গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
চোখ ধাঁধানো সোনার ব্লাউজ় ছিল না সে দিন সুনন্দিনীর অঙ্গে। সত্যি বলতে, আদপে ছিল না কোনও ব্লাউজ়। শাড়ি এবং গয়নায় এমন সাজানো হয়েছিল তাঁকে যে, মনে হচ্ছিল অঙ্গে মহার্ঘ এক ব্লাউজ়।
সুনন্দিনীর বাবা সে দিন এমন ভাবেই সাজিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে। বাবা মানে, স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বড় মেয়ে সুনন্দিনীকে তিনি অল্প বয়সেই বিয়ে, মানে গৌরীদান করেছিলেন। সুনন্দিনী যখন বিয়ের আসরে বাবার শৈল্পিক আবরণে, আভরণে ভূষিত হয়ে এলেন, তাঁর হবু শ্বশুরবাড়ির ঘোলা জলে ঢিল পড়ল। প্রভাতনাথ চট্টোপাধ্যায় তাঁর বর। বিয়েতে সেই বরের জ্যাঠামশাই অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বেঁকে বসলেন। বললেন, ‘‘সেলাই করা কাপড় পরে তো মেয়ে সম্প্রদান হয় না।’’ মেয়ের বাবা উত্তেজিত না হয়ে স্বভাবসুলভ শান্ত গলায় বললেন, ‘‘সেলাই-করা কাপড়? মেয়ের গায়ে তো নেই!’’
ঘটনাটা রয়েছে চিত্রা দেবের ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ বইয়ে। সে দিন শুধু বরের জ্যাঠামশাই নয়, বিয়েবাড়িতে উপস্থিত সকলেই অবাক হয়েছিলেন গগনেন্দ্রনাথের কথা শুনে। দেখা গেল, সুনন্দিনীর পরনে সত্যি কোনও সেলাই করা বস্ত্র নেই। বরং শাড়ি এবং অলঙ্কারে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে, মেয়ের গায়ে যে ব্লাউজ় নেই তা বোঝা যাচ্ছে না। শুভ কাজে তখন সেলাই-বস্ত্র বারণ মেয়েদের।
এই শৈল্পিক পরিকল্পনা তাঁরই—গগন ঠাকুরের! নিমন্ত্রিত সকলেই তখন চমকিত, রোমাঞ্চিত। এ জিনিস কোনও দিন তাঁরা ভাবতেই পারেননি। সেখানেই শেষ নয়। মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার আগে গগনেন্দ্রনাথ বিয়ের সাজে সুনন্দিনীর একটা ছবি আঁকিয়ে রেখেছিলেন এক চিত্রশিল্পীকে দিয়ে। আজকের বিয়েবাড়ির বহুমূল্য ব্লাউজ়ের চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না সে দিনের সেই ব্লাউজ়হীনতা। ‘ভোঁদড় বাহাদুর’-এর স্রষ্টা মেয়েকে শুধু ছদ্ম বক্ষ-আবরণীতে সাজিয়ে থেমে থাকেননি। বড় ছেলের বিয়েতে সাহেব বাজনদারদের ব্যান্ড পার্টিকে বাজাতে বলেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত।
১৯০৪ সালে বড় ছেলে গেহেন্দ্রনাথের বিয়ে দেন গগনেন্দ্রনাথ। আগে এই বিয়েবাড়িতেই একটা ট্রাজেডি ঘটেছিল। গগন ঠাকুরের বাবা গুণেন্দ্রনাথ মারা গিয়েছিলেন তাঁর মেয়ে বিনয়িনী দেবীর বিয়ের পার্টিতে। মৃত্যুর কারণ অতিরিক্ত মদ্যপান। পরে অর্থাভাবে গগন ও বাকি সন্তানদের বিয়ে নমো নমো করেই দিয়েছিলেন তাঁর মা। সেই ক্ষোভ মেটাতেই এত ধুমধাম।
ধুমধাম মানে? খাস পরিচারককে উপহার দেওয়া হল দামি শাল। রুপোর থালায় তত্ত্ব পাঠানো হল মেয়ের বাড়ি। প্রতিটি থালার নকশা করেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ নিজে। বিয়েতে লোবো সাহেবের ব্যান্ডপার্টি বাজিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের দুটি গান— ‘শান্ত হ রে মম চিত্ত নিরাকুল’ এবং ‘শান্তি করো বরিষন’। দুটি গান সাহেবদের বাজানোর জন্য হারমোনাইজ় করে দিয়েছিলেন স্বয়ং ইন্দিরা দেবী। সম্ভবত সেই প্রথম কোনও সাহেবি বাজনদার বিয়েবাড়ির ব্যান্ডে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধুন তুলল।
বিয়েটা অবশ্য বেশি দিন টেকেনি। এক বছর পরেই গেহেন্দ্রনাথ মারা যান। শোক সামলাতে সময় লেগেছিল গগন ঠাকুরের। তার পরই শোকগ্রস্ত শিল্পী আরও গভীর ভাবে ডুবে যান রং-তুলির জগতে।