কখনও তাজমহল। কখনও আবার লালকেল্লা বা রাষ্ট্রপতি ভবন। ঐতিহ্যশালী এই সমস্ত স্মৃতিসৌধ বা প্রাসাদকে নিয়ে প্রতারণার অভিযোগে বার বার খবরের শিরোনামে এসেছেন মিথিলেশ কুমার শ্রীবাস্তব ওরফে নটবরলাল। কথার জালে ফাঁসিয়ে মোটা টাকার বিনিময়ে অবলীলায় এ সব বিক্রি করে নিমেষে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর।
নটবরলালকে ভারতীয় প্রতারকদের ‘গুরুদেব’ বললে অত্যুক্তি হবে না। এক জীবনে কী করেননি তিনি? জেল ভেঙে পালানো থেকে শুরু করে সংসদ ভবন ‘বিক্রি’! শেষ পর্যন্ত কিন্তু তাঁর টিকিটি ছুঁতে পারেননি দুঁদে পুলিশকর্তারা। এ হেন নটবরের জন্মের প্রায় ১০০ বছর আগে সুদূর আটলান্টিকের পারের দ্বীপরাষ্ট্রে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন আর এক প্রতারক। তাঁকে ঠগদের ‘ঠাকুরদা’ বললে অত্যুক্তি হবে না।
প্রতারক কুলের ‘মহাপুরুষ’ এই ব্যক্তির নাম গ্রেগর ম্যাকগ্রেগর। জাতে তিনি ছিলেন খাঁটি স্কটিশ। ১৮ শতকে স্টার্লিংশায়ার কাউন্টিতে বড়দিনের প্রাক্-মুহূর্তে (১৭৮৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর) জন্ম হয় তাঁর। গ্রেগরের বাবা ড্যানিয়েল ছিলেন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজের ক্যাপ্টেন। তাঁর মাকে সবাই ডাকতেন অ্যান নামে। গ্রেগরদের পরিবার ছিল ধর্মপ্রাণ রোমান ক্যাথলিক।
১৮০৩ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসাবে যোগ দেন কিশোর ম্যাকগ্রেগর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫-১৬। ১৮০৭ সালে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট স্পেন আক্রমণ করলে ইউরোপে বেধে যায় উপদ্বীপের যুদ্ধ। এই লড়াই পরবর্তী কালে বদলে যায় স্পেনের স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং তা চলে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত। নেপোলিয়নকে ঠেকাতে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ব্রিটেনও।
উপদ্বীপের যুদ্ধ শুরু হতেই বাহিনী নিয়ে রণাঙ্গনে ছুটে যান গ্রেগর। ১৮১০ সাল পর্যন্ত এতে নেতৃত্ব দেন তিনি। ওই বছরই ভেনেজুয়েলার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপ ছেড়ে ল্যাটিন আমেরিকা যাত্রা করেন ম্যাগগ্রেগর। ১৮১২ সালে সেখানকার বিপ্লবীদের হয়ে অস্ত্র ধরেন তিনি। অসীম সাহসিকতার জন্য বাহিনীতে দ্রুত পদোন্নতিও হয় তাঁর। অল্প দিনের মধ্যেই জেনারেলের পদ পেয়ে যান তিনি।
ফৌজে জেনারেল পদ পাওয়ার পর ভেনেজুয়েলা এবং এর প্রতিবেশী নিউ গ্রানাডার হয়ে টানা চার বছর স্পেনীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান গ্রেগর। রণক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য নেহাত কম নয়। এর মধ্যে অবশ্যই বলতে হবে ১৮১৬ সালের কথা। সে বছর উত্তর ভেনেজুয়েলায় এক মাসের বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে শত্রুদের পর্যুদস্ত করেন এই স্কটিশ সেনাকর্তা।
১৮১৭ সালে স্পেনীয়দের থেকে অ্যামেলিয়া দ্বীপ দখল করেন গ্রেগর। ওই সময়ে ফ্লোরিডা আক্রমণের জন্য ক্রমাগত বিপ্লবীদের উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ফ্লোরিডায় অস্থায়ী একটি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেও সক্ষম হন স্কটিশ জেনারেল ম্যাকগ্রেগর। ১৮১৯ সালে নিউ গ্রানাডায় দু’টি অভিযান পরিচালনা করেন তিনি। এর পরবর্তী সময়ে বাহিনী ত্যাগ করে দেশে ফিরে যান জেনারেল গ্রেগর।
সৈনিক জীবনে ইতি পড়তেই প্রতারণার জাল বোনা শুরু করেন বহু যুদ্ধের বীর সৈনিক ম্যাকগ্রেগর। ১৮২১ সালে ব্রিটেনে ফিরে আসেন তিনি। এর পরই চমৎকার একটি গল্প ফেঁদে বসেন স্কটিশ জেনারেল। সকলে তাঁর কথা বেদবাক্য বলে বিশ্বাসও করে নিয়েছিলেন। ফলে কয়েকশো ইংরেজকে ঠকাতে তাঁর তেমন অসুবিধা হয়নি।
গ্রেগর দাবি করেন, তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে হন্ডুরাস উপসাগরের মাশা উপকূলের রাজা জর্জ ফ্রেডরিক অগাস্টাস ৮০ লক্ষ একর জমি দান করেছেন। ফ্রেডরিকের ইচ্ছা, সেখানে গড়ে উঠুক ব্রিটিশ উপনিবেশ, যার শাসনভার নিজের কাঁধেই রাখতে চাইছেন তিনি। ওই এলাকার উন্নয়ন এবং শাসনের জন্য তাঁকেই ‘কাজ়িক’ বা রাজপুত্র নিযুক্ত করেছেন রাজা জর্জ।
ইউরোপ এবং ল্যাটিন আমেরিকা ফেরত সাবেক জেনারেলের এই গল্প সেই সময়ে ব্রিটিশ অভিজাতদের প্রায় কেউই অবিশ্বাস করেননি। করার উপায়ও ছিল না। কারণ নিজের কাহিনির সত্যতা প্রমাণ করতে বেশ কয়েকটি জিনিস দাখিল করেন গ্রেগর। তার মধ্যে ছিল সরকারি নথি, জমির অনুদান, মানচিত্র এবং পতাকা।
এখানেই শেষ নয়। রাজা ফ্রেডরিকের দেওয়া জমিতে ‘পোয়াইস’ নামের একটি দেশ গড়ে উঠছে বলে রটিয়ে দেন ম্যাকগ্রেগর। প্রধান হিসাবে নিজের নামে সরকারি বন্ড ইস্যু করতেও শুরু করেন তিনি। তাঁর কথার মায়াজালে আকৃষ্ট হয়ে রাতারাতি সেই বন্ড কিনে ফেলেন ব্রিটিশ অভিজাতদের একাংশ। ফলে পাউন্ডের মোটা গোছা পকেটে চলে আসে তাঁর।
এর কিছু দিন পর পোয়াইস মুদ্রা চালু করেন সাবেক জেনারেল গ্রেগর। যে ব্রিটিশ অভিজাতেরা তাঁর শাসন করা জমিতে বাস করতে আসবেন, তাঁদের ওই মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে বলে জানিয়ে দেন তিনি। ফলে ম্যাকগ্রেগরের কল্পিত দেশে পাড়ি দেওয়ার জন্য রীতিমতো পাগল হয়ে ওঠেন ব্রিটিশ অভিজাতেরা।
১৮২২ সালে ইংল্যান্ড থেকে হন্ডুরাস উপসাগরের দিকে যাত্রা করে বেশ কয়েকটি জাহাজ। সেগুলিতে চড়ে বসা ব্রিটিশ অভিজাতদের প্রত্যেকেরই গন্তব্য ছিল কল্পিত দেশ ‘পোয়াইস’। গ্রেগর কিন্তু তাঁদের সঙ্গে যাত্রা করেননি। নির্ধারিত সময়ে সকলের সঙ্গে দেখা হবে বলে মৌখিক আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু গ্রেগরের বলে দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে সকলের চোখ কপালে ওঠে। সুন্দর চাষযোগ্য একরের পর একর জমির বদলে মরভূমির মধ্যে গিয়ে পড়েন তাঁরা। ব্রিটিশ অভিজাতেরা বুঝতে পারেন তাঁদের এক রকম পথে বসিয়েছেন সাবেক জেনারেল। ফলে ঠগ-জোচ্চর গ্রেগরকে ধরে উচিত শিক্ষা দিতে ফের জাহাজের দিকে দৌড় লাগান তাঁরা।
তবে গ্রেগরের কল্পিত দেশ ‘পোয়াইস’ থেকে ইংল্যান্ডে ফেরা মোটেও সহজ হয়নি। যত জন সেখানে গিয়েছিলেন, তার মধ্যে মাত্র ৫০ জনই প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন। কারণ, ফেরার পথে উদ্ধারকারী জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতে হয় তাঁদের। এর জেরে ম্যালেরিয়া, অপুষ্টি এবং হলুদ জ্বরে প্রাণ হারান অভিযাত্রী দলের বহু সদস্য।
১৮২৩ সালে অভিযাত্রীরা ফিরে এলে গ্রেগরের প্রতারণার খবর ফলাও করে ছাপাতে থাকে একাধিক ব্রিটিশ সংবাদ সংস্থা। সেখানে লেখা হয়েছিল, অভিজাতদের মধ্যে এক একটি বন্ড দু’লক্ষ পাউন্ডে বিক্রি করেছেন তিনি। এ ছাড়া ৫৪০ একর পর্যন্ত জমির বিজ্ঞাপন দিয়ে অনেককে আকৃষ্ট করেন ম্যাকগ্রেগর। এই জমিকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে বিক্রির নামেও টাকা তুলেছিলেন তিনি।
এত কিছুর পরেও গ্রেগরকে কখনই বিচারের আওতায় আনা হয়নি। উল্টে অভিজাতদের সমুদ্রযাত্রার অনুমতি কে বা কারা দিলেন, সেই নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। তবে পরিস্থিতি বেগতিক হতে পারে আঁচ করে ১৮২৩ সালে ফ্রান্সে পালিয়ে যান ম্যাকগ্রেগর।
ফ্রান্সে গিয়েও প্রতারণার ব্যবসা ছাড়েননি গ্রেগর। সেখানে নথি জাল করে ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়া শুরু করেন তিনি। প্যারিসের অভিজাত মহলেও ‘পোয়াইস’-এর গল্প ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন ম্যাকগ্রেগর। কিন্তু এ বার আর সফল হননি তিনি।
১৮২৬ সালে গ্রেগরকে গ্রেফতার করে ফরাসি পুলিশ। জালিয়াতির অভিযোগে ধরা পড়েন তাঁর দুই শাগরেদও। ফলে কিছু দিনের জন্য বিচারাধীন বন্দির জীবন কাটাতে বাধ্য হন এই সাবেক স্কটিশ জেনারেল। বিচারে ম্যাকগ্রেগর বেকসুর খালাস পেলেও তাঁর এক সঙ্গীকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। বাকি জীবনটা তাঁকে জেলের অন্ধকারেই কাটাতে হয়েছিল।
১৮৩৮ সালে ইউরোপের পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে ভেনেজুয়েলায় চলে যান গ্রেগর ম্যাকগ্রেগর। সেখানে বীরের সম্মান পান তিনি। ১৮৪৫ সালে রাজধানী কারাকাসে মৃত্যু হয় তাঁর। সেখানকার একটি ক্যাথিড্রালে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।
সারা জীবনে জালিয়াতি থেকে গ্রেগর মোট কত অর্থ উপার্জন করেছিলেন, তা জানা যায়নি। বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক কোটি ডলারের সম্পত্তি করতে পেরেছিলেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা এর জন্য কখনও সম্মানহানি হয়নি তাঁর। জীবনের শেষ ২০ বছর রাজার হালে ছিলেন এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা সাবেক সেনাপ্রধান।