সিনেমাবাবুদের মুখরোচক গল্প

প্রোডিউসারদের নিয়ে নানা কাহিনি মুখে মুখে ঘোরে। কিছু সত্যি, কিছু বানানো। তার মধ্যে, সিনেমারই মতো, নানা মশলা। যৌনতা, কমেডি, ট্র্যাজেডি।টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে কোনও এক সন্ধে নামার মুখে আচমকা গিয়ে দাঁড়াবেন। চায়ের দোকানে আলো-আঁধার মিশে যখন আড্ডাগুলোকে আরও ঘন করে তুলছে— উদাসীন মুখ করে শোনার চেষ্টা করলে দেখবেন সেখানে অনেক প্রেম, বিচ্ছেদ, ষড়যন্ত্রের গল্প।

Advertisement

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৬ ০০:৪৪
Share:

নায়িকা ও বদ প্রোডিউসার। ‘ওম শান্তি ওম’ ছবিতে।

টালিগঞ্জ মেট্রো স্টেশনের সামনে কোনও এক সন্ধে নামার মুখে আচমকা গিয়ে দাঁড়াবেন। চায়ের দোকানে আলো-আঁধার মিশে যখন আড্ডাগুলোকে আরও ঘন করে তুলছে— উদাসীন মুখ করে শোনার চেষ্টা করলে দেখবেন সেখানে অনেক প্রেম, বিচ্ছেদ, ষড়যন্ত্রের গল্প। হ্যাঁ সিনেমা বানাচ্ছে ওরা। টেকনিশিয়ান্স বা ইন্দ্রপুরী ফেরত এরা কেউ থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, কেউ বা মেগাসিরিয়ালের প্রোগ্রামার। বাজেট হয়ে গেছে, কাস্টিং লিস্ট তৈরি, লোকেশন ঠিক, কী ক্যামেরায় কাজ হবে তাও ঠিক। এখন দরকার এক জন প্রোডিউসার।

Advertisement

কিন্তু প্রোডিউসার খুঁজে পেলেই মুশকিলের শেষ নয়। বরং শুরু। ছবির সিনপসিস, স্ক্রিপ্ট— এ সব রেডি করে, হবু পরিচালক মশাইটি প্রোডিউসারের কাছে যান। কিন্তু তার বেশ কিছু দিন আগে থেকেই শুরু হয় প্রোডিউসারের পছন্দ-অপছন্দ জানার চেষ্টা। ব্রেকফাস্টে কী খান, কোন গাড়ি চড়েন, নায়কের গোঁফ ভালবাসেন কি না, ঈশ্বরে বিশ্বাসী কি না— বিশ্বাসী হলে সন্তোষী মা নাকি বাউলদের দেহতত্ত্ব— সবটুকু।

এর পর শুরু চিত্রনাট্যের অপারেশন। প্রযোজকের পছন্দের নীল জামা পরে নায়ক রোমান্স করে নায়িকার সঙ্গে। প্রযোজকের পছন্দের রেস্তরাঁয় নায়িকার সঙ্গে খেতে যায়। উলটো দিকে, ভিলেনের বাড়িতে থাকে প্রযোজকের অপছন্দের কুকুর। ভিলেনের নাম কী হবে? কেন? প্রযোজকের সঙ্গে আইনি লড়াই চলছে যে কোম্পানির, তার মালিকের নাম দিয়ে দাও! স্ক্রিপ্ট পড়ার সময় একটু বেশি জোরেই পড়া হয় সেগুলো।

Advertisement

এক জন পরিচালক আবার এক্সট্রা প্রস্তুতি নিয়ে প্রযোজককে স্ক্রিপ্ট শোনান। স্ক্রিপ্টের সঙ্গে নিয়ে যান একটা অডিয়ো সিডি। হয়তো সিন রয়েছে নায়ক ঘোড়ায় চড়ে যাবে, সিডি প্লেয়ারে বাজে চিঁহিঁহিঁ, তার পর টকাটক টকাটক। নায়িকা একা বাড়িতে— ভয়ের সিন। ‘ভিরানা’ বা ‘বিশ সাল বাদ’-এর সাউন্ডট্র্যাক বেজে ওঠে।

প্রোডিউসার হতে পারে, এ রকম একটা লোক পেলেই— তার মেয়েকে হিরোইন করার প্রস্তাব, বা তার ছেলে ফুটবল খেলে জেনে, বিপক্ষের ডিফেন্ডারদের আগে থেকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ম্যাচে সেই ছেলের গোল করিয়ে দেওয়া— এ সব হয়েই এসেছে।

রাধেশ্যাম ঝুনঝুনওয়ালা। ভদ্রলোকের অন্যতম পরিচয় হল ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘সুবর্ণরেখা’ ছবির প্রযোজক এবং কাহিনিকার। ঋত্বিক ঘটককে তিনি ছবি বানানোর শর্তই দিয়েছিলেন, কাহিনিকার হিসেবে তাঁর নাম রাখতে হবে। টাইটেল কার্ডে ঋত্বিকের সঙ্গে তাঁর নাম আছে। কুরোসাওয়া ১৯৪২ সালে ‘অল ইজ কোয়ায়েট’ বলে একটি ছবির কথা ভেবে স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলেন। সে লেখা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু এমন বিশ্ববন্দিত পরিচালকও ছবিটি বানাতে পারেননি, কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে প্রোডিউসার আচমকা পিছু হটেন।

আর প্রাচীন গল্প তো আছেই। এক কলকাতার নির্দেশক বহু ঘুরে ঘুরে শেষে প্রোডিউসার পেলেন। বুড়ো ভদ্রলোক। গল্প শুনে ছবি করতে রাজি। নায়িকা-কেন্দ্রিক গল্প। ডিরেক্টর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নিজের বান্ধবীকে নায়িকা করে ফেললেন। ঠিক হল দিন পাঁচেকের রেইকিতে (মানে, কোথায় কোথায় শুটিং হবে— সেই লোকেশন খুঁজতে) যাওয়া হবে। নতুন ছবি, হবু বউ নায়িকা— ডিরেক্টর যারপরনাই আনন্দে। বিদেশি মদ ছাড়া পার্টিতে কিছুই থাকছে না। রেইকিতে যাওয়া হল, ফিরে আসার পর সবাই ডিরেক্টরের চোখমুখ দেখে অবাক। বুড়ো প্রোডিউসার আর হবু নায়িকা এক ঘরে থেকেছে। ক্যামেরা রোল করার আগেই নায়িকা ডিরেক্টরের প্রেমে ‘কাট’ বলে দিয়েছে। নতুন চাকরিও পেয়ে গেছে, প্রোডিউসারের কোম্পানিতে সে রিসেপশনিস্ট।

এ রকমই গল্পের অন্য দিকও আছে। যাত্রা নিয়ে মেতে ছিলেন ভদ্রলোক। সেখানেই প্রযোজনা করতেন। মেগাসিরিয়ালে অভিনয় করা নায়িকা দাপিয়ে অভিনয় করছে গ্রামবাংলায়। যাত্রার পোস্টারে তার নামের পাশে লেখা ‘দুষ্টু-মিষ্টি স্বপ্নসুন্দরী’। মেয়েটির উদ্যম আর অভিনয় প্রোডিউসারের ভাল লেগে গেল। ঠিক করলেন ছবি বানাবেন। মেয়েটি হিরোইন। বড় বাজেট। প্রোডিউসারের খুব আনন্দ— নতুন জগতে পা দিচ্ছেন। একই সঙ্গে টেনশনও। এতগুলো টাকা লগ্নি করছেন। তবুও কোথাও গিয়ে এই অভিনেত্রীর জন্য কিছু করতে পারছেন ভেবেই নিজের ভাল লাগছিল। শুটিং-এর দিন এগিয়ে আসছে, আচমকাই পুলিশ। নবাগতা নায়িকা প্রযোজকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেছে! কিছু প্রমাণ করা বা না করাটাও সময়সাপেক্ষ। ভেঙে পড়া প্রযোজককে আরও অবাক করে নায়িকা এবং ডিরেক্টর মোটা টাকার বিনিময়ে অভিযোগ তুলে নেওয়ার কথা জানায়। এই ভদ্রলোক জীবনে আর কখনও সিনেমা বানাননি।

নব্বইয়ের দশকে প্রোডিউসারদের সুবিধে ছিল। কিছু ডিরেক্টর একটা ছবির বাজেটেই দু’-তিনটে ছবি বানিয়ে ফেলতেন। তিনটে ছবির স্ক্রিপ্ট, শট ডিভিশন রেডি। একটা ছবিতে নায়ক মস্তান, অন্যটায় পাগল, আর একটায় গায়ক। মস্তান নায়কের যে বাবা, সে অন্যটায় পাগলের ডাক্তার, আর একটায় গানের মাস্টারমশাই। একটিতে নায়িকা বড়লোক বাড়ির মেয়ে, অন্যটায় পাগলখানার নার্স, আর একটায় দারুণ গান গাইলেও বাড়ির লোক বিদেশে কর্মরত পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে নাছোড়বান্দা। মোট কথা, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ঘুরেফিরে প্রায় একই। বাকি ইউনিটও এক। শুটিং ফ্লোরে কল টাইম দেওয়া হল। মস্তান নায়ক মারপিটের সিন সেরেই মেক-আপ নিয়ে দাড়িগোঁফওয়ালা পাগল— নিজের বউকে চিনতে পারে না। ঘণ্টাখানেক বাদেই গান গেয়ে নায়িকার বাবার অপমানের জবাব দেয় অন্য ছবির গল্পে। প্রোডিউসারের খরচ হল এক দিনের শুটিঙের, কিন্তু একসঙ্গে কাজ চলতে লাগল তিন-তিনটে ছবির।

এক বার, প্রোডিউসার ডিরেক্টরকে ছবি বানানোর পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। শুধু একটাই শর্ত— তাঁর সঙ্গিনী অভিনেত্রীকে বড় রোল দিতে হবে। ঠিক হল চরিত্র। কিন্তু এই অভিনেত্রী অভিনয় ছাড়া বাকি সব কিছুই হয়তো পারেন। আলাদা করে ডেকে ডিরেক্টর প্রোডিউসারকে বললেন, একে দিয়ে হওয়ার নয়। অনেক রকম ভাবে অনেক কিছু বোঝানোর পর প্রোডিউসার ভদ্রলোক হাঁউমাউ করে বলেই ফেললেন, তিনি সামান্য কর্মচারী মাত্র। এই ভদ্রমহিলাই আসলে সব টাকা ঢেলেছেন। প্রোডিউসারের দাপট দেখিয়ে তিনি অভিনয়ে সুযোগ নিচ্ছেন— শুধু এই কথাটা শুনতে চান না বলে, এই বেচারা কর্মচারীটিকে প্রোডিউসার সাজিয়েছেন!

আর এক প্রোডিউসার ভদ্রলোক করুণাময়ীর বাসিন্দা। অনেকগুলো বিজনেস। পোষা কুকুরও বিদেশ সফরে যায়। একমাত্র ছেলেকে নিয়ে চিন্তায়। ছেলের কাজে মতিগতি নেই— কিছুই ভাল লাগে না। শুধু হিরো হতে চায়। কী আর করা, বাবাই টাকা ঢাললেন। ছেলেকে হিরো করে সিনেমার কাজ শুরু হল। অভিনয়টাও মোটের ওপর ভালই করছে ছেলে। বাবার মুখে হাসি। লোকেশন ঠিক হয়েছে পাহাড়। শুটিং–এর শেষ দিক। স্টান্টসম্যান ছাড়াই একটা দৃশ্য করতে গিয়ে পা হড়কাল নায়ক। অনেকটা নীচে গভীর খাদ— আর জমাট অন্ধকার। খুঁজে পাওয়া যায়নি আর। প্রোডিউসার ভদ্রলোক এখনও মাঝে মাঝে অডিশন ডাকেন নায়কের চরিত্রের জন্য। হয়তো খাদের ভিতরে হারিয়ে যাওয়া ছেলে বেঁচে আছে, হয়তো অভিনয়ের নেশায় আবার ফিরে আসবে!

কয়েক জন টেকনিশিয়ান অনেক বছর ধরে কাজ করেছেন। উত্তমকুমার কোথায় টিফিন করতেন, সত্যজিৎ রায় একা একা কোথায় ভাবতেন— স্টুডিয়োপাড়ায় এ রকম অনেক কিছুই তাঁরা গাইডের মতো ঘুরে ঘুরে দেখান। এঁদেরই এক জন তাঁর কাঁধের ঝোলাব্যাগে একটা মলিন হয়ে যাওয়া ফাইল রাখেন। ফাইলের ভিতরে গল্প আর কাস্টিং। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ভাবা নায়ক এখন আর নেই। অনেকগুলো নায়ক বদলেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। আজও এই ভদ্রলোক প্রোডিউসার পাননি। আজও কোনও প্রোডিউসারের খোঁজ পেলে গল্প শোনানোর জন্য সময় চান। বেশির ভাগ লোকই শোনেন না, যাঁরা শোনেন, খানিক পরেই ‘কাজ আছে’ বলে ভদ্রলোককে চা খাইয়ে বিদায় দেন। আবার একটা দিনের অপেক্ষায় অলি-গলি পার হয়ে নিজের এক চিলতে বাড়ির দিকে এগোন ফাইল বগলে বৃদ্ধ টেকনিশিয়ান। আলতো ঘুমে স্বপ্ন দেখেন, পুরনো হয়ে যাওয়া মোবাইলে ঠিক ফোন আসবে প্রোডিউসারের। তড়িঘড়ি ছবির কাজ শুরু হবে।

মোটাসোটা গোলগাল টাকমাথা প্রোডিউসার। খুব মদ খান আর হাসেন। আড়ালে সবাই পাগল বলে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি ছবি বানাতে গিয়ে আর শেষ হয়নি। ছবির মাঝামাঝি অবস্থায় জুনিয়র আর্টিস্টের রক্তবমি। নানান টেস্টের পর ক্যান্সার ধরা পড়ল। কঠিন পর্যায়। প্রচুর টাকার দরকার। ছোট রোল। বিকল্প খোঁজা শুরু। আচমকাই এই প্রোডিউসার এই ক’দিনের সবার পেমেন্ট মিটিয়ে দিয়ে ঘোষণা করলেন ছবির জন্য রাখা বাকি টাকায় ওই জুনিয়রের চিকিৎসা হবে। সবাই অবাক। বিশেষ কিছু বলতেও পারল না। জুনিয়র আর্টিস্ট সুস্থ হয়ে ফিরলেন। মোটাসোটা ওই প্রোডিউসার এখনও বলেন— ‘জীবনে এর থেকে ভাল সিনেমা আর বানাতে পারব না।’

banerjeeriksundar@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement