ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
দুটো ট্যাক্সিতে ঠাসাঠাসি করে মুক্তারামবাবু স্ট্রিট থেকে যখন ওরা সল্ট লেকের ময়ূখ ভবনে পৌঁছল, তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। ওদের ডাকা হল যুগ্মসচিবের অফিসঘরে। দেড় ঘণ্টা কথাবার্তা চালালেন ওঁরা। আজকাল নতুন শব্দটা হচ্ছে ‘দেহব্যবসায়ী’। কথাটা পছন্দ নয় অলকেন্দুনাথ রায়ের, কিন্তু ওটাই এখন সরকারী রীতি। সেক্স-ওয়ার্কারদের মধ্যে কেউ কিছু বলল না। ওদের বোধহয় বলা হয়েছে চুপ করে থাকতে। যা বলার এনজিও’র ভদ্রমহিলাই বললেন। আর বললেন সরলা কুণ্ডু, যাঁর হাবভাব একেবারেই ভাল লাগল না অলকেন্দুর। মৈত্রেয়ীও যে মহিলার কথাবার্তা বিশেষ পছন্দ করছেন না, সেটা তার বডি ল্যাংগোয়েজেই স্পষ্ট বুঝতে পারছেন অলকেন্দু।
কথাবার্তা মোটামুটি হয়ে এসেছিল। সোনাগাছি এলাকায় দীর্ঘ দিন কাজ করছে ‘নারী’। সংগঠিত করেছে দেহব্যবসার সঙ্গে জড়িত বেশ ক’জন মহিলাকে। তাঁরা একত্র হয়ে একটি সমবায় সমিতি খুলবেন, যা থেকে ছোটখাটো ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা অর্জনের অন্য উপায় খুঁজে পাবেন। স্বাধীনতার ষাট বছর উপলক্ষে সরকারের ঘোষিত প্রকল্পের এটি একটি। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখিয়েছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে সরলা কুণ্ডুর দলকে বিদায় জানানো হল। এনজিও’র দুজন প্রতিনিধি থেকে গেলেন, সরকারি অফিসারদের সঙ্গে বাকি আলোচনা সারবেন। স্বাধীনতা দিবসে এক অনুষ্ঠানে এই সমিতির উদ্বোধন হবে। কোথায় করা যায় অনুষ্ঠান, কাদের ডাকা হবে, অনেক খুঁটিনাটি বিষয় ঠিক করতে হবে।
সরলা কুণ্ডুর সঙ্গে মেয়েরা বেরিয়ে যাওয়ার পর, ছোট্ট করে গলা-খাঁকারি দিলেন অর্থ দফতরের সহ-সচিব তথাগত নন্দী। এই মিটিং-এ অন্য দুজনের থেকে পদমর্যাদায় তিনি এক দাগ নীচে, তাই এত ক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। তাঁর দিকে তাকালেন মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য।
‘মিস্টার নন্দী, কিছু বলবেন?’
‘হ্যাঁ ম্যাডাম, একটা কথা...’
