ছবি: শুভময় মিত্র
উ ইকডে’তে একটু বেলার ট্রেনে, যেগুলো বেশি দূরে যায় না, রিজার্ভ করা কামরায় ভিড় থাকলেও, আনরিজার্ভড একদম ফাঁকা যায়। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ওই রকমই একটা ট্রেন। দোল, পৌষমেলা বাদ দিলে আগে থেকে টিকিটও কাটার দরকার নেই। হাওড়া স্টেশনে ঢুকে ডান দিকে কারেন্ট রিজার্ভেশনের কাউন্টারে স্লিপটা এগিয়ে দিলেই হল। টিকিট-দিদিমণি হাসিমুখে চোঁ-চোঁ করে ছেপে টিকিট ধরিয়ে দেবেন, একদম কনফার্মড, ডি ওয়ান। আমি অবশ্য আমার সিটটা দেখে নিয়ে অন্য কামরায় চলে গেলাম, এ-জানলা ও-জানলা, ইচ্ছে হলে চিত হয়ে বা পাশ ফিরে শুয়ে যাওয়া যাবে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে দেখাও যাবে কোন স্টেশন গেল। ফুড প্লাজা থেকে ভাল খাবার কেনার ইচ্ছে হলেও কিনলাম না। টাকাপয়সা নেই বিশেষ। লাল কাপড়ের ঝোলা থেকে হলুদ কলা বের করে খেয়ে ট্যাপের জলে পেট ভর্তি করে দরজায় দাঁড়ালাম।
খুব ইঞ্জিন দেখার শখ আমার। স্টিম তো উঠে গেছে বহু কাল হল। এখন সবই শক্তিশালী, হাই-স্পিড ডিজেল আর ইলেকট্রিক। মডেল লেখা থাকে গায়ে। ডব্লু ডি পি ফোর, ডব্লু এ পি সেভেন। তার ঘর কোথায়, সাঁতরাগাছি না অন্ডাল, তা-ও উল্লেখ করা থাকে। কাউকে ধরে এক বার ইঞ্জিনে উঠতে হবে। শক্তিরূপেণর শেষ কথা। পারফেক্ট সময়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। লেটে চলা কলকাতার দিকে আসা দূরপাল্লার কয়েকটা ক্লান্ত এক্সপ্রেসকে টা-টা করে, লোকালদের পাত্তা না দিয়ে, স্পিড বাড়িয়ে ফেলল চটপট। খুব সম্মান আছে এই ট্রেনটার। রবীন্দ্রনাথের দেশে যাওয়ার গাড়ি এটা। সেল্সের কেজো লোক, তারাপীঠের ভক্তিপার্টিরা বিশেষ ওঠে না। যাত্রীদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয় না। রিমলেস চশমা, তাঁতের শাড়ি, হাতে সুনীলের রাণু ও ভানু— এই সব আর কী। ডানকুনি পেরোনোর সময় বুঝলাম, আজ দারুণ মুডে আছে ওয়ান টু থ্রি থ্রি সেভেন আপ।
কর্ড লাইনের স্টেশনগুলোর অদ্ভুত সব নাম। পেরোনোর সময় দেখলাম খেলা করছে রেললাইন। হঠাৎ আলাদা হয়ে অন্য দিকে চলে যেতে যেতে আবার ধরে ফেলছে মূল লাইনকে। ব্রিটিশ আমলের তৈরি ছোট ছোট সিগনাল রুম। উদাসী সবুজ ফ্ল্যাগ। ছোট্ট লেভেল ক্রসিংয়ে একটাই ভ্যানগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে গায়ে কাদা শুকিয়ে যাওয়া মোষ। ট্রেন যাচ্ছে। দেখছে। সদ্য বৃষ্টি হয়ে গেছে। ছাইরঙা স্টিকারটা টেনে খুলে নেওয়ায় সাদা মেঘ আর চড়া নীল জমি বেরিয়ে পড়েছে আকাশে। তার নীচে শান্ত সমুদ্রের মতো দুলছে সবুজ ধানজমি। ফুলের মতো ফুটে আছেন চাষিরা। থোকা থোকা সবুজ ধানের গোছা ভরা কার্পেট। সেটাও যেন উড়ছে আজ। পেরিয়ে যাচ্ছে রুপোলি পোস্ট, কালো হলুদ রঙের শব্দ, সংখ্যা লেখা আছে তার গায়ে। এরা প্রত্যেকেই রেললাইনটার পেজ মার্ক। পোস্ট থেকে পোস্টে বাঁধা তারগুলো ধরা দেবে দেবে করেও আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে। পাখিরা বসে আছে নোটেশন হয়ে। টানা অনেক ক্ষণ ননস্টপ ফুর্তি করার পর কী খেয়াল হল, যেই মেন লাইনগুলো ডান পাশ থেকে এসে হাজির হল, অমনি ব্যাপারটা কেমন যেন সিরিয়াস হয়ে উঠল। পালসিট নামটা দেখেই প্রবল উত্তেজনায় একটা প্যালপিটেশন হতে লাগল। এখানেই তো সত্যজিৎ। এখন অপু-দুর্গা নেই, একটু দূরে এক্সপ্রেসওয়েতে খেলনা ট্রাক, গাড়ি, পেট্রল পাম্প। ধীরে ধীরে গুমগুম করে ট্রেন বর্ধমানে পৌঁছল।
বাসি সীতাভোগ আর মিহিদানা নিয়ে লোক দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন শুধু চা খাচ্ছে, আর চিপ্স। বর্ধমানের পরেই দুটো অদ্ভুত জায়গা। প্রথমে খানা জংশন। এখানে পি সি সরকার একটা ট্রেনকে ভ্যানিশ করে দিয়েছিলেন। তার পরেই একটা দুর্দান্ত বাঁক। দরজা দিয়ে নিজেকে বাইরে উড়িয়ে দিয়ে হাঁ করে দেখছিলাম ট্রেনের নীল শরীরটাকে। ন্যুড শো-র আদর্শ আবহ এখানে। গরমের সময় সান বেক্ড মাটি সরে যায় হলকা শুষে নিতে নিতে। এখন বর্ষায় পেরিয়ে যাচ্ছি এলোপাথাড়ি বেড়ে ওঠা শত সবুজের সবীজ প্রস্তাব। পুজোর সময় মেমসাহেবের গাউনের লেসের মতো কাশ দুলবে একই বাঁকে। হেমন্তে মনখারাপ করে শীতে মিলিয়ে যাবে কুয়াশায়। অদ্ভুত এক অভিমানে। বসন্তে আবার ফিরে আসবে উদ্দাম, অশ্লীল সব রং নিয়ে।
দরজা খোলাই থাকে। টুকটুক করে এক বার এসি-তে গেলাম। চাকার ড্রাম্স আর সিমবালের শব্দটা এখানে মিউটেড। লোকজন আস্তে কথা বলছে। নতুন বউ বরের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে ঘড়ি-পরা হাতটাকে জড়িয়ে রয়েছে শাঁখা-পরা আর একটা পেলব হাত। ওদের সিটটা ট্রেন যে দিকে যাচ্ছে, তার উলটো দিকে মুখ-করা। কেমন লাগে ব্যাপারটা। আমি দেখছি দেখে ছেলেটা প্রায় দেখা যায় না এমন একটু হাসল। আমিও যেন এমনিই গুনগুন করছি, ‘স্বপনে দোঁহে ছিনু কী মোহে’ একটু বেসুরো গাইতে গাইতে অন্য দিকে চলে গেলাম। চেকার নেই, পুলিশ নেই, সন্ত্রাস নেই, ব্যারিকেড নেই এই ট্রেনে। একটা জায়গা ফিট করে, জেনারেল কামরার শেষ দরজার পাশটায় এসে দাঁড়ালাম। সিগারেট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে। আমার কাছে নেই, বাউলের কাছে চাওয়া যেতে পারে। শরীর-ফরির নিয়ে ওই একটা গান হয়েছে, ওটাই এখন গায় ওরা।
ভেদিয়ার পরেই গাড়ির রাস্তার ওপর দিয়ে প্রচুর দম্ভ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল ট্রেন। কথা রেখে দেখা দিল তিনখানা তালগাছ। অজয়ের ব্রিজে ওঠার আগে অবধি ব্যাপারটা সিম্ফনির অ্যালেগ্রোর মতো। ক্রিসেন্ডোতে পৌঁছেই খুব স্লো হয়ে আসা ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নেমে গেলাম। তার পর স্টেশনের ভিড় থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে প্রথম ছাড়া বাসটার ছাদে উঠে পড়লাম। ছাদে ভাড়া কম, মনে হল বৃষ্টি হতেও পারে। হাওয়াটা ভেজা ভেজা লাগছে। কী একটা ছোটমত জায়গায় নেমে কন্ডাকটরকে দশ টাকা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সে চেঁচাতে লাগল! যাবেনটা কোথায়?
বৃষ্টি পড়লে অনেক ঘটনা ঘটে। নানা রকম আওয়াজ শোনা যায়। এখন চারপাশ শুনশান, নিস্তব্ধ। সামনে বাঁশবন, সেও মটমট করছে না। একলা ছাগলছানা দাঁড়িয়ে আছে, মা-টা কোথায় কে জানে! কোলে নিলাম, পালাল না। ঢক করে মাথাটা হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। একটু এগোতেই গ্রামের মাটির বা়ড়ি, টিনের চাল, রাস্তার ধারে একটা ঠাকুরের কাঠামো, এ সব ছেড়ে বেড়া দেওয়া অনেক সুন্দর গাছভরা একটা জায়গা চোখে পড়ল। উঁকি মেরে দেখলাম একটা লোক প্রজাপতির ছবি তুলছে। কোনও রিসর্ট হতে পারে, এখন তো এ দিকে এ রকম অনেক হয়েছে শুনেছি। ভেতরে গেলে নির্ঘাত বের করে দেবে। তাই হাঁটতে লাগলাম। একটা উঁচু পাড় শুরু হল। তার মানে ও-পাশে বড় দিঘি আছে। কাঁকরের মাটিতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ওপরে উঠলাম।
মস্ত বড় জলের জায়গা, দূরে জলের মধ্যে একটা আধডোবা নৌকো। নেমে গেলাম তীর অবধি। কোথাও কেউ নেই। আস্তে আস্তে হাওয়া উঠল। বৃষ্টির হাওয়া। যদিও আকাশ ঝকঝকে, সাদা মেঘ সরছে স্লো মোশনে। ছোট ছোট ঢেউ উঠছে, পাড়ের কাছে এসে ফুরিয়ে যাচ্ছে। আধডোবা ছোট গাছ, দেখে মনে হচ্ছে ভেসে যেতে চাইছে নৌকোর কাছে। নৌকোটা ঘুরতে শুরু করল। আলকাতরা চটা, ফুটো নৌকো, কিস্যু নেই তার। কেউ নেয় না ওকে। আমাকে দেখেছে। কী ভাবছে কে জানে। এক বার এ-দিক, এক বার ও-দিক, ঘুরছে আস্তে আস্তে। দেখাচ্ছে নিজেকে। মেঘ ডাকছে। তাই মৃত তরণীর আজ ময়ূর হওয়ার শখ হয়েছে।
suvolama@gmail.com