আমি তখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তাম। সেই সময় আমাদের কলেজেরই এক জন অধ্যাপক অমিতবাবু মারা যান। তাঁর স্মরণসভায় আমি ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’ গানটা গেয়েছিলাম। সাধারণত স্মরণসভায় গানটান গাইলে তো কেউ হাততালি দেন না। সেই সভায় কিন্তু আমার গান শেষ হওয়ার পরই এক জন হাততালি দিয়ে উঠলেন। তিনি, জীমূতবাহন সেনগুপ্ত, জেভিয়ার্সের অর্থনীতির অধ্যাপক। ফলে, বিচ্ছিরি একটা পরিস্থিতি তৈরি হল। এমন একটা কাজ করে উনি নিজেও তখন খুব অপ্রস্তুত। বললেন, আসলে ছেলেটার গান শুনে আমি ভীষণ মুভ্ড। সেই জন্যই হাততালি দিয়ে ফেলেছি। ছেলেটার সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে রইল। আমার বন্ধু সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়, যার ‘আগশুদ্ধি’ নাটকটা এখন চলছে, সে আমাকে স্যরের কাছে নিয়ে যায়। স্যর দেখেই বলে উঠলেন, ‘আরে বাবা তুমি তো খুব সুন্দর গান করো।’ সুদীপ্ত তখন হঠাৎ বলে উঠল, ‘স্যর, ও কিন্তু খুব সুন্দর অভিনয়ও করে।’ স্যর বললেন, ‘তাই নাকি? অভিনয়ও করো!’ বললাম, ‘হ্যাঁ, আসলে আমি তো রমাপ্রসাদ বণিকের দলে অভিনয় করি।’
স্যর বললেন, ‘ভেরি গুড ভেরি গুড। তা, আমরা তিন বন্ধু মিলে একটা ছবি করছি। আমি সেই ছবির পার্ট প্রোডিউসার। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালক। তুমি যদি অভিনয় করতে চাও, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো। তোমাকে পার্ট দেওয়ার জন্য আমি ওঁকে বলে দেব।’
তখন সিনেমা করার কথা ভাবিইনি। নাটকই ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু এই প্রস্তাবটা শুনে মনে হল, বাহ্! এ তো একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হবে! গেলাম এন টি ওয়ান স্টুডিয়োতে। গিয়ে আমি হাঁ! চোখের সামনে অনিল চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যারানি সবাইকে দেখছি। অদ্ভুত লাগছে।
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ঘরে গেলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, জীমূতবাহন সেনগুপ্ত পাঠিয়েছেন। উনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমায় ফোনে তোমার কথা বলেছে। তুমি একটু বাইরে অপেক্ষা করো।’
বাইরে গেলাম। দেখলাম, আমারই মতো আরও চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ জন ছেলে অপেক্ষা করছে। বুঝলাম, কম্পিটিশন ভালই। আট-দশ জন করে উনি ঘরে ডেকে পাঠাতে লাগলেন। তাদের দিয়ে স্ক্রিপ্ট পড়ানো হল। সেটা শুনে কয়েক জনের নাম নোট করে নেওয়া হল। দেখলাম, আমার নামটাও উনি নোট করলেন। এই ভাবে বাছাই হতে হতে শেষে আমরা ছয়-সাত জন ফাইনাল হলাম। আমাদের ডেকে হাতে একটা স্ক্রিপ্ট ধরিয়ে বললেন, ‘এই সিনটা ভাল করে পড়ো।’ তখন সব কার্বন কপি-তে লেখা হত। জেরক্স-এর বালাই ছিল না। বাংলায় হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট। অরবিন্দবাবু বললেন, ‘ভাল করে দেখে নাও। কিন্তু দেখে বলতে পারবে না। মুখস্থ করে বলতে হবে।’
আমার খান পাঁচ-ছয় ডায়ালগ ছিল। মুখস্থ করে নিলাম। এর মধ্যে মহুয়া রায়চৌধুরী আমাদের ঘরে এসেছেন। উনি চা-টা নিয়ে গুছিয়ে বসলেন, আর আমরা এক-এক করে ডায়ালগ মুখস্থ বলতে শুরু করলাম। শেষ হলে অরবিন্দবাবু খানিক চিন্তায় পড়লেন। বললেন, ‘তোমরা তো বেশ ভালই বলেছ। কিন্তু কাকে নেওয়া যায়?’ সেই সময় মহুয়া রায়চৌধুরী আমার দিকে দেখিয়ে বলে উঠলেন, ‘এই যে ওকে নিন। ও বেশ ভাল বলল।’ অরবিন্দবাবু বললেন, ‘বলছ মহুয়া, তা বেশ, তুমি ফাইনাল।’
ফাইনাল তো শুনলাম। কিন্তু কীসের জন্য ফাইনাল, কত সময়ের জন্য ফাইনাল, কিছুই জানি না। এক জন প্রোডাকশন ম্যানেজার ডেকে নিয়ে গেলেন। জানলাম যে আমার তিন দিনের পার্ট। পাব, ষাট টাকা করে তিন দিন, মোট একশো আশি টাকা। ছবির নাম ‘হুলুস্থুল’। সাদা-কালো কমেডি ছবি। আমি আর সত্যদা ছাড়াও তাপস পাল, মুনমুন সেনও অভিনয় করেছিলেন।
এ বার শুটিং। প্রথম দিন গেছি। পাজামা-পাঞ্জাবি কস্টিউম। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করব আমি। এই সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু পিএলটি-র সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নন। ইনি ‘নহবত’ নাটকের পরিচালক ছিলেন। এই ছবিতে তিনি এক জন ডাক্তার। আর আমি এসেছি ডাক্তারবাবুর কাছে, বাবার ওষুধ নিতে। ছবিতে আমার বাবা অসুস্থ। এই বার ডায়ালগ বলার পালা।
মুশকিল হচ্ছে, সিনেমা তোলার নিয়ম হল, ডিরেক্টর আগে ‘স্টার্ট সাউন্ড’ বলবেন, তার পর ‘রোল ক্যামেরা’ বলবেন, ক্যামেরা রোল করবে, তার পর ক্ল্যাপস্টিক দিয়ে বলা হবে ‘টেক ওয়ান’, তার পর পরিচালক ‘অ্যাকশন’ বলবেন... এ সব হলে তবে তো ডায়ালগ। কিন্তু আমি তো আর আগে সিনেমা করিনি, তাই কিছুই জানি না। এ সব হওয়ার আগেই আমি গড়গড় করে সংলাপ বলতে আরম্ভ করে দিয়েছি!
পরিচালক বলে উঠলেন, ‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও দাঁড়াও। তুমি এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? আমি তোমাকে অ্যাকশন বললে তবে তুমি ডায়ালগ বলবে।’ এ বার আর ভুল হল না। উনি ‘অ্যাকশন’ বললেন। আমিও ডায়ালগ বললাম। ঠিকঠাকই বললাম। কিন্তু শেষ হওয়ার পর বলে ফেললাম, ‘আমার বলা হয়ে গিয়েছে।’
সঙ্গে সঙ্গে ‘কাট কাট কাট’। পরিচালক বললেন, ‘আরে, তুমি আবার এটা বলতে গেলে কেন?’ তখন শিখলাম যে, সংলাপ বলার পর এক্সপ্রেশনটা ‘হোল্ড’ করে রাখতে হয়। তার পর ‘কাট’ বলা হয়ে গেলে অন্য কথা। শটটা আবার নেওয়া হল। আমার জীবনের প্রথম শট। বাকি দু’দিনের কাজটুকু নির্বিঘ্নেই হল।
তখন এন টি ওয়ান স্টুডিয়োতেই ডাবিং হত। ডাবিং-এর কাজও করলাম। তখন ‘লুপ সিস্টেম ডাবিং’ ছিল। মানে, এক-একটা শট তুলে দেওয়া হত। তার পর সেটাকে পুরো ডাব করতে হত। ডাবিং করতে গিয়ে পরদায় প্রথম দেখলাম নিজেকে। অভিনয় করা অবস্থায়।
এ বার ছবির মুক্তি। আশির দশকের প্রথম দিক। পুলিশের মার খেয়ে হল-এ সে ছবি দেখেছি। আমি আর্টিস্ট হলে কী হবে, সেই সময় আমায় মোটেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। ওই ছোট্ট খুচরো পার্টের জন্য পাস দেওয়াও সম্ভব ছিল না। ফলে, টিকিট কেটেই দেখতে হত। টিকিটের লাইনে ব্যাপক ঠেলাঠেলি, গুঁতোগুতি। দিল পুলিশ দু’ঘা। অবশ্য তাতে ছবি দেখা আটকায়নি। পরদায় দেখতে খারাপ লাগল না। ছবিটা দারুণ ভাল না চললেও আমার একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা তো হল।
আমার দ্বিতীয় ছবি এর বহু পরে। মাঝে টুকটাক সিরিয়ালের কাজ। তার পর কত শুটিং করলাম। কোনওটায় গায়ের ওপর দিয়ে সাপ চলে গেল, কোনওটায় এমন কান্না কাঁদলাম, যে আর থামতেই পারি না। সে আর এক গল্প।
kharajmukherjee@gmail.com