কা গে র ছা ব গে র ছা

মানুষ প্লেন মিস করে, আর বেঁচে যায়

Advertisement

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share:

আন্দ্রে ওয়াইদা-র ‘ইনোসেন্ট সরসারার্স’ ছবির দৃশ্য

রাস্তা দিয়ে হনহন করে হাঁটছি না ছুটছি হুঁশ নেই। সমরেশ দু’ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছে কফি হাউসে। বেথুন কলেজের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হাফচেনা এক জন খপ করে হাতটা ধরে ফেলল।

Advertisement

কোথায় যাচ্ছ? কীসের এত তাড়া?

আরে ছাড়ুন ছাড়ুন। দু’ঘণ্টা ধরে বসে আছে সমরেশ। দেরি হয়ে যাচ্ছে!

Advertisement

কোন সমরেশ? লেখক? সাহিত্যিক সমরেশ?

হ্যাঁ হ্যাঁ। ছাড়ুন এ বার।

আমার সঙ্গে ওঁর আলাপ করিয়ে দেবে? ওঁর ‘বিবর’ পড়ে...

আমি তত ক্ষণে বেথুনের পাঁচিল ছাড়িয়ে আরও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছি।

এই সমরেশ বসু লেখক নয়। ‘বিবর’ পড়েছে, কিন্তু লেখেনি। শ্রীরামপুরে থাকে, আমার সঙ্গে শ্যামবাজার ছাড়িয়ে কাঁটাকলের কাছে এমএ পড়ে ইকনমিক্সে। আর ওই সমরেশ বসুর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল আরও বেশ কিছু বছর পরে। ঘনিষ্ঠতাও হয়েছিল অনেকখানি। সাহিত্যিকরা অনেকেই একটু অদরকারে দাম্ভিক হন, কিন্তু সমরেশ বসু ছিলেন ব্যতিক্রমীদের মধ্যে, খোলামেলা নিপাট ভালমানুষ। আমি প্রায় পৌঁছে গিয়েছি হ্যারিসন রোড ক্রসিংয়ের কাছে, এই সময়ে আবার বাধা। কাঁধে আর পিঠে অনেক বই বাঁধা এক জন কানের কাছে লম্বা ঠোঁট বাড়িয়ে সরু করে বলল, মাও-সে-তুং, মাও-সে-তুং... লাগবে?

সেটা ১৯৬০-এর দশকের একেবারে ঝরে পড়ার দিক। টালিগঞ্জ মুক্তাঞ্চল হয়ে গেছে। বেহালায় বল্টুর বন্ধু কিন্নর পুলিশ মারতে গিয়ে নিজেই ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। প্রত্যেক দিন ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে আমার বয়সি আরও অনেকে। পঞ্চাশ পয়সা দিয়ে বইটা কিনে পেটের ভেতর গুঁজে নিলাম। মারছে স্বাধীন ভারতবর্ষের পুলিশ। তাদের খবর দিচ্ছে যে-সব খোঁচড়রা, তারাও চোরাগোপ্তা মার খাচ্ছে, মরে যাচ্ছে। কাগজে খবর বেরল, তখনকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় কোথায় যেন বেড়াতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে দোলনায় দুলতে দুলতে গান গাইছেন— সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে। এই সময় একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলাম। কত স্বপ্নই তো ভুলে গেছি, কিন্তু এই স্বপ্নটা এখনও মনে আছে। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মদ খেয়ে উদোম গায়ে আন্ডারওয়্যার পরে ফুটপাতে উবু হয়ে বসে হাউ হাউ কাঁদছেন। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করছি, কাঁদছেন কেন? কীসের দুঃখ আপনার? কীসের ব্যথা?

কফি হাউসের সিঁড়িগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে ভেতরে গিয়ে দেখি, সমরেশ তখনও বসে আছে। দেশলাই উলটে উলটে আমাদের সেই প্রিয় খেলাটা খেলে যাচ্ছে। আন্দ্রে ওয়াইদা-র ‘ইনোসেন্ট সরসারার্স’ তখন কলকাতায় বাণিজ্যিক রিলিজ হয়েছিল। চলেছিল অনেক দিন, আর ছবি থেকে সেই খেলাটা আমরা খেলার ছলে নেশার মতো তুলে নিয়েছিলাম। আমাদের সেলফোন ছিল না, দেশলাই ছিল। একটা দেশলাইবাক্সকে টেবিলের একদম ধারে নিয়ে আসতে হবে। দেশলাইবাক্সের শূন্যে ঝুলে থাকা অংশটার নীচে তর্জনী দিয়ে আবার টেবিলের দিকে ছুড়ে দিতে হবে। টেবিলে যদি লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বাক্সটা, তা হলে বাজিতে হেরে যাওয়া উলটো দিকের মেয়েটি নির্বসনা হবে। সবটাই কল্পনা। সমরেশ একমনে দেশলাইবাক্স নিয়ে খেলে যাচ্ছে। আমি সামনের চেয়ারে গিয়ে বসলাম, কফি আর পকোড়া অর্ডার করলাম। সমরেশ খেলেই চলেছে আর তার দেশলাই বার
বার লাট খেয়ে কেলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। দেশলাইটাকে একটা অশ্রাব্য গালাগাল দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, শালাঃ! তোর জন্য বসে থাকতে থাকতে পেছন ঝুলে গেল।

গল্প করতে করতে গল্প করতে করতে গল্প করতে করতে কফি হাউস বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গেল। গিরিধারী এগিয়ে এসে বলল, এই বার সোজা বাড়ি যাও। গিরিধারীকে আমি চিনি বহু কাল। আমাদের দেখলে অদ্ভুত করে হাসত। এক কাপ কফি আর একটা খালি কাপ, খিদের মুখে এক প্লেট পকো়ড়া যে কত বার ও দিয়ে গেছে অর্ডার না দিতেই! এক বার গিরিধারীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, এক প্লেট ফিশ কবিরাজির দাম কত? গিরিধারী বলেছিল, অনেক। চাকরি করে খেয়ো। বাবার পয়সায় ফিশ কবিরাজি খায় না। এর পর ওই টালমাটাল সময়ের মধ্যেই এক দিন গিরিধারী চলে গেল। অনেক বছর পর ‘বাঘ বাহাদুর’-এর শুটিং করতে গিয়ে ভুবনেশ্বরের একটা হোটেলে উঠেছি। ঘরে ঢুকে চায়ের জন্য বলেছি নীচে। একটু পরে দরজায় বেল বাজল। দেখি, চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক জন। আমাকে দেখে তার মুখটা বদলে গেল, ফুটে উঠল বহু চেনা, বহু পুরনো, খুব প্রিয় এক হাসি।

কফি হাউস থেকে বেরিয়ে হাওড়া স্টেশনের সাত নম্বর প্ল্যাটফর্ম। ওখান থেকেই সাধারণত বর্ধমান, ব্যান্ডেল, শ্যাওড়াফুলি লোকাল ছাড়ত, আর প্রত্যেকটাই দাঁড়াত শ্রীরামপুরে। সমরেশের হাতে গুঁজে দিলাম মাও-এর কবিতার চটিবই— এইটা তোর জন্য। সমরেশ এক ঝলক বইটা দেখে নিয়ে বলে উঠল, বাঃ, দারুণ! তার পরেই তাড়াতাড়ি জামার ভেতর ঢুকিয়ে নিল বইটা। আর দেরি করা নিরাপদ নয় বুঝে একটা শ্যাওড়াফুলি লোকালে জোরজার করে তুলে দিলাম সমরেশকে।

কত কীই যে মানুষকে বাঁচিয়ে দেয়! আমার এক মাসতুতো মামা গুয়াহাটি থাকতেন। গুয়াহাটি থেকে কলকাতা প্লেনের ভাড়া তখন একশো টাকার কাছাকাছি। মামা কোনও দিন প্লেনে চড়েননি। আকাশ থেকে মেঘের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে নীচটা কেমন লাগে তা দেখার বড় শখ, কিন্তু অতগুলো টাকা দিয়ে প্লেনের টিকিট কাটা, বাপ রে! তবু কী মনে হতে কেটেই ফেললেন গুয়াহাটি থেকে কলকাতা প্লেনের টিকিট। বাড়ি থেকে গুয়াহাটি এয়ারপোর্ট এসে, খামখা প্লেন ধরতে ছুটতে গিয়ে, বাঙালির যেমন সব কিছুই ছুটে ধরার অভ্যেস তেমনই, পড়ে গেলেন কনভেয়র বেল্টের ওপর, আর কনভেয়র বেল্টও তাঁকে নিয়ে ঘুরে চলল মনের আনন্দে। শেষ পর্যন্ত যখন সবার টনক নড়ল, তখন আর মামার নিজের পায়ে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। ‘ফকার ফ্রেন্ডশিপ’ প্লেন তাঁকে বাদ দিয়েই উড়ে পড়ল কলকাতার দিকে, কিন্তু কলকাতা পৌঁছনোর আগেই ঝড়ের মুখে পড়ে প্লেনটা ভেঙে পড়ল মাঝরাস্তায়। কারও বাঁচার কথা ছিল না, বাঁচেওনি, শুধু বেঁচে গিয়েছিলেন আমার মাসতুতো মামা। বাঁচিয়েছিল কনভেয়র বেল্ট! মামি অনেক কাল আগে চলে গেছেন। জহরের সঙ্গে এক দিন গড়িয়াহাট মোড়ে দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, মামা কেমন আছেন? মানে, সেই মাসতুতো মামা। জহর বলল, ভালই। এই বাবার জন্য গোপালের পাঁঠা কিনে নিয়ে যাচ্ছি। মাংস খাওয়ার শখ হয়েছে। ছিয়াশি বছর কিন্তু স্টিল গোয়িং স্ট্রং। বুঝলে?

সমরেশকে সে দিন বাঁচিয়ে দিয়েছিল মাও-এর সেই চটি কবিতার বই। অত রাতে শ্রীরামপুরের আধো-অন্ধকার রাস্তা দিয়ে সমরেশ জোরে পা চালিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল কয়েক জন, ঘিরে ধরল ওকে। তার পর ওর মুখ চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল আরও অন্ধকার, ফাঁকা একটা জায়গায়। দাঁতে দাঁত চেপে এক জন বলল, শালা খোঁচড়! আজ শেষ হয়ে যাবি। কোথাও একটা ভুল হচ্ছিল ওদের। সমরেশ অনেক বোঝাল, কিন্তু ওরা বুঝবার নয়। তত ক্ষণে এক জন গাদা রিভলভার বের করে এনেছে। হঠাৎ সমরেশের মনে পড়ে গেল কিছু। জামা তুলে প্রায় পেটের নাড়িভুঁড়ির ভেতর থেকে ও খুবলে বের করে আনল মাও-সে-তুং’এর কবিতার বই, মেলে ধরল তাদের সামনে— দেখুন দেখুন... কোথাও ভুল করছেন আপনারা। ছায়ামূর্তিরা ‘মিসটেক, মিসটেক’ বলে আবার ঢুকে পড়ল অন্ধকার মাটির ভেতর, আর বেঁচে গেল সমরেশ। বাঁচিয়ে দিলেন মাও-সে-তুং!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন