Literature

লাখ টাকা খরচ করে রক্ষিতার বেড়ালের বিয়ে

উনিশ শতকের শিক্ষিত ভদ্রলোকরা বাবুদের অন্তঃসারশূন্য হঠাৎ-নবাবির চরিত্র তুলে এনেছেন সাহিত্যের পাতায়। 

Advertisement

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৪২
Share:

এমনটাই ছিল হুতোম কিংবা টেকচাঁদ ঠাকুরের কলমে বাবু-কালচার। তার অনেক পরে বঙ্কিমের ‘বাবু’। তবে বাংলা লেখালিখির জগতে বাবু-বৃত্তান্তের ভগীরথ এঁদের কেউ নন। ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রথম এই ধারার নকশা লেখেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জন। ঠিক দু’শো বছর আগে।

Advertisement

বয়সের ব্যবধান পঞ্চাশ বছর। তবু ঠাকুরদা-নাতির সম্পর্ক ছিল রসে ভরপুর। লেখাপড়ায় নাতির আগ্রহে তুষ্ট ঠাকুরদা কথা দিয়েছিলেন, বি এ পরীক্ষা ভাল হলে বিলেতে পাঠাবেন। যথাসময়ে নাতি তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলে ঠাকুরদা বললেন, বিলেত-খরচের অর্ধেক টাকা তিনি দেবেন, বাকি নাতিকেই জোগাড় করতে হবে বিয়ে করে, পাত্রপণ হিসেবে। দাদুর কথায় নাতির স্পষ্ট উত্তর, “দাদু, পুরুষাঙ্গ বাঁধা দিয়ে বিলেত যাব না।” গত শতকের তিরিশের দশকে এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারে ঠাকুরদা-নাতির এই কথোপকথন সমর সেনের ‘বাবু বৃত্তান্ত’ নামক আত্মকথা যাঁরা পড়েছেন, তাঁদের অজানা নয়। তাঁরা এও জানেন, সমর সেনের ঠাকুরদা ছিলেন খ্যাতিমান অধ্যাপক-গবেষক দীনেশচন্দ্র সেন। ৪৩ বছর আগে ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত এই ‘বাবু বৃত্তান্ত’। বিশিষ্ট কবি-প্রাবন্ধিক এবং সম্পাদক সমর সেন তখন ষাটোর্ধ্ব।

Advertisement

তথ্য বলছে, এ বই প্রকাশের ১০৪ বছর আগে ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘লোকরহস্য’, যেখানে ছিল ‘বাবু’ নামে তাঁর কালজয়ী রচনা। বঙ্কিমচন্দ্র ‘বাবু’ লিখেছেন তাঁর ৩৬ বছর বয়সে। ইতিহাস সাক্ষী, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাবু’-র সম্ভাবনা তৈরিতে অনেকখানি ভূমিকা নিয়েছিল সে দিনের প্রায় অর্ধশতক আগে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ বইটি। লেখক ছিলেন প্রমথনাথ শর্ম্মণ ছদ্মনামে এক বছর আটত্রিশের যুবক। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে প্রমথনাথ লিখেছেন, ‘যাঁহার চারি প পরিপূর্ণ হইবেক তিনি হাপবাবু হইবেন। প-য়ের বিবরণ পাশা পায়রা পরদার পোষাক। যাঁহার চারি প চারি খ, এই দুই পরিপূর্ণ হইবেক তিনি পুরা বাবু হইবেন। খ-য়ের বিবরণ খুসি খানকী খানা খয়রাত।… ফুলবাবু অর্থাৎ বাবু ফুল হইলেন। খলিপা সঙ্গে কখন বাগানে কখন নিজ ভবনে নানাজাতি প্রমোদিনী বিবিধ বিলাসিনী বারাঙ্গনা আনয়নপূর্ব্বক আপন মন
খুসি করিতেছেন।’

‘নববাবুবিলাস’-এর চারটি খণ্ডে প্রমথনাথ যে উনিশ শতকীয় বাংলা তথা কলকাতার এক জ্যান্ত ছবি আঁকছেন, সরিয়ে দিচ্ছেন মুখ আর মুখোশের আড়াল, তা বুঝতে দেরি হয় না। তাঁর কলমে কলকাতার বাবু কালচার ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল আর প্রমথনাথের ছদ্মনাম ভেঙে জেগে উঠছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বছরদুয়েক আগে ১৮২৩ সালে ‘কলিকাতা কমলালয়’-এর ‘বিষয়ি ভদ্রলোকের ধারা’ শীর্ষক রচনায় যিনি প্রথম আলো ফেলেছিলেন বাবুদের ওপর। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ আর কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-র কথা।

বাবুরা নিয়ন্ত্রিত হতেন খলিপা বা সুচতুর ওস্তাদের দ্বারা। খলিপা হয়তো বললেন, “কল্য বাগানে সকল রকম মজা দেখাইব; কিন্তু পাঁচ শত টাকা অদ্য ব্যয় করিতে হইবেক। বাবু কহিলেন খলিপা অদ্য আমার হস্তে একটি টাকাও নাই, সংপ্রতি টাকার কি হইবেক। খলিপা কহিল বাবুজী আমি তোমার নিকটে যত দিবস থাকিব তত দিবস টাকার নিমিত্ত মজা ভঙ্গ হইবে না, কেবল তুমি আপন নাম সহি করিয়া দিবা। বাবু আহ্লাদসাগরে মগ্ন হইয়া তাহাই স্বীকার করিলেন…।” আর মহাজন দালালদের জানালেন, “পাঁচ শত টাকা দিব দুই হাজার টাকার খত সহি করাইতে হইবেক, তোমরা দালালি সেই স্থানে লইবা; যাও বাবুর সহিত রফা কর।”—লিখেছেন ভবানীচরণ।

এই বাবু, যাঁরা বাবু কিন্তু জেন্টলম্যান নন। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক চিরকাল যাঁদের ঘৃণার চোখে দেখেছে, কোনও অর্থে আধুনিক নন যাঁরা, হঠাৎ-ধনী সেই গোষ্ঠী আঠারো শতকের শেষ পর্ব থেকেই জাঁকিয়ে বসছিল কলকাতায়। উনিশ শতকের বিশের দশকের সাহিত্য তাঁদের তুলে আনল। হুতোম লিখেছেন, “বনেদি বড় মানুষ কব্‌লাতে গেলে বাঙ্গালী সমাজে যে সরঞ্জামগুলি আবশ্যক, আমাদের বাবুদের তা সমস্তই সংগ্রহ করা হয়েচে— বাবুদের নিজের একটি দল আছে, কতকগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, কুলীনের ছেলে, বংশজ, শ্রোত্রিয়, কায়স্থ, বৈদ্য, তেলী… নিতান্ত অনুগত।” আর তাঁদের আনন্দ-যাপন? পোস্তার রাজা রাজনারায়ণ রায়ের পোষ্যপুত্র রাজা বেজেন্দর (ব্রজেন্দ্রনারায়ণ রায়) তাঁর এক রক্ষিতার বেড়ালের বিয়েতে নাকি লাখ টাকা খরচ করেন। বাড়ি ফিরে গর্বের সঙ্গে সে কথা বললে তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, অনেকে পোষা বাঁদরের বিয়েতে এর বিশ গুণ খরচ করে। সে বাঁদর যে তাঁর স্বামী স্বয়ং, তা জানাতে ভোলেননি ব্রজেন্দ্রর পত্নী। হুতোমের নকশা বেরিয়েছে উনিশ শতকের ষাটের দশকে। আর টেকচাঁদ ঠাকুর ওরফে প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এর প্রকাশকাল ১৮৫৮।

ভবানীচরণের ‘নববাবুবিলাস’ বা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাবু’ নয়। প্যারীচাঁদের ‘আলালের ঘরের দুলাল’, কালীপ্রসন্নের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’তেও নয়। বাংলা সাহিত্যে ‘বাবু’-র জন্ম আরও আগে। ১৮২১ সালে, ‘সমাচার দর্পণ’-এর পাতায়। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’-য় জানিয়েছেন, ১৮২১-এর ২৪ ফেব্রুয়ারি ও ৯ জুন ‘সমাচার দর্পণ’-এ প্রকাশিত ‘বাবুর উপাখ্যান’ নামে দু’টি রচনার কথা। বাংলায় বাবু-কথা সেই প্রথম।

সেই সূত্রে, বাংলা সাহিত্যের প্রথম বাবু রাজ চক্রবর্তী। নিবাস অমরাবতী নগর। রাজ চক্রবর্তী বিজ্ঞ, বুদ্ধিমান এবং আইনজ্ঞ। সুলতান অহম্মদ খলিফা পর্যন্ত রাজবাবুর গুণমুগ্ধ। এমন বিচক্ষণ মানুষকে তিনি আফিমকুঠির দেওয়ান নিযুক্ত করলেন। সেই পদে দু’হাতেই প্রচুর পয়সা। এত অর্থ, সম্মান, তবু বাবুর মনে বড় দুঃখ। তিনি নিঃসন্তান! শেষ পর্যন্ত সে দুঃখও ঘুচল। অধিক বয়সে এক পুত্র জন্মাল তাঁর। চারিদিকে খুশির ধুম। এলেন সেরা জ্যোতিষী। অনেক গণনা শেষে নবজাতকের নামকরণ হল তিলকচন্দ্র—‘তিলকচন্দ্রবাবু ক্রোড়ে ব্যতীত মৃত্তিকাতে পদার্পণ করেন না… দেওয়ানজী পুত্রের শরীরে যত ধরে তত স্বর্ণালঙ্কারে তাহাকে ভূষিত করিলেন দেওয়ানজীর ইচ্ছা যে স্বর্ণের ইষ্টক পুত্রের গলে দোলায়মান করত আপন ঐশ্বর্য্য প্রকাশ করেন।… বাবু (তিলকচন্দ্র) ঘুড়ী বুলবুলি প্রভৃতি খেলাতে সদা মগ্ন থাকেন লেখা পড়ার দোকান আছে কিন্তু করেন না।’ তিলকচন্দ্রের কথা পড়তে-পড়তে মনে পড়বে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর মতিলালের কথা। মতিলাল ‘পিতা মাতার নিকট আস্কারা পাইয়া পাঠশালায় যাইবার নামও করিত না।… প্রথম২ গুরুমশায়ের নিকটে গেলে মতিলাল আঁ আঁ করিয়া কান্দিয়া তাঁহাকে আঁচড় ও কামড় দিত’, গুরুমশায় তার পিতার কাছে অভিযোগ করলে, পিতা বাবুরাম বাবু বলতেন—‘ও আমার সবে ধন নীলমণি— ভুলাইয়া টুলাইয়া গায় হাত বুলাইয়া শেখাও।’

মতিলালের থেকে বছর সাঁইত্রিশের সিনিয়র তিলকচন্দ্র। তাই তাঁর ক্রিয়াকর্ম আরও প্রকট। তিনি কথা ফোটা থেকেই সকলকে কটু কথা বলেন, মারধর করেন। কিন্তু বাবুর ছেলে, ভাবী বাবু তিনি, তাই সকলেই এতে আমোদ পান। বয়স বাড়ে তিলকচন্দ্রের। তিনি দেখেন, সকলেই তাঁকে মান্যি করে, নানা কাজে পরামর্শ নেয়, স্তবস্তুতি ও প্রশংসায় ভরিয়ে রাখে। তাতে ‘বাবু অন্তঃকরণে স্ফীত হইয়া মনে২ করেন যে আশ্চর্য্য আমি আপ্ত বিস্মৃত সকলেই আমাকে বিজ্ঞ ও পণ্ডিত কহে আর আমার আপনাআপনিও বোধ হয় যে আমি পণ্ডিত বটি তবে কি নিমিত্তে অন্য২ লোকের মত ক্লেশ লয়ে বিদ্যা শিক্ষা করিব আমি মুহরী কিম্বা মুণ্‌সী অথবা কেরাণী গিরি করিব না… এ অনিত্য সংসারে কেবল শারীরিক সুখ ভোগই সত্য কোন দিন মরিয়া যাইব যত সুখ করিয়া লইতে পারি সেই কর্ত্তব্য…।’ অতএব, নির্দ্বিধায়, অবলীলায় তিনি বাবার উপার্জিত বিপুল ধনরাশি ওড়াতে লাগলেন। বাবার মৃত্যুর পর তিনিই হলেন বাবু। তাঁর মনে নানা সময়ে নানা শখ জাগে। এক বার শখ হল, সাহেব লোকের মতো হওয়া। কী ভাবে সাহেব হবেন তিনি?

সাহেবদের স্বভাব সকাল-বিকেল গাড়িতে বা ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যাওয়া। তিনিও চাকরকে ডেকে হুকুম দিলেন, ঘোড়া তৈরি রেখে সকালে তোপ ডাকার আগে যেন তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া হয়। সারা রাত গণিকালয়ে কাটিয়ে বাবু ফিরলেন শেষ রাতে। চোখ বুজতে-না-বুজতেই ঘুম ভাঙানো হল তাঁর, ঘুম চোখেই তিনি সওয়ার ঘোড়ার পিঠে। সে ঘোড়াও আবার বাবুকে পিঠ থেকে ছাইয়ের গাদায় ফেলে দিল। বাবু মুখে-হাতে ছাই মেখে সহিসের কাঁধে ভর দিয়ে বাড়ি ফিরলেন। তবু বাবুর এক গোঁ, সাহেব তাঁকে হতেই হবে। এ বার বাবু ভাবলেন, সাহেবদের কথার নড়চড় হয় না। অতএব তাঁকেও এক কথার লোক হতে হবে। সে দিন তাঁর কাছে এক দরিদ্র নিজের বাপ-মায়ের মৃত্যুর কথা বলে কিছু সাহায্য প্রার্থনা করেন। হঠাৎ কী মনে হল, বাবু বলে দিলেন কোনও সাহায্য হবে না। তাঁর এক কথা। তিলকচন্দ্রের এমন অভূতপূর্ব কাণ্ড দেখে কোনও কোনও মানী লোক সাহায্যপ্রার্থীর হয়ে বাবুর কাছে সুপারিশ করলে নিজেকে সাহেবতুল্য ভাবতে শুরু করা বাবুর জবাব—‘তোমরা কি আমাকে বাঙ্গালির মত করিতে কহ একবার বলিয়াছি দিব না পুনরায় দিলে আমার কথা মিথ্যা হইবেক আমার প্রাণ থাকিতেও ইহা হইবেক না মানুষের একই কথা।’ গরিব লোকটির কপাল পুড়ল, কিন্তু বাবু আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে যে, এ বার সকলে বুঝবে সাহেবদের মতো তিনিও এক কথার মানুষ।

বাংলা গদ্যের প্রকাশ এবং যথার্থ বিকাশ ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল উনিশ শতকের শুরু থেকে। শ্রীরামপুর মিশনে গদ্যের আঁতুড়ঘরেই জন্ম হয়েছিল বাংলার প্রথম সাময়িকপত্র ‘দিগ্‌দর্শন’-এর। কলকাতা অবশ্য এর কিছু আগে সংবাদপত্র দেখেছিল। শ্বেতাঙ্গ সমাজে ছিল ইংরেজি সাময়িকের প্রচলন। স্পষ্টবক্তা ও প্রতিবাদী হিকি সাহেব শ্বেতাঙ্গ রাজপুরুষদের কেচ্ছা ও কোম্পানির অনাচারের কথা প্রচার করে কী ভয়ানক রোষানলে পড়েছিলেন, কলকাতা জানত তাও। এ সব আঠারো শতকের শেষের দিকের ঘটনা। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বেরোল মাসিক ‘দিগ্‌দর্শন’। কিন্তু সূচনায় এই প্রয়াস সাফল্য পেল না। ২৩ মে, ১৮১৮-তে মিশনারিরা প্রকাশ করলেন নতুন একটি সাপ্তাহিক—‘সমাচার দর্পণ’। ‘সমাচার দর্পণ’-এ ছিল সমসাময়িক সমাজ জীবনের দিকে তাকানোর প্রয়াস, যা ‘দিগ্‌দর্শন’-এ ছিল না। আজকের সংবাদপত্রের মতো সেখানে প্রকাশিত হত নবনির্মিত পথ, ডাকঘর, জলাশয়, ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা বা সংস্কার, নতুন বই প্রকাশ, চুরি ডাকাতির খবরের পাশাপাশি সে কালে বালিকাদের কুস্তির অনুশীলন, বাঙালি রমণীর বাঘ মারার খবর পর্যন্ত। এ সবের সঙ্গে সমাজকে বাঁকা চোখে দেখার প্রথম প্রয়াসও ছিল মার্শম্যান সম্পাদিত কাগজটির। সেই সূত্রেই ‘বাবুর উপাখ্যান’ এর প্রকাশ। ‘সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা’ নামক বইয়ের সম্পাদক অরুণ নাগও জানাচ্ছেন—‘বাবুর উপাখ্যান নামক সমাচার দর্পণে (২৪.২ ও ৯.৬.১৮২১ খ্রি.) প্রকাশিত রচনাটি বাংলা নকশা সাহিত্যের আদি উদাহরণ।’ কিন্তু রচনাটির লেখক কে?

‘সমাচার দর্পণে’ দুই পর্বে প্রকাশিত সেই নক্শায় লেখকের নাম ছিল না। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮২১-এ প্রকাশিত লেখার শেষে সম্পাদকের মন্তব্য ছিল— ‘এই উপাখ্যান প্রচ্ছন্নরূপে কোন অজ্ঞাত লোক পাঠাইয়াছিলেন অতএব ছাপান গেল।’ পরে অনেকেই অনুমান করেন ‘বাবুর উপাখ্যান’-এর লেখক আর কেউ নন, ‘নববাবুবিলাস’ রচয়িতা সেই ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ই। বাবু-সংস্কৃতি ও বাংলা সাহিত্য বিষয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত অধ্যাপক গার্গী সরকারের কথায়, “এটা এখন আর অনুমান নয়, নিশ্চিত যে, সমাচার দর্পণে ‘বাবুর উপাখ্যান’-এর লেখক হিসেবে কথিত সেই ‘প্রচ্ছন্নরূপে অজ্ঞাত লোকটি’ আসলে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।”

উনিশ শতকের নকশাগুলি লেখা ভঙ্গিসর্বস্ব বাবুদের নিয়ে। প্রাবন্ধিক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর ‘বাংলা উপন্যাস : দ্বান্দ্বিক দর্পণ’ বইয়ে লিখেছেন, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাবু আর ভদ্রলোক, এই দুটি শব্দের শ্রেণিগত তাৎপর্য এবং সামাজিক ভূমিকা স্পষ্ট হতে শুরু করল— ‘বাবু একটা ভঙ্গি, ভদ্রলোক একটা সত্যাভিপ্রায়ী ব্যক্তি।… ‘বাবু’ কথাটি মাত্র পরিচয়জ্ঞাপক, ‘ভদ্রলোক’ চরিত্রজ্ঞাপক।’ উনিশ শতকের শিক্ষিত ভদ্রলোকরা বাবুদের অন্তঃসারশূন্য হঠাৎ-নবাবির চরিত্র তুলে এনেছেন সাহিত্যের পাতায়।

বিশ শতকে সমর সেন ‘বাবু’ অর্থে বোঝান মধ্যবিত্ত বাঙালিকে। ১৮২১-পরবর্তী ২০০ বছরে আরও অনেকেই বাবু-কথা লিখেছেন বটে, তবু সমর সেনে এসে থামতে হল। কারণ, তিনি বলে গেছেন, ‘বাবু বৃত্তান্তে আমার ও বন্ধুবান্ধবদের অনেক কথা ইচ্ছে করে লিখিনি।… আমার বন্ধু ও বান্ধবী ভাগ্য—আঠারো বছর বয়স থেকে— সামান্য নয়, কিন্তু তাঁদের বিষয়ে লিখতে গেলে খেই পাব না। কয়েকজনের প্রভাব আমার (একদা) সাহিত্যিক ও ব্যক্তিগত জীবনযাত্রায় ব্যাপক কিন্তু এ মুহূর্তে সেটা চেপে যাওয়া ভালো। মধ্যবিত্তদের দৌড় সুবিদিত।’

এই কলমচিও মধ্যবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। তাই এখানেই থেমে যেতে হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন