অগ্নিকিশোর!

আমার শ্বশুর ছিলেন বিপ্লবী হরিপদ ভট্টাচার্য। ‘আমি সুভাষ বলছি’ বই থেকে ‘খেলে হম জী জান সে’ ছবিতে ছড়িয়ে আছে তাঁর কথা। আমার বিয়ের পাত্রী দেখে এসে পর দিন সকালে বাবা তাঁর বিছানার পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘মেয়ের বাবা এক জন বিখ্যাত মানুষ। বিপ্লবী হরিপদ ভট্টাচার্য। মাস্টারদার অন্যতম শিষ্য এবং পুলিশের কর্তা হত্যার আসামি।

Advertisement

দেবাশিস চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

‘খেলে হম জী জান সে’ ছবিতে হরিপদবাবুর ভূমিকায় আমন গাজী (সবচেয়ে ডান দিকে, হলুদ শার্ট পরা)।

আমার বিয়ের পাত্রী দেখে এসে পর দিন সকালে বাবা তাঁর বিছানার পাশে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘মেয়ের বাবা এক জন বিখ্যাত মানুষ। বিপ্লবী হরিপদ ভট্টাচার্য। মাস্টারদার অন্যতম শিষ্য এবং পুলিশের কর্তা হত্যার আসামি। তুমি হয়তো পড়েছ তাঁর কথা ‘আমি সুভাষ বলছি’ বইয়ে। মজার কথা হল, মেয়ে দেখতে গিয়ে লেখক শৈলেশ দে’র সঙ্গে দেখা! তিনি বললেন, মেয়ে কী দেখবেন, মেয়ের বাবাকে দেখেই বিয়ে ঠিক করে ফেলুন! এত বড় এক জন সৎ ও অজাতশত্রু বিপ্লবী আমি কয়েক হাজার বিপ্লবীর মধ্যেও খুঁজে পাইনি।’

Advertisement

আমার বিয়ে হল তাঁর বড় মেয়ে শুভ্রার সঙ্গে। তখন আমি গুজরাতের আমদাবাদে চাকরি করি। কয়েক দিন পরেই, ভারতের স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী বর্ষ উপলক্ষে, দিল্লিতে কয়েক জন বিশিষ্ট বিপ্লবীকে আমন্ত্রণ জানিয়ে, তাঁদের হাতে তাম্রপত্র ও সম্মানফলক তুলে দেন ইন্দিরা গাঁধী। তাঁদের মধ্যে আমার শ্বশুরমশাইও ছিলেন। সেখান থেকে তিনি থাকতে এলেন আমদাবাদে, আমার বাসায়। সেই সময়ের খুব বিখ্যাত খবরের কাগজ ‘গুজরাত সমাচার’ পত্রিকার সম্পাদক নিরুভাই দেশাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ওঁদের আলোচনা শুনে আমি বুঝতে পারলাম, কত বড় মাপের মানুষ ছিলেন হরিপদ ভট্টাচার্য। অথচ তাঁর মৃদু মৃদু হাসি, আর নরম কথাবার্তায় মনেই হত না, ইনিই মাত্র ষোলো বছর বয়সে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ অত্যাচারী পুলিশ আধিকারিককে একা হাতে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। এ সব ঘটনার কথা পরে পড়েছি অসংখ্য সাক্ষাৎকার ও প্রতিবেদনে। তাঁর জীবনের নানা কথা দেখানো হয়েছে নট্ট কোম্পানির যাত্রা (‘মাস্টারদা’), নাটক (‘অনির্বাণ’), টিভি-ফিল্ম (‘দেশ আমার দেশ’), সিনেমায় (‘খেলে হম জী জান সে’, ‘চিটাগঙ’)। যখনই প্রশ্ন করেছি, ‘আচ্ছা, এ সব দেখে কেমন লাগে?’ উত্তরে মৃদু হেসে বলেছেন, ‘ঠিকই আছে। বলতে পারো উপরি পাওনা। আমার তো মরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি আসানুল্লাকে হত্যা করার জন্য সব ক’টা গুলিই তার ওই বিশাল শরীরে দেগে দিয়েছিলাম। ফলে আত্মহত্যা করবার সুযোগ পাইনি।’

পরে সময়ে সময়ে তাঁর বাড়িতে আসা বহু প্রখ্যাত বিপ্লবীর মুখে শুনেছি তাঁর ঘটনার কথা। যাঁদের মধ্যে গণেশ ঘোষ, কল্পনা দত্ত, অনন্ত সিংহ বা সুনীতি ঘোষের নাম করতে পারি। গ্রেফতারের পর, প্রেসিডেন্সি জেলে নেতাজি তাঁকে কোলে তুলে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। হরিপদর ফাঁসির আদেশ হবার পর দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও শরৎ বোস লড়াই চালিয়ে এই নাবালকের ফাঁসি মকুব করতে সমর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর যাবজ্জীবন কারাবাস হয়েছিল। প্রথমে আন্দামান সেলুলার জেলে এবং পরে গাঁধীজির সঙ্গে বন্দিমুক্তির চুক্তি অনুসারে ’৪৭ সালে ছাড়া পাওয়া পর্যন্ত, সতেরো বছর কারাবন্দি ছিলেন হরিপদ।

Advertisement

তিনি কমিউনিস্ট আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আন্দামানে থাকতেই। তাই জেল থেকে বেরিয়ে নেমে পড়েন পার্টির কাজে। তখন কলকাতা সরস্বতী প্রেসে একসঙ্গে থাকতেন— প্রমোদ দাশগুপ্ত, কামাখ্যা ঘোষ, গণেশ ঘোষদের সঙ্গে। দু’বছর পর, তাঁকে প্রায় ধরেবেঁধেই বিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা (যদিও তখন তাঁর সবচেয়ে ছোট ভাইও সংসার করছেন)। এর কিছু দিন পরেই কমিউনিস্ট পার্টিতে মতভেদের কারণে গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ ও তাঁকে পার্টি ত্যাগ করতে হয়। গণেশ ঘোষ পরে সিপিএম-এ যোগ দিলেও, হরিপদ ও অনন্ত সিংহ ফিরে যাননি। নিজে শিলিগুড়িতে কিছু দিন কাজ করেছেন একটি প্রতিষ্ঠানে। স্ত্রী বীণা দেবী চাকরি করতেন পুরসভা দফতরে। অতি কষ্টে একটা দশ বাই এগারো ফুটের ঘরে দুই মেয়ে নিয়ে জীবন কাটাতেন টানাটানির মধ্যে। অনেক পরে, বিপ্লবীদের সরকারি পেনশন চালু হলে, সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আসে।

ওঁর জন্ম ১৯১৪ সালে। যখন তিনি মাত্র পনেরো বছরের, সেই সময়ে মাস্টারদার জালালাবাদের যুদ্ধ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি এক বন্ধুর সাহায্যে সোজা মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করেন তাঁর গোপন আস্তানায়। তখন ইংরেজ সরকার হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে এই বিপ্লবী গুরুকে। এবং চট্টগ্রাম জেলার পুলিশ অধিকর্তা আসানুল্লা খাঁ (রায়বাহাদুর) সেই দায়িত্ব পালন করার জন্যে, সমস্ত জেলার গ্রাম-শহর তন্নতন্ন করে খুঁজে ও সাধারণ হিন্দুদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে, সৃষ্টি করেছে ভয়াবহ আতঙ্ক। ঠিক এই সময়েই মাস্টারদা কিশোর হরিপদকে হাতের কাছে পেয়ে যান। ঠিক করেন, তাঁকে দিয়েই আসানুল্লার নির্যাতনের অবসান ঘটাবেন। সেই মতো মাত্র ষোলো বছরের স্কুলছাত্র হরিপদকে দায়িত্ব দেন আসানুল্লা হত্যার। হরিপদ সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন হাসিমুখে। ১৯৩১-এর সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রাম ফুটবল মাঠে ফাইনাল খেলার দিন তিনি একা যে ভাবে আসানুল্লার মতো দাপুটে দীর্ঘদেহী মানুষটিকে খতম করেছিলেন, তা এক ‘অগ্নিকিশোর’-এর পক্ষেই সম্ভব।

ধরা পড়ার পর কী অকথ্য নির্যাতন ঘটেছিল সেই কিশোরের ওপর, তা তখনকার পত্রপত্রিকায় ফলাও করে লেখা হয়েছিল। নেহরু তাঁর ‘গ্লিমসেস অব ইন্ডিয়া’ বইতে এই ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। হরিপদর বাবাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি মনিঅর্ডার করেছিলেন, দু’লাইনের কবিতার মাধ্যমে তাঁর আশীর্বাদ জানিয়ে। হরিপদকে ১৯৩৩ সালে আন্দামান জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাঁর ছবি ও নাম খোদাই করা আছে অন্যান্য বিপ্লবীদের সঙ্গে।

বাংলাদেশ সরকার তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সম্মানিত করেছিল মুজিবুর রহমানের সময়ে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকেও তাঁকে সম্মান জানানো হয়। আন্দামান জেলে সম্মানিত হয়েছেন। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের (বামফ্রন্ট) ৩৪ বছরের শাসনকালে তাঁর জন্য কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি। শিলিগুড়িতে রাজ্য কমিটির বৈঠক চলাকালীন তিনি হাসপাতালে থাকলেও, সেই দল ও সরকারের কোনও পদস্থ ব্যক্তি তাঁকে দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। স্ত্রীর সামান্য মাইনে এবং রাজনৈতিক ভাতা দিয়ে সংসার চললেও, তাঁর চিকিৎসার (ক্যানসার) জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের, খবরটুকুও নেয়নি এই সরকার। ১৯৯৩ সালে ৩০ নভেম্বর প্রয়াত হন হরিপদ ভট্টাচার্য, তাঁর দেশবন্ধুপাড়ার ছোট্ট বাসাবাড়িতে। যে শহরে তিনি জীবনের প্রায় চারটে দশক কাটিয়ে গেলেন, সেই শিলিগুড়িতে তাঁর স্মৃতিরক্ষার কোনও চেষ্টা হয়নি, তাঁর নামে একটা রাস্তাও নেই। তাঁর শতবর্ষেও কেউ উচ্চবাচ্য করার ছিল না এই শহরে।

dchakrabortees@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement