গাধার পাঠশালা

সে এক গহন বন। বনের মধ্যে নদী। নদীর ধারে মস্ত মাঠ। পশুদের চারণভূমি। তার ঠিক মধ্যিখানে বিশাল বট কত শতাব্দী প্রাচীন। এত শত ঝুড়ি তার, কেউ গুনে শেষ করতে পারে না। এ বৃক্ষের ডালে ডালে পাখি। বাঁদর। বাদুড়। সাপ। সব মিলেমিশে থাকে। তলায় গাধার পাঠশালা।

Advertisement

তিলোত্তমা মজুমদার

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০০:০৭
Share:

ছবি: সুমন চৌধুরী।

সে এক গহন বন। বনের মধ্যে নদী। নদীর ধারে মস্ত মাঠ। পশুদের চারণভূমি। তার ঠিক মধ্যিখানে বিশাল বট কত শতাব্দী প্রাচীন। এত শত ঝুড়ি তার, কেউ গুনে শেষ করতে পারে না। এ বৃক্ষের ডালে ডালে পাখি। বাঁদর। বাদুড়। সাপ। সব মিলেমিশে থাকে। তলায় গাধার পাঠশালা।

Advertisement

বনের শান্ত প্রাণী গাধা পশ্চিম থেকে পাশ দিয়ে পণ্ডিত হয়ে ফিরেছে। সে পশুশাবকদের জন্য ইস্কুল খুলেছে। রাজপুত্তুর সিংহশাবক, ভালুকছানা, বাঘের বাচ্চা, হাতির ছানা, বাঁদর, ভোঁদড়, বনবিড়াল, গাধা, ঘোড়া, বাইসন, শম্বর, হরিণ, শূকর, খরগোশ— সব পশুর ছেলেপুলেরা সেই ইস্কুলে পড়তে যাচ্ছে। সবে মিলে তারস্বরে নামতা পড়ে, সে এক বিচিত্র আওয়াজ। সব ছাপিয়ে শোনা যায় মাস্টারের কণ্ঠ! গাধার ডাক বলে কথা! ভাঙে বনের নীরবতা। দুটি ভগ্নাংশ মিলে পূর্ণ সংখ্যা কেমন করে হয় ভেবে ভেবে গাধার রাতে ঘুম হয় না। তাতে কী? অরণ্যের যত জানোয়ার বেজায় খুশি। বনে পাঠশালা ছিল না মোটে। সক্কলে গাধার তারিফ করে বটে। এমন ছেলে লাখে একটা মেলে। আজকাল গাধার খুব খাতির। খেতাব পেল অরণ্যবীর। সিংহরাজামশাই পর্যন্ত সাক্ষাতে কুশল প্রশ্ন করে বলেন, কী রাসভপণ্ডিত, সব ভাল তো?

গাধাপণ্ডিত শব্দটা যেন কেমন কেমন। মন ভরে না। তাই রাজার ফরমান বলতে হবে রাসভপণ্ডিত। সকলেই দেয় এই সম্মান!

Advertisement

শুধু এক জনের ভারী রাগ। সে হল বুদ্ধিসর্বস্ব চতুরজ্ঞান-শিরোমণি শ্রীশ্রীশৃগাল মহাশয়। এতকাল গভীর অরণ্যে পণ্ডিত হিসেবে তারই খ্যাতি ছিল। পরমজ্ঞানী লম্ফসর্বজ্ঞ হনুমান পর্যন্ত সময় সময় তার পরামর্শ নিত। আজকাল সেও গর্দভের শলা নিচ্ছে! অথচ কত বার হনুমান বলেছে শেয়ালভায়া, তোমার মতো এমন মেধা পট করে কেউ দেখাতে পারে না!

দুঃখে ফ্যঁাচ করে কেঁদে পুরনো বন্ধু কুমীরকে সব বলল শেয়াল। কুমীর শেয়ালের চেয়েও বেশি কাঁদল। দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘ভারী তো পাঠশালা! যদি জলে হত, বুঝতাম গাধাটা সবার ভাল চায়। দুর দুর! বাছারা আমার শিকার ধরে, খায় কচমচ করে। লেখাপড়ায় কি শিং গজায়? তোমার গজিয়েছে?

শেয়াল ঝাঁকড়া ল্যাজ দুলিয়ে বলল, ‘না বিদ্যাবুদ্ধি, না শৌর্যবীর্যশিংয়ের সঙ্গে কারও লিংক নেই।
যত ব্যাটা শিঙাল, যতই পড়ুক, সব মুখ্যু, নয় গোঁয়ার! দেখলে বড় দুঃখু।’

কুমীর নোলা সক-সকে জিভ টাকরায় চকাস ঠুকে বলল, ‘বুদ্ধু হোক, মুখ্যু হোক, গোঁয়ার কিংবা খাঁদু! খেতে স্বাদু।’

‘তা যা বলেছ!’ শেয়াল সরু চোখে চেয়ে ঠোঁট চেটে বলল, ‘বিশেষ ওই ছানাগুলো। ছাগ, মেষ, হরিণ, বাছুর... ঝোল রাঁধলে গন্ধ ভুরভুর। করব হুকুম, চাকুমচুকুম খাব ভূরিভূরি। নইলে কীসের শেয়ালগিরি আর কী তোমার কুম্ভীরি?’

‘সে আর বলে কী হবে?’ কুমীর লম্বা হাই তুলে বলল, ‘বাঘ নাকি মাংস ছাড়বে, সিংগি খাবে নিরামিষ। বই পড়া সব বাচ্চাগুলো মাছ না বলে বলছে ফিশ! দিনে দিনে কী হল! শাবক ধরে খাওয়া যাবে না বনের নতুন আইন। খেলেই ফাইন। নয়তো শাস্তি হাজতবাস। পরবে ফাঁস। হাতি নাচবে পিঠে, বেঁচে থাকলে ব্যাঘ্রবাবু মেরে ফেলবে কালশিটে!’

‘আইন না কাঁচকলা। ধরতে পারলে তবে তো! না যদি তুলি গাধার পাঠশাল আমার নাম থাকবে না আর ধুরন্ধর জ্ঞানবন্ত চতুরচাঁদ শৃগাল।’

‘কেমন করে? কেমন করে?’

‘একটা কোনও ছানা ধরে, দু’জনে মিলে সাবড়ে, মাথাটা রেখে আসব গাধার দরজায়। আর কে পায়। ঘাপটি মেরে থাকব বসে, নজর রাখব কষে। দরজা খুলে অবাক গাধা যেই না বলবে এ কী! আমরা চ্যঁাচাব এ কী দেখি ঘোর কলিকাল, মাংস খেয়ে মুখ মুছে সাফ করে গাধার পাল।’

যেই না মতলব, ওমনি দেখে হরিণছানা লাফাতে লাফাতে চলেছে ইস্কুলে। বই, খাতা, দোয়াত, কলম থলেয় গলায় দোলে। শেয়াল একটুও দেরি না করে তার পথ আটকে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস রে মৃগবত্‌স?’

‘ইস্কুলে।’

‘খাজনা দে।’

‘না বেতন, না পরীক্ষা! অষ্টম শ্রেণী অব্দি সব পাশ। সব্বাই। আমাদের রাসভপণ্ডিতের পাঠশালা অবৈতনিক।’

কুমীর সুড়ুত্‌ করে এসে ছানাটাকে গিলে ফেলার মতো মস্ত হাঁ করে বলল, ‘সে আমার গুরুদক্ষিণা
আ আ আ! শুনেছিস? গাধাটা বেতন নেয় না তো কী, গুরুর গুরু শেয়ালের পাশ দিয়ে দক্ষিণে না দিয়ে যা তো দেখি। এক্ষুনি খাব কপাত্‌ করে। ওমনি যাবি মরে।’

‘তা তো ঠিকই।’ বলল হরিণছানা। তার বুঝতে বাকি রইল না যে, এ সবই তাকে সাবাড় করার ফন্দি! ভয়ে তার বুক ধুকপুক করে উঠল। আগে শেয়াল,
পিছে কুমীর। কিন্তু রাসভপণ্ডিত বলেছেন ভয়কে জয় করে হও বীর। নয়তো ত্রাস ছড়াবে দুষ্টের দল। তার ফল গুলিয়ে যাবে যুক্তি বুদ্ধি। তাই চাই জ্ঞান, তাতেই হবে জগত্‌ শুদ্ধি!

হরিণছানা সাহস করে বলল,
‘মশাই, আপনি আমায় খেলে শৃগালমশাই কেমন করে খাজনাটুকু পেলেন?’

কুমীর হেঁড়ে গলায় বলল, ‘বোকারাম! আমরা হলুম গলায় গলায় সুহৃদ, তোকে ভাগাভাগি করে খাব, তাতেই হবে হিত।’

‘শুনে খুশি হলাম। কিন্তু আমার কোন অঙ্গ কে খাবেন বিহিত হওয়া চাই। নইলে বাঁধবে যুদ্ধু। বলবে বন সুদ্দু, কুমীরে-শেয়ালে বন্ধু না ছাই।’

তাই তো! শেয়াল বলে, আমি গলা খাব। কুমীর বলে, আমিও খাব। শেয়াল চায় রানের মাংস।
কুমীরও চায়। কেউ কিছু ছাড়বে না। ঝগড়া এই লাগে কী সেই লাগে! এই সুযোগে হরিণছানা মস্ত লাফ দিয়ে বলল, ‘আমায় ধরতে পারে না!’ ছুটল সে যেদিকে বাঘের ডেরা। শেয়াল আর কুমীর তো তাকে তাড়া করল। হরিণছানা বলল, ‘যে ধরবে পাবে গলা, অন্য জন খাবে কলা।’

বলেই সে কাঁটাভর্তি কুলগাছের ঝোপের আড়ালে চলে গেল। লোভ সামলাতে না পেরে কুমীর দিল এক লাফ। হরিণছানা চেঁচিয়ে বলল, ‘বাঘমামা বাঁচাও। ছোট্ট হরিণ এই বুঝি যায় কুমীরের পেটে, শেয়ালমশাই ঝোল রাঁধবেন হরিণছানা কেটে।’

‘এত বড় স্পর্ধা! আজ নেব আমি গর্দান!’ বলেই শার্দূল সেনাপতি লম্ফ দিয়ে পড়লেন শেয়ালের ঘাড়ে। আর কুমীর গিয়ে পড়ল কুলকাঁটায়। শেয়াল কুমীর দু’জনের একেবারে নাকাল দশা! নাকের জলে চোখের জলে একাকার।

‘কেমন মজা!’ বলে তুড়ুক তুড়ুক নেচে হরিণছানা ছুটল পাঠশালার দিকে। দেরি করলেই রাসভপণ্ডিতমশাই ভগ্নাংশ কষতে দেবেন!
সে যে কী শক্ত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন