চন্দ্রগুপ্ত

রুখু আর চন্দ্রগুপ্তকে পড়াতে বসেছিলেন ঠাকুরদা। ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্কস-এ ওয়ার্ড বসাতে বসাতে রুখু আড়চোখে দেখল, চন্দ্রগুপ্ত তার দিকে চেয়ে চোখ মটকাচ্ছে। রাগ ধরে গেল রুখুর। বড় ফাজিল চন্দ্রগুপ্ত!

Advertisement

সৌভিক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০০:৪৮
Share:

রুখু আর চন্দ্রগুপ্তকে পড়াতে বসেছিলেন ঠাকুরদা। ফিল ইন দ্য ব্ল্যাঙ্কস-এ ওয়ার্ড বসাতে বসাতে রুখু আড়চোখে দেখল, চন্দ্রগুপ্ত তার দিকে চেয়ে চোখ মটকাচ্ছে। রাগ ধরে গেল রুখুর। বড় ফাজিল চন্দ্রগুপ্ত!

Advertisement

রুখু নালিশ করল, ‘দাদা, চন্দ্রগুপ্ত পড়ছে না।’

ঠাকুরদা কিছু বলার আগেই চেয়ার থেকে লাফ মেরে নামল চন্দ্রগুপ্ত। তার পর চোখের নিমেষে জানলা গলে পালিয়ে গেল।

Advertisement

দৃশ্যটা দেখে ঠাকুরদা রুখুকে বললেন, ‘ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ওকে মানুষ করতে পারব না। তুমি লেখো।’

রোজ সকালে রুখুকে নিয়ে হাঁটতে বেরোতেন ঠাকুরদা। হাঁটতে হাঁটতে গল্প বলতেন। গাছ চেনাতেন রুখুকে, ‘ওটা জারুল। আর ওই যে ঝিরিঝিরি পাতায় বাতাস খেলা করছে ওটা তেঁতুল গাছ। আর এইটা দেবদারু। দেবদারু পাতায় রোদ্দুর আরাম করে বসতে পারে না। বারবার পিছলে যায়।’

এই রকমই একটা সকালে রাস্তার ধার থেকে চন্দ্রগুপ্তকে উদ্ধার করেছিলেন ঠাকুরদা। বাড়িতে নিয়ে আসার পর ঠাম্মা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন, ‘কিছুতেই না। বিড়াল পোষা চলবে না। বিড়াল অতি ছোঁচা প্রাণী। তার ওপর নোংরা করে লুকিয়ে রাখে। এই মুহূর্তে বিদায় করো। রোজ রোজ দাদু আর নাতির এই পাগলামি চলবে না। বৌমা দেখে যাও কী কাণ্ড!’

রুখুর বাবা আর মা দরজায় দাঁড়িয়ে হাসছিলেন। এতটুকু ফারের বলটাকে কোলে নিয়ে দাদু বলেছিলেন, ‘এ বিড়াল সে বিড়াল নয়। ও একাই পাঁচ-পাঁচটা কাকের সঙ্গে লড়াই করছিল। ওর মধ্যে বিরাট প্রতিভা সুপ্ত আছে। ওর নাম দিয়েছি চন্দ্রগুপ্ত। ও তো আসলে ফাইটার, যোদ্ধা। আমি ওর দায়িত্ব নিলাম। ওকে আমি মানুষ করব।’

সেই থেকে বাড়িতে রয়ে গেল চন্দ্রগুপ্ত। ঠাকুরদা তাকে মানুষ করার সঙ্কল্প করেছিলেন। কিন্তু কিছু দিন পর থেকেই ঠাকুরদাকে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করে সে তার বিড়ালত্বের প্রমাণ দিতে শুরু করল। এই হয়তো একটা ইঁদুর মেরে ঘরের মধ্যে আনছে তো ওমনি ঠাম্মার শাড়ি ধরে ঝুল খাচ্ছে। তার দৌরাত্ম্যে অস্থির বাড়ির সবাই। তা সত্ত্বেও সবারই কেমন একটা মায়া পড়ে যাচ্ছিল চন্দ্রগুপ্তের ওপর। এক দিন তো ঠাম্মার হাত থেকে ট্যাংরা মাছের মুড়ো খাচ্ছিল চন্দ্রগুপ্ত। যদিও রুখুর বাবা এটা দেখে ফেলায় চন্দ্রগুপ্তকে একটা লোক দেখানো ধমক দিয়েছিলেন ঠাম্মা। কিন্তু ঠাম্মার হাসি হাসি মুখ আর চন্দ্রগুপ্তের আরামে বুজে আসা চোখের কল্যাণে ধমকটা তেমন জমেনি।

তবে হাল ছাড়েনি ঠাকুরদা। রোজ সকালে রুখু আর চন্দ্রগুপ্তকে পড়াতে বসেন। জাতকের গল্প থেকে শুরু করে গ্রামার পর্যন্ত সবই শেখানোর চেষ্টা করেন। তবে চন্দ্রগুপ্ত বড়ই অমনোযোগী। এখনও কিছুই শিখে উঠতে পারেনি। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে ঠাকুরদা বলেন, ‘ওকে আর মানুষ করতে পারব না মনে হচ্ছে।’

এক দিন পাশের বাড়ি থেকে মাছ চুরি করল চন্দ্রগুপ্ত। পাশের বাড়ির কাকিমা এসে নালিশ করলেন। ঠাম্মা সারা দিন গজগজ করলেন, ‘তখনই বলেছিলাম আপদ ঘরে তুলো না। বিড়াল নাকি মানুষ হবে। কী আহ্লাদের কথা। যত্তোসব।’ ঠাকুরদা মনমরা হয়ে রইলেন।

রুখু ঠাম্মা, ঠাকুরদার পাশে শোয়। সে দিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তার। সে বুঝতে পারল ঠাকুরদা কার সঙ্গে একটা কথা বলছেন। কিন্তু ঠাম্মা তো দিব্যি ঘুমোচ্ছেন। রুখু পাশ ফিরে অবাক হয়ে গেল। অন্ধকার ঘরে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়েছে। একটা চেয়ারে বসে আছেন ঠাকুরদা। টেবিলের ওপর মুখোমুখি চন্দ্রগুপ্ত। ঠাকুরদা বলছেন, ‘কেন না বলে মাছ নিলে? তুমি তো রাজা। প্রজার উদ্বৃত্ত অন্নে তোমার অধিকার, ক্ষুধার অন্নে নয়।’

কেমন একটা গা শিরশির করে উঠল রুখুর। তা ছাড়া ‘উদ্বৃত্ত’ কথাটার মানে বুঝতে পারেনি সে। কাল সকালে জেনে নিতে হবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল রুখু।

এ ভাবেই দিন কাটছিল কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন ঠাকুরদা। তাঁর কথা বন্ধ হয়ে গেল। হাঁটতে পারেন না। বিছানায় শুয়ে কেবল তাকিয়ে থাকেন। মাঝে মাঝে চন্দ্রগুপ্ত এসে তাঁর বিছানায় বসে। তাঁর নিষ্প্রভ চোখের মণি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

এক দিন স্কুল থেকে ফিরে রুখু দেখল, বাড়িতে অনেক লোক। বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা অ্যাম্বুল্যান্স। সেটা নীল আলো জ্বালিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে ঠাকুরদাকে নিয়ে চলে গেল। সাইরেনের শব্দটা কান্নার মতো শোনাল। আর ফিরে এলেন না ঠাকুরদা।

দিন দুয়েক পরে বাড়িতে সবাই খুব কাঁদছিল। রুখু জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, কী হয়েছে? সবাই কাঁদছে কেন? দাদা কবে আসবে?’

বাবা রুখুকে কোলে নিয়ে বললেন, ‘রুখুবাবা, দাদা তো আর আসবে না।’

‘কেন? দাদা কি আকাশের তারা হয়ে গেছে?’

