কালো না, আলোকে মনে রেখেছি

সত্তরের দশকে, স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র তখন আমি। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া এক কিশোর। অস্বীকার করি না, সেই অন্ধকার দিনগুলোয়, সুন্দর সকাল নিয়ে আসার স্বপ্ন আমার মনকেও রঙিন করেছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share:

ছবি: সুমিত্র বসাক।

সত্তরের দশকে, স্কুলের উঁচু ক্লাসের ছাত্র তখন আমি। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া এক কিশোর। অস্বীকার করি না, সেই অন্ধকার দিনগুলোয়, সুন্দর সকাল নিয়ে আসার স্বপ্ন আমার মনকেও রঙিন করেছিল। শোষণমুক্ত সমাজ আর দিন বদলের স্বপ্নে আমিও শরিক হয়েছিলাম। ফল, গ্রেফতার। থানার লক-আপে জঘন্য অত্যাচার হয়েছিল আমার ওপর। শরীরটাকে উলটো করে ঝুলিয়ে, পায়ের তালুতে রুলের বাড়ি। হাতের নখের ফাঁকে মোটা সূচ ঢুকিয়ে...

Advertisement

গ্রেফতারের পর কোর্ট থেকে পুলিশ আমাকে ফিরিয়ে আনল রিমান্ডে। থানা হাজতে ক’দিন কেটেছে, হিসেব রাখার অবস্থা তখন আমার ছিল না। অচেতন হয়ে পড়ে থাকতাম। এক দিন সকালে জানলাম, আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে হাসপাতালে। হাঁটা দূরের কথা, তখন আমার দাঁড়ানোরও ক্ষমতা নেই। এক কনস্টেবল পাঁজাকোলা করে তুলে এনে, প্রিজন ভ্যানে ছুড়ে দিল আমাকে। হেঁকে বলল, ‘স্যর, মালটাকে তুলে দিয়েছি।’ দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে পৌঁছতে, সেই কনস্টেবল একই ভাবে আমাকে নামিয়ে নিয়ে যেতে চাইলে বললাম, নামিয়ে দিন, আমি নিজেই যাব। কনুইয়ে ভর রেখে, ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে এগিয়ে চললাম। এক হাতে হ্যান্ডকাফ, কোমরে দড়ি বাঁধা। দুজন সশস্ত্র কনস্টেবল দড়ি ধরে দু’পাশে আমার সঙ্গে সঙ্গে, পুলিশ অফিসার সামনে।

ড্রেসিং রুমে পৌঁছে দেখি, অফিসার এক জন ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছেন। পাশে এক সিস্টার দাঁড়িয়ে। ডাক্তারবাবু এগিয়ে এলেন। বললাম, আমাকে ছোঁবেন না। আমি ট্রিটমেন্ট করাব না। আমি তো এ রকম ছিলাম না, পুলিশ আমার এই হাল করেছে। আর তারাই এনেছে ট্রিটমেন্ট করাতে। ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আপনার শরীরের এই অবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসা অন্তত..’ বাধা দিয়ে বললাম, আমার শরীরের যা অবস্থা, তাতে তো এক্ষুনি আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত। করবেন আমাকে ভর্তি? ডাক্তারবাবু কাঁচুমাচু মুখে বললেন, ‘পুলিশ না বললে আমি অ্যাডমিট করতে পারব না।’ শুনেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। বললাম, তবে আপনি কীসের ডাক্তার! যান, পুলিশের পা চাটুন, আমার ট্রিটমেন্ট করতে আসবেন না। আমাকে ছুঁতে এলে সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা দেব, কিছু না পারি গায়ে থুথু দেব।

Advertisement

লক্ষ করলাম, সিস্টার চোখের ইশারায় ডাক্তারবাবুকে যেতে বললেন। তিনি চলে গেলে পুলিশ অফিসারকে বললেন, ‘আপনারা বাইরে যান।’ অফিসার পাত্তা না দিয়ে একই ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে, ফের বললেন, ‘কী হল! যান!’ অফিসার বললেন, ‘আসামী খুব ফেরোশাস। যে কোনও মুহূর্তে কিছু একটা করে পালিয়ে যেতে পারে।’ সিস্টার শুনে হেসে বললেন, ‘আপনার কাছে ও আসামী হতে পারে, আমার কাছে এক জন অসুস্থ মানুষ। যত ক্ষণ আমার কাছে আছে, ওর দায়িত্ব আমার। আপনারা এখান থেকে যান।’ অফিসার কয়েক পা পিছিয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়ালেন। এ বার দেখলাম সিস্টারের রুদ্রমূর্তি। বললেন, ‘এটা মন্দির, এখানে অসুস্থ মানুষের সেবা হয়। লজ্জা করে না আপনাদের, জুতো পরে বন্দুক নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতে! আপনারা এখান থেকে না গেলে আমি পেশেন্টের নার্সিং করব না। শুধু আমি না, সমস্ত হসপিটাল স্টাফকে বলে দেব, সবাই কাজ বন্ধ করে দেবে। এটা আপনার গায়ের জোর দেখানোর জায়গা নয়। গেটের কাছে দাঁড়ান, আমার হয়ে গেলে ডেকে পাঠাব।’ সিস্টারের দৃঢ়তার সামনে হার মানল পুলিশের ঔদ্ধত্য। কনস্টেবলদের নিয়ে অফিসার চলে গেলেন।

সিস্টার আমার পাশে বসে পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘ভাই, ট্রিটমেন্ট করিয়ে নাও।’ বললাম, কী লাভ! আপনি আমাকে সুস্থ করবেন, আর ওরা নিয়ে গিয়ে আবার একই ভাবে... তার চেয়ে সেপটিক হয়ে মরে যাই সেই ভাল। উনি খুব মমতায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘ভাই, তোমার ব্যথা আমি বুঝি। আমি যা বলি শোনো। আমি হসপিটাল সুপারকে ডাকছি। তুমি কেন ট্রিটমেন্ট করাতে চাও না, কারা তোমার এই অবস্থা করেছে, তাদের নাম-পদ-ব্যাচ নম্বর যা জানো, সুপারের অফিস-ডায়েরিতে লেখাও। ডায়েরির পেজ নম্বর, তারিখ, হাসপাতালের নাম, সব লিখে নিজের কাছে রাখো। হয়তো কোনও দিন তোমার কাজে আসবে। আমি তোমাকে এ-সব শিখিয়ে দিয়েছি, কাউকে বোলো না। পুলিশকে তো না-ই।’

রাজি হলাম ওঁর কথায়। সব লেখালাম। তখন আমার কলম ধরারও ক্ষমতা নেই, সুপার চলে যেতে সিস্টারকেই অনুরোধ করলাম লিখে দিতে। একটা ছোট কাগজের টুকরোয় সব লিখে উনি আমার পকেটে ভরে দিয়ে বললেন, ‘এটা গোপনে বাড়ি পাঠিয়ে দিও।’

কী মমতায় যে আমার ড্রেসিং করলেন! প্রতিটা ক্ষত আস্তে আস্তে মুছে পরিষ্কার করে, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করলেন। আমার বাঁ চোখটা তখন বন্ধ, রক্ত শুকিয়ে জমাট বেঁধে চোখের পাতাদুটো সেঁটে আছে। তখনও জানি না ওই চোখে দেখতে পাব কি না। পুলিশ ‘আজ তোর চোখটা গেলে দেব’ বলে হাতের রুলটা ঢুকিয়ে দিয়েছিল চোখে। আমি মুখটা সরিয়ে নিতে পেরেছিলাম, লেগেছিল চোখের কোণে। সিস্টার এই ঘটনা শুনে, শিউরে উঠে বললেন, ‘ছিঃ, এরা মানুষ!’

ধীরে ধীরে শুকিয়ে থাকা রক্ত পরিষ্কার করলেন। চোখ খুলে বললাম, দেখতে পাচ্ছি। ওঁর মুখেও তখন স্বস্তির হাসি। আমার চোখে একটা ড্রপ দিলেন, ড্রেসিং শেষ হলে পর পর দুটো ইঞ্জেকশন দিলেন। এতটুকু ব্যথা লাগেনি আমার। থানার ওই অমানুষোচিত পরিবেশের পর এ যেন এক ঝলক টাটকা বাতাস।

বছর তিনেক পর আমার কেস বদলি হল বর্ধমান সেশন কোর্টে। হিয়ারিং শুরু হবে, তার ক’দিন আগে আমার উকিলবাবুকে বললাম সুপারকে লেখানো সেই ডায়েরির কথা। শুনে উনি লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘এ তুমি কী করেছ! তুমি তো আমার হাতে দারুণ অস্ত্র তুলে দিলে! এতটুকু বয়সে এ-সব তুমি জানলে কী ভাবে?’ ওঁকে বলিনি সিস্টারের কথা। সিস্টার যে বারণ করেছিলেন কাউকে বলতে!

আর কোনও দিন সেই সিস্টারের দেখাও পাইনি। পরে খোঁজ করেও না।

প্রদীপ চক্রবর্তী, অন্ডাল, বর্ধমান

pradipchakra1957@gmail.com

সৎতরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement