চাকরি নেই, কিন্তু অফিস রয়েছে। রয়েছে ১০টা-৫টা কাজের সময়সীমাও। রোজ সকালে উঠে ধোপদুরস্ত পোশাক পরে অফিসে আসা যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সুসজ্জিত ডেস্কও। রয়েছে ‘কাজ’ শেষ করে বাড়ি ফেরার তাড়াও। শুধু নেই কাজের দায়িত্ব ও বেতন। বিষয়টি শুনতে কেমন একটা খাপছাড়া বলে মনে হলেও এটাই বাস্তব।
চাকরি না পেয়ে হাজার হাজার চিনা তরুণ-তরুণী কাজের ভান করে প্রতি দিন অফিস দৌড়োচ্ছেন। নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে ‘অফিস-অফিস’ খেলায় মেতেছে চিনের তরুণ প্রজন্ম। পড়শি এই দেশে ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে কাজের বাজার। সে দেশের কর্মক্ষম তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ১৪ শতাংশের হাতে কোনও চাকরি নেই বলে একটি সংবাদ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ৩০ বছর বয়সি শুই ঝো (নাম পরিবর্তিত) সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত একটি ডেস্কে বসে চা পান করেন। ‘সহকর্মীদের’ সঙ্গে আড্ডাও দেন। কখনও কখনও ‘ম্যানেজার’ চলে যাওয়ার পরেও দেরি করে ‘অফিস’ থেকে বার হন। কিন্তু এখানেই গল্পের আসল মোচড়। আসলে সেখানে শুই কোনও কাজই করেন না। অফিসে আসার ভানটুকু করেন মাত্র।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিনের বেকার যুবক-যুবতীরা ভুয়ো অফিসে ‘কাজ’ করার ভান করার জন্য টাকা খরচ করেন। সেই অফিসে ডেস্ক, কম্পিউটার, মিটিং রুম, ওয়াই-ফাই, এমনকি খাবার দেওয়ার মতো বন্দোবস্ত করা হয়। কিন্তু এই অফিসে নেই কোনও বস্, নেই কোনও নিয়োগকর্তা, কাজের দায়িত্ব বা বেতন। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের চাকরিরই কোনও অস্তিত্ব নেই।
যাঁরা এই ধরনের ‘অফিস’ করেন, তাঁরা নিজেদের ল্যাপটপ নিয়ে আসেন। ডেস্কে বসে চাকরির জন্য আবেদন করেন। কখনও কখনও আবার ছোট ছোট কাজ খুঁজে নেন।
বেজিঙের মন্থর অর্থনীতি ও বেকারত্বের সংখ্যাবৃদ্ধির যোগফল এই ভুয়ো চাকরির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি। ক্রমশ এই প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। মূলত সামাজিক চাপ, আত্মসম্মান রক্ষা এবং পরিবার বা সমাজের চোখে নিজেকে বেকার প্রমাণ না করার অভিপ্রায়ে এই পন্থা বেছে নিতে এক প্রকার বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
এক তরুণী তাঁর সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্টের জন্য একটি সংস্থায় মাত্র এক দিন ‘কাজ’ করেছিলেন। তিনি ভাড়া করা একটি সংস্থায় গিয়ে ডেস্কে বসে একটি নিজস্বী তুলেছিলেন। সেই ছবি তাঁর মাকে পাঠিয়েছিলেন যাতে তাঁর মা পরিবারকে দেখাতে পারেন যে মেয়ে একটি উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পেয়েছে।
একই পথের পথিক হয়েছেন ২৫ বছর বয়সি রায়ান। সাংহাইয়ের উত্তরে জিয়াংসু প্রদেশে একটি ভুয়ো ও ভাড়াটে প্রতিষ্ঠানে ছ’মাস ধরে কাজের ভান করছিলেন তিনি। রায়ান জানান, ১৮ মাস আগে স্নাতক হলেও তিনি চাকরি খুঁজে পাননি। প্রতি দিন অফিসে এসে ছবি তুলতেন ও সেগুলি বাবা-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। প্রতি দিন আট ঘণ্টা কাজ করার ভান করা তাঁকে নিরাপত্তার অনুভূতি দেয় বলে জানান রায়ান।
শেনজেন, সাংহাই, নানজিং, উহান, চেংডু ও কুনমিংয়ের মতো শহরে ছড়িয়ে পড়ছে নকল অফিস। চাকরি না পাওয়া হতাশ প্রজন্মের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে রমরমিয়ে ব্যবসা করছে সংস্থাগুলি। প্রতি দিন প্রায় ৩৭০ থেকে ৬০০ টাকা করে দিলে এখানে অফিসের পরিবেশ পাওয়া যায়।
এক একটি অফিসে ৫-১০ জন করে ‘সহকর্মী’ পাওয়া যায়। তাঁরাও টাকা দিয়ে এই পরিষেবা নিতে আসেন। ‘অফিসে’ আসা ও যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট সময় নেই। যখন খুশি আসতে এবং চলে যেতে পারেন ‘কর্মী’রা। সাধারণত সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে অফিসে যান ‘কর্মী’রা। কেউ কেউ আবার রাত ১১টার আগে অফিস থেকে বার হতে চান না।
দুপুরের খাবার এবং পানীয়ের ব্যবস্থা থাকে নকল অফিসগুলোতে। অনেকেই এই ব্যবস্থায় খুশি। তাঁরা জানিয়েছেন, মনে হয় সকলে একসঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করছি। অবসর সময়ে তাঁরা আড্ডা দেন, মজা করেন এবং গেম খেলে সময় কাটান। প্রায়শই ‘কাজের’ পরে একসঙ্গে রাতের খাবারও খেতে চলে যান কেউ কেউ।
‘প্রিটেন্ড টু ওয়ার্ক’ নামের সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ফেইইউ বিবিসিকে জানিয়েছেন, তিনি শুধুমাত্র একটি অফিস ডেস্ক বিক্রি করছেন এমনটা নয়। তিনি এই ব্যবসার মাধ্যমে একটি মানুষের সম্মান বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ করে দিচ্ছেন বলে দাবি করেছেন। কোভিডের পর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তিনি নিজেও বেকার হয়ে পড়েছিলেন।
কোভিড অতিমারি থেকেই চিনে চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হয়ে আসার ফলে বেকারত্ব ও হতাশাকে পুঁজি করে এই ব্যবসার জন্ম হয়। তরুণ-তরুণীরা ঘরে বসে থাকার চেয়ে টাকা খরচ করে হলেও অফিস করতে যান। এই সংস্থাগুলি গজিয়ে ওঠার আগে লোকজন চাকরির নাম করে ক্যাফে বা লাইব্রেরিতে আশ্রয় নিতেন বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
চিনে ১৬–২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ২০.৪%, যা জুনে বেড়ে হয় ২১.৩%। একই বছরে প্রায় ১ কোটি ১৬ লাখ স্নাতক চাকরির বাজারে প্রবেশ করলেও চাহিদা ও সরবরাহের ফারাক পরিস্থিতি আরও কঠিন করেছে।
২০২৫ সালের প্রথমার্ধে শহরাঞ্চলে বসবাসকারী ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সি যুবসমাজের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৫.৮ শতাংশ। ২০২৩ সালের এপ্রিলে এই হার ছিল ২০ শতাংশেরও উপরে। জুনে বেড়ে দাঁড়ায় ২১.৩ শতাংশে। তবে সরকারি সমীক্ষায় তা অনেকটা হ্রাস করে দেখানো হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী বেকারত্বের হার ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে ছিল ৫.২ শতাংশ।