচাতে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন আসাদ।
সিরিয়ায় লম্বা সময় ধরে চলেছে গৃহযুদ্ধ। বাশার সরকারের পতনে সেই লড়াই থামলেও দেশ বিভাজনের প্রবল আশঙ্কার কথা বলেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, সিরিয়ার একাংশ এখনও রয়েছে কুর্দ বিদ্রোহীদের কব্জায়। সেখানে একরকম স্বাধীন সরকারই চালাচ্ছেন তাঁরা। কিছু অংশ আবার তুরস্ক মদতপুষ্ট বিদ্রোহীরা দখল করে রেখেছেন। সেই ভূখণ্ড আঙ্কারার সঙ্গে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসের থেকে গোলান মালভূমির (গোলান হাইট্স নামে পরিচিত) দূরত্ব মেরেকেটে ৬০ থেকে ৭০ কিলোমিটার। ওই মালভূমি এলাকাটি রয়েছে ইজ়রায়েলের কব্জায়। বিদ্রোহীদের হাতে আসাদ সরকারের পতন হতেই গোলান মালভূমির দিক থেকে সিরিয়ার জমি দখল করার নির্দেশ দেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। দামাস্কাস দখল হলে কলেবরে বৃদ্ধি পাবে ইহুদি রাষ্ট্র।
১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর গোলান মালভূমিতে সিরিয়া ও ইজ়রায়েল সীমান্তে বাফার জ়োন তৈরি করা হয়। বাশার সরকারের পতনের পর সেই জায়গা চলে গিয়েছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্সের (আইডিএফ) কব্জায়। কাতারের সংবাদ সংস্থা আল জ়াজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাফার জ়োন পেরিয়ে সিরিয়ার ভিতরে ২৪ কিলোমিটার ঢুকে গিয়েছে ইহুদি ফৌজ।
২০২৩ সালে প্যালেস্টাইনের গাজ়া ভূখণ্ড থেকে ইজ়রায়েলের উপর হামলা চালায় ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ওই ঘটনার জেরে যুদ্ধে নামে আইডিএফ। প্রায় এক বছরের বেশি সময় লড়াই চলার পর সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হয়েছে দুই পক্ষ। এই আবহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপে সেখানকার মানচিত্রের বদল হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজ়া। ভূমধ্যসাগরের তীরের এলাকাটিকে নতুন করে সাজিয়ে তুলতে প্রবল আগ্রহী ট্রাম্প। আর তাই সেখানকার প্যালেস্তিনীয়দের অন্যত্র সরে যাওয়ার কথা বলেছেন তিনি। ট্রাম্পের ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলে গাজ়া থেকে পুরোপুরি মুছে যাবে হামাস। শুধু তা-ই নয়, সরু একফালি ভূখণ্ডটির ইজ়রায়েল বা আমেরিকার অংশ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনাও রয়েছে।
১৯৬১ সালে একসঙ্গে স্বাধীনতা পায় ‘আফ্রিকার সিং’ (পড়ুন হর্ন অফ আফ্রিকা) এলাকার দু’টি দেশ। একটি হল, সোমালিল্যান্ড এবং অপরটি সোমালিয়া। কিছু দিনের সঙ্গেই একসঙ্গে জুড়ে যায় তারা। কিন্তু, ১৯৯১ সাল থেকে পৃথক জাতিগোষ্ঠীর কারণে দুই এলাকার মধ্যে শুরু হয় মতবিরোধ। সেই থেকে সোমালিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে সোমালিল্যান্ড।
গত বছরের ডিসেম্বরে গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মায়ানমারের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকার রাখাইন রাজ্য চলে যায় বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে। ওই এলাকাটিকে কেন্দ্র করে নতুন রাষ্ট্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া পাকিস্তান ভেঙে তৈরি হতে পারে পাশতুনিস্তান ও বালুচিস্তান।
গত দু’-তিন দশকে ইউরোপেও তৈরি হয়েছে একাধিক দেশ। উদাহরণ হিসাবে চেকোস্লোভাকিয়া ও যুগোস্লাভিয়ার কথা বলা যেতে পারে। এগুলি ভেঙে তৈরি হয়েছে দুই থেকে তিনটি রাষ্ট্র। আগামী দিনে বিশ্ব মানচিত্র আরও বদলাবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।