জেন্টলম্যান: নীরবতাই প্রতিবাদ ছিল বেনেগাল রামা রাও-এর
শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করলেন বেনেগাল রামা রাও। কেনই বা করবেন না? কাঁহাতক আর এমন ‘দুর্ব্যবহার’ সহ্য করা যায়!
সময়টা ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি। বেনেগাল তখনও রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর। অর্থমন্ত্রী তিরুভেলর থাট্টাই কৃষ্ণমাচারি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে অন্তত তিন বার ‘রুক্ষতা’, ‘রুক্ষ ভাষা’ ও ‘রুক্ষ ব্যবহার’-এর নালিশ করেছেন তিনি। এই নিয়ে নেহরুর সঙ্গে তাঁর বার কয়েক চিঠি চালাচালিও হয়।
১৯৪৯-এর ১ জুলাই থেকে ১৪ জানুয়ারি ১৯৫৭ পর্যন্ত টানা সাড়ে সাত বছর রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর পদে থাকার রেকর্ড যাঁর, সেই রামা রাওকে সরতে হয়েছিল কেন?
সংবাদমাধ্যম থেকে বহু বার ছিটকে এসেছে প্রশ্নটা। কিন্তু বেনেগাল নিজে কখনও এ প্রসঙ্গে একটি শব্দও খরচ করেননি। ১৯৯৮ সালে রিজার্ভ ব্যাংক তার ইতিহাসের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশ করার আগে পর্যন্ত তা অজ্ঞাতই ছিল। সেই বইয়ে ১৯৫১ থেকে ১৯৬৭ সালের নানা ঘটনার উল্লেখ রয়েছে। আছে কৃষ্ণমাচারি-বেনেগাল প্রসঙ্গও।
আর রিজার্ভ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রকের দ্বৈরথ সম্পর্কে বি কে (ব্রজকুমার) নেহরু তাঁর আত্মজীবনী ‘নাইস গাইজ ফিনিশ সেকেন্ড’ গ্রন্থে বিশদ লিখেছেন। ব্রজকুমার তখন অর্থমন্ত্রকের যুগ্মসচিব। লিখছেন, ‘ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানির চেয়ারম্যান স্যর বীরেন মুখোপাধ্যায় আর আমি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁর চেম্বারের পাশের ঘরে অপেক্ষা করছিলাম। কৃষ্ণমাচারি এক দরজা দিয়ে ঢুকলেন, অন্য দরজা দিয়ে বেনেগাল। কৃষ্ণমাচারি কোনও রাখঢাক না রেখে আক্রমণ শানালেন, যতটা তারস্বরে সম্ভব। শান্ত স্বভাবের বেনেগাল বুঝতে পারছেন না, কী ভাবে এই অভাবনীয় হামলার মোকাবিলা করবেন। বীরেন আর আমি দরজা দিয়ে বারান্দায় সরে পড়লাম।’
রিজার্ভ ব্যাংক কি আদৌ স্বশাসিত সংস্থা, না কি অর্থমন্ত্রকের অধীন একটি বিভাগ মাত্র? এই বিতর্ক প্রথম ওঠে যখন মাদ্রাজের (এখন চেন্নাই) দুই বাসিন্দা বেনেগাল ও কৃষ্ণমাচারি দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। কৃষ্ণমাচারি মনে করতেন, তিনিই সব জানেন, অন্যেরা কেউ কিছু জানে না। নানা ভাবে বুঝিয়ে দিতেন, রিজার্ভ ব্যাংক আদতে অর্থ মন্ত্রকেরই অধীনস্থ সংস্থা। দুজনের আকচাআকচির এটাও একটা কারণ।
১৯৬৪ সালের ১৫ অগস্ট। রিজার্ভ ব্যাংক আবাসনে পালিত হচ্ছে স্বাধীনতা দিবস। বিশেষ অতিথি বেনেগাল রামা রাও। কয়েক মাস আগে মারা গিয়েছেন জওহরলাল নেহরু। উৎসুক সকলে ছেঁকে ধরলেন বেনেগালকে। সাত বছর আগে তাঁর পদত্যাগের নেপথ্য গল্প বলতে হবে, এই সভাতেই। বলতে উঠে মৃদু হেসে বেনেগাল শুধু বললেন, ‘সেই মহান মানুষদের স্মরণ করি, যাঁরা আমাদের জীবনে এই বিশেষ দিনটি এনেছেন। এঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মহাত্মা গাঁধী ও জওহরলাল নেহরু।’
সেই নেহরু, যিনি এক দিন সমবায় আন্দোলনের নেতা বৈকুণ্ঠলাল মেটাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, রিজার্ভ ব্যাংক স্বশাসিত থাকাই বাঞ্ছনীয়। আর তার কিছু দিন পরেই কৃষ্ণমাচারির পক্ষ নিয়ে যিনি বেনেগালকে জানিয়ে দেন, রিজার্ভ ব্যাংক ‘নিশ্চিত ভাবেই সরকারি কর্মকাণ্ডের অংশ...এর সঙ্গে তাল মিলিয়েই তাকে চলতে হবে।’ ওই চিঠি পেয়ে রামা রাও পদত্যাগ করতে চাইলে নেহরুর ছোট্ট জবাব ছিল: একান্তই যদি যেতে হয় তো যান, ‘চাইলে অর্থমন্ত্রকে আপনার পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিতে পারেন।’
বিনা বাক্যব্যয়ে বেনেগাল সেটাই করেছিলেন। সে দিনও পদত্যাগের কারণ উল্লেখ করেননি, পরেও নয়। যত দিন বেঁচে ছিলেন, নীরবতাই আঁকড়ে থেকেছেন।