‘বলুন।’
‘সবই তো ঠিক হল, কিন্তু ফিনান্সে ফাইল গেলে কিন্তু একটা টেকনিকাল ডিফিকাল্টি হতে পারে।’
‘টেকনিকাল ডিফিকাল্টি? কিন্তু আমরা তো সব কাগজপত্রই জমা দিয়েছি নিয়মমত,’ মল্লিকা মজুমদারকে বিরক্ত শোনাল।
‘না, সমস্যা একটা হতে পারে।’ তথাগত নন্দী ছাড়বার পাত্র নন।
‘কী সমস্যা, সেটা কিন্তু বলছেন না,’ মৈত্রেয়ী এ বার একটু অসিহিষ্ণু। আড়চোখে দেখলেন, অলকেন্দু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন দরজার দিকে।
‘ম্যাডাম, সমস্যা হল, এঁরা বলছেন যে সেক্স-ওয়ার্কাররা নিজেরাই এই সমবায় সংস্থাটির শেয়ারহোল্ডার হবেন, নিজেরাই এটা চালাবেন, কোনও এনজিও’র সাহায্য নেবেন না, এমনকী কোনও সরকারি পরিচালনারও কোনও প্রয়োজন তাঁদের নেই।’
‘সেটাই তো ভাল, মিস্টার নন্দী? এর মধ্যে সমস্যা কোথায়, তা তো আমি দেখতে পাচ্ছি না।’
‘ম্যাডাম, ফিনান্স ডিপার্টমেন্টের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ কোনও ব্যাঙ্ক বা সমবায় সমিতি খুলতে চাইলে, তাঁকে সার্টিফিকেট দাখিল করতে হয় যে সেই ব্যক্তি উন্নত চরিত্রের মানুষ। পার্সন অব গুড ক্যারেক্টার। এঁদের যা জীবিকা, তাতে সেই সার্টিফিকেট কি এঁদের কেউ দিতে রাজি হবেন? আর যদি কেউ দেনও, আদালতে অন্য কেউ মামলা করলে সেই সার্টিফিকেট কি ধোপে টিকবে?’ কথা শেষ করে থামলেন তথাগত নন্দী।
‘কী বলছেন আপনি? এটা একটা কথা হল?’ প্রায় একসঙ্গে বলে উঠলেন মল্লিকা আর সুনন্দ।
কিন্তু প্রায় ঘণ্টাখানেক তর্কাতর্কির পরও সমস্যার কোনও সুরাহা হল না।
অত্যন্ত বিরক্ত হলেও মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন, সরকারি দফতরে এটা একটা সমস্যা হতে পারে। ঠিক হল, তিন দিন পর আর একটা মিটিং-এ সমাধান খোঁজা হবে। প্রয়োজনে আইন মন্ত্রকের কাউকে ডাকা হবে।
ময়ূখ ভবন থেকে মুক্তারামবাবু স্ট্রিটে ফিরতে ফিরতে প্রায় পাঁচটা বেজে গেল। বাঁচোয়া একটাই। আজ সাজগোজ করাই আছে, নতুন করে সাজতে হবে না। একটু চড়া মেকআপ লাগিয়ে নিলেই চলবে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই তুলসীর দেখা আসলামভাইয়ের সঙ্গে। তার অপেক্ষাতেই যেন দাঁড়িয়ে ছিল। চোখের ইশারায় তাকে রান্নাঘরে ডেকে নিল আসলামভাই।
‘কী বলচো গো আসলামভাই?’
‘তুমি চিন্তা কোরো না খুকি। তোমার ঘরে একটা মাল রেখে গেছে গৌরাঙ্গবাবু। যদি সার্চ করায় মাসি, আমি ঠিক জানতে পারব। আমি সরিয়ে লিব মাল। তোমায় কিচু করতে হবে না। কোনও ক্ষতি হবে না তোমার। কিন্তু মাসিকে বললে কেস বিলা করে দেব আমি। চুপচাপ ঘরে উঠে যাও।’
প্রায়ান্ধকার রান্নাঘর ঘি-মশলার গন্ধে ম-ম। একমনে শিলনোড়া ধুতে ধুতে কথাগুলো বলে গেল আসলামভাই। তার দিকে এক বারও না তাকিয়ে।
তুলসীর ভীষণ ভয় করছে। আসলামভাইকে নিশ্চয়ই ভাল রকম টাকা খাইয়ে গিয়েছে গৌরাঙ্গ। নইলে এতখানি ঝুঁকি নিত না আসলামভাই।
এখন কী করবে তুলসী? এইটুকু তো ঘর। এটুকু আশ্রয়ও যদি চলে যায়, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে? মাসি কোনও ভাবে টের পেলে আসলামভাই যে তার পাশে দাঁড়াবে না, সেটা ভালই জানে তুলসী। আর মাসিকে বলার তো কোনও প্রশ্নই নেই। আসলামভাই শাসিয়ে রেখেছে! তা ছাড়া কী-ই বা বলবে সে? তাকে মাসি বিশ্বাসই বা করবে কেন?
এমন অসহায় অবস্থায় তাকে কেন ফেলে গেল গৌরাঙ্গ? কী অপরাধ করেছিল সে? অসহায় রাগে, ক্ষোভে কান্না পাচ্ছে তুলসীর।
ঠিক সেই সময় অলকেন্দুনাথ রায়কে সেই কথাটাই বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন মৈত্রেয়ী।
‘স্যর, ওরা কত অসহায় বলুন! একটা কিছু তো কেউ চেষ্টা করছে। আমাদেরও একটু উদ্যোগ নিয়ে সাহায্য করা উচিত, তাই না? তা ছাড়া সিএম এ ব্যাপারটা নিয়ে ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছেন!’
করিডরের অন্য প্রান্তে যুগ্মসচিবের চেম্বার। সেখান থেকেই ইন্টারকমে তাঁর শীতল কণ্ঠ
ভেসে এল।
‘মিসেস ভট্টাচার্য, এ সব ব্যাপারে আমি আপনার মতো সহমর্মী নই। বয়স হচ্ছে তো! সিনিকাল হয়ে পড়ছি। সিএম-এর পছন্দের প্রোজেক্ট, সেটাই বড় কথা। না হলে ও সব অসহায়-ফসহায় আবার কী? অসহায় তো এই ব্যবসা ছেড়ে অন্য কিছু করে না কেন? দেশে গরিব মহিলার সংখ্যা কম? সবাই প্রস্টিটিউশন করছে?’
সিনিয়র অফিসারের মুখের উপর কথা বলতে পারলেন না মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য। কান ঝাঁ-ঝাঁ করছে তাঁর! এই ভদ্রলোকই সারা মিটিংটা আড়চোখে তাকিয়ে ছিলেন ওদের এক জনের দিকে!
কথা তখনও শেষ হয়নি সমাজকল্যাণ দফতরের যুগ্মসচিব অলকেন্দুনাথ রায়ের, ‘কী দিনকালই না পড়ল। বেশ্যাদেরও নাকি স্বাধীনতা দিবস! অনেক দেখলাম মিসেস ভট্টাচার্য।’
কট করে কেটে গেল টেলিফোন।
১২
সাত সমুদ্র তেরো নদী
স্বাধীনতা দিবসের কোনও অনুষ্ঠান ওদের লক্ষ্য হতে পারে, দিল্লি থেকে আসা এই বার্তাটাই সব গোলমাল করে দিল। না হলে নিজের দফতরের এত কাছে এই ধরনের কোনও লোকের সঙ্গে দেখা করার কথা ভাবতেন না রীতেশ শর্মা। স্বাধীনতা দিবসের আর দু’সপ্তাহও বাকি নেই। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। তাঁর কাজ সঠিক তথ্য সংগ্রহ। সে তিনি করে দেবেন ঠিকই, কিন্তু দিল্লির হেড অফিস তাঁকে ক’দিন আগে জানাতে পারত ব্যাপারটা। হাতের কাগজটা থেকে মুখ তুলে তাকালেন তিনি।
লন্ডনের বর্ষণসিক্ত সকাল। অগস্টে সচরাচর এত বৃষ্টি হয় না। এখন এখানে গ্রীষ্মকাল, সামার। এ দেশে সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে বছরের এই সময়টুকুর জন্য। ঝকঝকে দিন হওয়ার কথা এখন। কিন্তু গত দু’দিন ধরে ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছে। লন্ডনে বৃষ্টি হলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে হাজার হাজার কালো রঙের ছাতা। পুরুষদের হাতে তো বটেই, মহিলাদের অনেকের হাতেও। যে রাস্তায় যাও, কালো ছাতার মিছিল।
অল্ডউইচ-এর যে ক্যাফেটায় বসে আছেন তিনি, আজ বৃষ্টির দিন বলেই বোধহয় সেটা ফাঁকা। নইলে এখন দুপুর এগিয়ে আসছে, লাঞ্চ ব্রেকে খেতে আসা মানুষের ভিড় বাড়তে থাকার সময় এখন। আজ বোধহয় তাঁর মতো দু-এক জন ছাড়া খুব একটা কেউ অফিস থেকে বেরোবে না।
এই ক্যাফেটা খুব পছন্দ রীতেশের। ভারতীয় দূতাবাসের কাছে বলে এখানে প্রায়ই আসেন তিনি। গোল, খয়েরি টেবিল টপ। চারিদিকে আরামদায়ক চেয়ার। সচরাচর যেখানে বসেন, আজ অবশ্য সেখানে বসেননি। বসেছেন বড় কাচের জানলার কাছের উঁচু টেবিলটায়। এখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায় ভাল।
তাই খাকি রঙের বর্ষাতি পরা শ্বেতাঙ্গিনীটি যে ক্যাফেতে ঢুকেই এদিক-ওদিক দেখে নিল, সেটা নজর এড়ায়নি তাঁর। এড়ানোর কথাও নয়। ভারতীয় দূতাবাসে রীতেশ শর্মার আনুষ্ঠানিক পরিচয় হল মিনিস্টার অব ট্রেড। দূতাবাসের বেশির ভাগ কর্মী তাই জানে। তাঁর বিজনেস কার্ডেও সেটাই লেখা। শুধু হাইকমিশনার সহ মুষ্টিমেয় ক’জন জানেন, ওই আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের আড়ালে রীতেশ শর্মার আসল কাজ গুপ্তচরবৃত্তি ও গোয়েন্দাগিরি। ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ বা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দাদের এক জন তিনি।
ইউরোপের নানা দেশে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাতেও। লাহোর আর করাচিতে দু’বছর আত্মগোপন করে থাকার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। ১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর একটি যাত্রিবাহী বিমান ছিনতাই করে কান্দাহারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই ঘটনার তিন মাস আগে রীতেশ শর্মা সদর দফতরে জানিয়েছিলেন, নেপাল থেকে একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই করার পরিকল্পনা করছে একটি আতঙ্কবাদী গোষ্ঠী। অন্যান্য অনেক রিপোর্টের মতো তাঁর রিপোর্টটিও ফাইল করার পর ভুলে যাওয়া হয়। সে ভুল অবশ্য দ্বিতীয় বার করেননি কর্মকর্তারা। তার পর থেকেই রীতেশ শর্মার পাঠানো যে কোনও রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় দিল্লির সদর দফতরে।
এই কাজটির দায়িত্বও সে জন্যেই তাঁকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এ বার বড্ড কম সময়।
রীতেশ যেখানে বসে আছেন, মেয়েটি তার কাছাকাছি এসে বসেছে। কাচের জানলার কাছে উঁচু টেবিলে বসে সে-ও লন্ডনের বৃষ্টিভেজা চেহারা দেখতে চায়। বর্ষাতিটা খুলে, টেবিলের এক প্রান্তে গুছিয়ে রাখল মেয়েটি। হাতের বইটা পাশে রাখল।
হাতে খুলে ধরা গার্ডিয়ান কাগজটার দিকে মন দিয়েছেন রীতেশ। কিন্তু এর মধ্যেই জরিপ করে ফেলেছেন মেয়েটিকে। বছর পঁচিশের বেশি না। লম্বা, সোনালি চুল, সুঠাম শরীর। নিয়মিত ব্যায়াম করে মেয়েটি, বা দৌড়য়।
টেবিলের উপর রাখা মেনু কার্ডের উপর এক ঝলক নজর বুলিয়েই খাবারের অর্ডার দিতে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল মেয়েটি। কিন্তু যাওয়ার আগে বাঁ হাতের কবজির ছোট্ট, দক্ষ মোচড়ে রীতেশের সামনে ছড়ানো গার্ডিয়ান কাগজটির তলায় একটি সাদা খাম রেখে গেল। ঘটনাটি ঘটল এত অনায়াসে, ক্যাফেতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা মুষ্টিমেয় ক’জন ক্রেতা চোখ তুলে দেখলেনও না।
মেয়েটি কাউন্টারে গিয়ে না দাঁড়ানো পর্যন্ত হাতের কাগজটা এক চুলও সরালেন না রীতেশ। মাঝের পাতার একটা লেখা মন দিয়ে পড়ে চলেছেন। কাউন্টারে যখন অর্ডার দিচ্ছে মেয়েটি, তখন আস্তে করে কাগজটা তুলে খামটা টেনে নিলেন রীতেশ। ভিতরে ছোট্ট একটা চিরকুট। ইংরেজিতে লেখা, ‘এখানে নয়। এই ক্যাফে থেকে বেরিয়ে ডান দিকে একশো গজ মতো হাঁটলে ‘দ্য ডিউক’ নামের যে পাব-টা, তার দোতলায় আমি অপেক্ষা করব সাড়ে বারোটায়।’
ক্রমশ