‘না রুখুবাবা। ওটা ভুল কথা। মানুষ কখনও আকাশের তারা হয় না। তোর দাদা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। সবাইকেই এক দিন চলে যেতে হয়। মন খারাপ করিস না। দাদা নেই তো কী হয়েছে, দাদার সঙ্গে যে সুন্দর সময় কাটিয়েছিস সেগুলো তো তোর মনে আছে। তাই না?’

ঘাড় নেড়ে রুখু বলেছিল, ‘হ্যাঁ বাবা, মনে আছে তো।’

‘সেগুলো কখনও ভুলিস না। তোর দাদা ওভাবেই তোর সঙ্গে থাকবে।’

সব কিছুর মতো শোকও থিতিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সবই আগের মতো চলতে লাগল। বাবার অফিস, রুখুর স্কুল। কিন্তু দু’জন একদম পালটে গেল। ঠাম্মা আর চন্দ্রগুপ্ত।

ঠাম্মা মাছ খেতে এত ভালবাসতেন, মাছ খাওয়া ছেড়ে দিলেন। নিজে রান্না করে খেতে শুরু করলেন। আর চন্দ্রগুপ্ত অদ্ভুত ভাবে ঝিমিয়ে পড়ল। সে এখন একেবারেই দুরন্তপনা করে না। প্রায় সারাদিনই ঠাকুরদার খাটের ওপর গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। অনেক সাধাসাধি করলে ফেলে ছড়িয়ে একটু খাবার খায়।

কিছু দিন পর ঠাম্মার শরীরটাও খারাপ হয়ে গেল। রুখুর বাবা বললেন, ‘প্রোটিন না খেলে শরীর তো খারাপ করবেই। এত নিয়ম মানলে চলবে না।’

ঠাম্মা বললেন, ‘তা বললে কী করে হবে? ও সব খাবার আমি আর খাব না।’

‘তুমি তো খেতে ভালবাসতে।’

‘যখন বাসতাম তখন বাসতাম।। এখন আর বাসি না।’

‘নিয়ম আগে না শরীর আগে?’

‘নিয়ম।’

‘বাবা তোমায় বলেছে তুমি মাছ, মাংস না খেলে খুশি হবে?’

‘জানি না। তর্ক করিস না।’

মা ছেলেতে একপ্রস্থ রাগারাগি হয়ে গেল। কিন্তু টলানো গেল না ঠাম্মাকে। দিন দিন অসুস্থতা বাড়তে থাকল। শেষমেশ ঠাম্মাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হল।

এ দিকে চন্দ্রগুপ্ত খাওয়াদাওয়া একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। হাড় জিরজিরে চেহারা হয়েছে। সারা দিন এক জায়গায় বসে ধোঁকে। তাকে দেখে এক দিন কেঁদে ফেললেন রুখুর মা।

বারো দিন পরে হাসপাতাল থেকে ছুটি পেলেন ঠাম্মা। ডাক্তারের কড়া হুকুম— মাছ, মাংস সব খেতে হবে। রুখুর বাবা এক দিন জেদ করে উপোস করে রইলেন, ‘মা মাছ না খেলে আমিও কিছু খাব না।’

ছেলের জেদের কাছে হার মানল মা।

রুখুদের বাড়িতে সে দিন সাজো সাজো রব। ঠাম্মার প্রিয় তেল কই, মৌরলা মাছের টক, ট্যাংরা মাছের ঝাল রান্না করেছেন রুখুর মা। ঠাম্মা খেতে বসেছেন। ঠাম্মাকে ঘিরে ওরা তিন জন। ঠাম্মা লাজুক মুখে একটুখানি মাছ ভেঙে মুখে দিলেন। হঠাৎ ঝনঝন শব্দে চমকে উঠল সবাই।

রান্নাঘর থেকে শব্দটা এসেছে। দেখা গেল, রাতের জন্য তুলে রাখা মাছের ঝালের বাটি উলটে দিয়ে সবচেয়ে বড় কইমাছটা মুখে নিয়ে বসে আছে চন্দ্রগুপ্ত।

সবাই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতেই রুখুর দিকে চেয়ে চোখ মটকে দিল চন্দ্রগুপ্ত। রুখুর বাবা বললেন, ‘বাঁদরটা আর মানুষ হল না।’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement