খু দ কুঁ ড়ো

অঙ্ক ক্লাসের চার্লি চ্যাপলিন

স্য রদের খ্যাপানোর নাম দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের বহু পুরনো ট্র্যাডিশন। তবে সব স্যর নন, যাঁরা একটু বাতিকগ্রস্ত, রাগী বা গম্ভীর, বা যাঁদের কোনও মুদ্রাদোষ আছে, তাঁদেরই আদর করে নাম দেওয়া হয়। আর এই নাম এক বার দেওয়া হলে সেই নাম বছরের পর বছর পরম্পরায় চলতে থাকে, আর বদলায় না। নাম দেওয়ার মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের অদ্ভুত উদ্ভাবনী বুদ্ধিরও পরিচয় থাকে।

Advertisement

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৬ ০০:০৩
Share:

স্য রদের খ্যাপানোর নাম দেওয়া ছাত্রছাত্রীদের বহু পুরনো ট্র্যাডিশন। তবে সব স্যর নন, যাঁরা একটু বাতিকগ্রস্ত, রাগী বা গম্ভীর, বা যাঁদের কোনও মুদ্রাদোষ আছে, তাঁদেরই আদর করে নাম দেওয়া হয়। আর এই নাম এক বার দেওয়া হলে সেই নাম বছরের পর বছর পরম্পরায় চলতে থাকে, আর বদলায় না। নাম দেওয়ার মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের অদ্ভুত উদ্ভাবনী বুদ্ধিরও পরিচয় থাকে।

Advertisement

যখন কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্কুলে ক্লাস টেন-এ ভর্তি হয়েছিলাম, তখন আমি সদ্য-কিশোর। থাকতাম স্কুল চত্বরের মধ্যেই হোস্টেলে। আর একটু কম বয়সে আমি যে প্রচণ্ড দুষ্টু ছিলাম, সেই দুষ্টুমি তখন অনেকটাই প্রশমিত। তবে সত্যি কথা বলতে কী, দুষ্টুমি আমাকে পুরোপুরি কখনও ছেড়ে যায়নি। তার কিছু রেশ এখনও আমার মধ্যে আছে।

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর কিছু দিন মুখচোরা ভাবটা ছিল। তার পরই আমি স্বমূর্তিতে প্রকাশ হলাম। তবে আমার দুষ্টুমি তখন খেলার মাঠে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ক্রিকেট, ফুটবলে যত অনুরাগ, লেখাপড়ায় তার কণামাত্র নয়। তবু পরীক্ষার আগে মাসখানেক পড়লেই অঙ্ক বাদে অন্য বিষয়ে ভদ্রস্থ নম্বর পেয়ে যেতাম। অঙ্ক চল্লিশের ঘরের বেশি এগোত না।

Advertisement

আমাদের ইতিহাসের বসন্তবাবুকে ছেলেরা বলত গোরিলা স্যর। খুবই অন্যায্য নাম। কারণ বসন্তবাবু রোগা, লম্বা, ফরসা মানুষ। গোরিলার সঙ্গে তাঁর বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। কিন্তু অঙ্কের স্যর কালীবাবুর নাম চার্লি অনেকটা যথাযথ। কালীবাবু নাতিদীর্ঘ, কালো, চার্লি চ্যাপলিনের মতো গোঁফ। কিন্তু তাঁকে দেখে হাসি পেত না মোটেই। অঙ্ক-পাগল মানুষ ছিলেন। ক্লাসে ঢুকেই ব্ল্যাকবোর্ডে অঙ্ক লিখতে শুরু করতেন। রাগী বা রগচটা নন, কিন্তু খুব সিরিয়াস।

যখন হোস্টেলে থাকতাম, তখন ঘরে পরার জন্য হাওয়াই চটি আবিষ্কার হয়নি। আর আমাদেরও চটি কেনার মতো পয়সার জোর ছিল না। আমরা সবাই তখন সস্তার খড়ম কিনে ঘরে পরতাম। স্ট্র্যাপ লাগানো খড়ম দিব্যি জিনিস। লয়ক্ষয় নেই, বহু দিন পরা যেত। দোষের মধ্যে একটু খটাং খটাং শব্দ হত। স্কুল চত্বরে থাকতাম বলেই ক্লাসে যেতাম একদম শেষ মুহূর্তে এবং ঘরে পরার খড়ম পায়ে দিয়েই। ধরা পড়লে অবশ্য মুশকিল ছিল।

সে দিন প্রথমেই কালীবাবুর ক্লাস। উনি ক্লাসে এসে সবে ঢুকেছেন, হঠাৎ কেন কে জানে, আমার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধির উদয় হল। আমি হঠাৎ পায়ের খড়ম-জো়ড়া দিয়ে খটাখট খটাখট কয়েক বার শব্দ করলাম।

এই বেআদবিতে কালীবাবু ভীষণ চটে গিয়ে ‘কে শব্দ করল? কে খড়ম পরে এসেছে?’ বলে উত্তেজিত ভাবে পোডিয়াম থেকে নেমে এলেন। আমার ঠিক পিছনেই বসেছিল সুকুমার। সে আমাকে বাঁচানোর জন্য চট করে নিচু হয়ে আমার খড়মদুটো পা থেকে খুলে নিয়ে দরজা দিয়ে ছুড়ে স্কুলের মাঠে ফেলে দিল।

ধরা পড়ল চিন্ময়। সে হোস্টেলে থাকত না, কী কুক্ষণে সে দিন ভুল করে খড়ম পরে চলে এসেছিল। সে যত বোঝানোর চেষ্টা করে, শব্দটা করেনি, কালীবাবু ততই রেগে যান। কেসটা হেডস্যরের কাছে যাওয়ার উপক্রম। আর হেডস্যর হলেন স্কুলের হৃৎকম্প।

ব্যাপারটা কাপুরুষোচিত হয়ে যাচ্ছে দেখে অগত্যা উঠে দাঁড়িয়ে কবুল করলাম, আমিই অপরাধী। কিন্তু কালীবাবু আমার খালি পা দেখে কথাটা বিশ্বাস করলেন না। ঘটনাটা বিস্তারিত বলার পর রাগে আত্মহারা কালীবাবু কী করবেন তা ঠিক করতে পারছিলেন না। খানিক পায়চারি করলেন, চক-ডাস্টার ছুড়ে ফেললেন, পোডিয়ামে বার কয়েক উঠলেন নামলেন। হুবহু চার্লি চ্যাপলিনের মতোই লাগছিল তাঁকে। অবশেষে অসহায় রাগে যে শাস্তিটা ঘোষণা করলেন তাও বড় করুণ। বললেন, খুব সাবধান! এর পর থেকে তোমার ওপর স্পেশাল নজর রাখা হবে।

টেস্ট পরীক্ষার অঙ্কে যথারীতি খুব খারাপ নম্বর। খেলাধূলায় ভাল ছিলাম বলে হেডস্যর সতীশ ভৌমিকের নেকনজরে ছিলাম। মার্কশিট দেখে আমাকে ডেকে থমথমে মুখে বললেন, ফাইনালে এ রকম নম্বর পেলে আগাপাছতলা বেত খাওয়ার জন্য তৈরি থাকিস। বাড়িতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম। গম্ভীর মুখে বললেন, হোস্টেলে গিয়া তো দেখি পাখনা গজাইছে।

বিপদ বুঝে এক দিন কালীবাবুর কাছে গিয়ে মিনমিন করে বললাম, স্যর, আমাকে পড়াবেন? আমাকে দেখে মোটেই খুশি হলেন না তিনি। একটু যেন সচকিত হয়ে বললেন, ওঃ তুমি?

খুশি না হলেও পড়াতে রাজি হলেন। তিনি স্কুলের পর ক্লাসরুমেই একসঙ্গে কয়েক জনকে পড়াতেন। শুধু অঙ্ক। আমরা যে যার হ্যারিকেন নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছে অঙ্ক কষতাম। আর বলতে নেই, জীবনে সেই প্রথম বোধহয় অঙ্ক ব্যাপারটাকে আমি খানিকটা আস্বাদন করতে শুরু করি। বিশেষ করে অ্যালজেব্রা। তার ভিতরে যে মজাটা আছে কালীবাবু অত্যন্ত সহজে সেটা ধরিয়ে দিলেন। আর এমন তন্ময় হয়ে পড়াতেন এবং পড়াতে পড়াতে আবেগে উত্তেজিত হয়ে মাঝে মাঝে এমন ভাবে কথার খেই হারিয়ে ফেলতেন যে আমার লোকটাকে দেখে অবাক লাগত। অঙ্কের মদিরা আকণ্ঠ পান করা এক জন মানুষ! তিনি কাউকে পাশ করিয়ে দেওয়ার জন্য পড়াতেন না। ও সব তাঁর মাথাতেই ছিল না। তিনি শুধু অঙ্কের রূপকথার রাজ্যে আমাদের টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন।

মাত্র মাস দুই তাঁর কাছে অঙ্ক শিখেছিলাম। আর তাতেই স্কুল ফাইনালের চূড়ান্ত পরীক্ষায় আমার অঙ্কের নম্বর অনেককে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সামান্য বেতনের এক জন স্কুলশিক্ষক ছিলেন বটে, তেমন সফল কোনও মানুষও নন। তবু কালীবাবুকে আমার এক জন ক্ষণজন্মা মানুষ বলে মনে হয়। তাঁর জন্যই অঙ্ককে আমি শ্রদ্ধা করতে শিখেছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন