ছবি: কুনাল বর্মণ
তখনও ইয়েটা ভাল ভাবে শেষ হয়নি। আচমকা তীব্র শব্দে ট্রেনের ভোঁ।
অখিলচন্দ্র সেন বিলক্ষণ বুঝলেন, এখনই ট্রেন ছেড়ে দেবে। প্ল্যাটফর্মের শৌচাগার থেকে কোনও মতে বেরিয়ে ছুটতে শুরু করলেন। এ দিকে ট্রেনও চলতে শুরু করেছে। এক হাতে লোটা, অন্য হাতে ধুতি সামলে দৌড়চ্ছেন অখিলচন্দ্র। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। টাল সামলাতে না পেরে সটান প্ল্যাটফর্মে ধপাস। ধুতি বাগে নেই, লোটা লুটোপুটি। চলন্ত ট্রেনের যাত্রী, বিশেষ করে মহিলারা সে দৃশ্য দেখে হেসে খুন। কী লজ্জা, কী লজ্জা!
ট্রেন তাঁকে ফেলে চলে গেল। পেটের জন্যই সকলের সামনে তাঁর যেন মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালেন অখিলচন্দ্র। রাগে, লজ্জায়, অপমানে ফুঁসছেন তিনি, ‘হতচ্ছাড়া গার্ড কোথাকার! আরও পাঁচ মিনিট পরে ট্রেন ছাড়লে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত!’ অখিলচন্দ্র পণ করেন, এর একটা বিহিত করতেই হবে।
এখন তো ইএমইউ (ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট) লোকাল, কিংবা পাতাল-রেল ছাড়া বাকি সব ট্রেনেই শৌচাগার রয়েছে। সঙ্গে অত্যাধুনিক ব্যবস্থাও। কিন্তু ট্রেন চালু হওয়ার প্রথম ৫৫ বছর অখিলচন্দ্রের মতো বহু ট্রেন যাত্রীদের এমন ভোগান্তিই ছিল রোজনামচা। কারণ তখনও পর্যন্ত রেলের চতুর্থ শ্রেণির যাত্রীদের জন্য ট্রেনে কোনও শৌচাগার ছিল না!
১৮৯১ সালে বহু টালবাহানার পরে তৃতীয় শ্রেণির কামরায় শৌচাগার হল। কিন্তু সেখানেও ত্যাগের জন্য সাকুল্যে পাঁচ ইঞ্চি ফুটো। যা নিয়ে জনৈক এক ইংরেজ মহিলা যাত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ‘বোধহয় সাহেব ইঞ্জিনিয়ার রেলওয়ে ভাড়ার শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী ছিদ্র করতেন।’
১৯০৯-’১০ সাল নাগাদ সবার জন্য শৌচাগার তৈরি হল ট্রেনে। পেটরোগা বলে বাঙালি জাতিকে যতই গাল পাড়ুন, ১৯০৯ সালের ২ জুলাই অখিলচন্দ্র সেন নামে সেই বাঙালি যুবকের ‘ভয়ঙ্কর’ অভিযোগপত্রেই কিন্তু এমন শৌচাগার বিপ্লব হয়েছিল।
অখিলচন্দ্র সেন তখন নব্যশিক্ষিত যুবক। নতুন জামাইও বটে। ফিরছিলেন শ্বশুরবাড়ি থেকে। স্ত্রী একটি পাকা কাঁঠাল ভেঙেছেন। গপ্পে গপ্পে একটির পর একটি কোয়া তিনি খেয়ে ফেলেছেন। বলাই বাহুল্য, একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছেন। তার পর স্ত্রীকে বিদায় জানিয়ে টাঙায় চড়ে এসে পৌঁছেছিলেন রেল স্টেশন পর্যন্ত। ঠিক সময়ে ট্রেনও হাজির। তিনিও নিশ্চিন্তে উঠে পড়েছেন। কিন্তু কিছু দূর যাওয়ার পরেই পেটে অসহ্য যন্ত্রণা। গুরুপাক কাঁঠাল যে এমন বিপাকে ফেলবে, কে জানত! এ দিকে চতুর্থ শ্রেণির কামরাতেও কোনও শৌচাগার নেই। তা হলে উপায়?
কোনও মতে কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করে, প্রকৃতির ডাককে উপেক্ষা করতে না পেরে তিনি লোটা নিয়ে নেমে পড়েন আমেদপুর স্টেশনে। মুক্তি পেতে সটান দৌড় দেন প্ল্যাটফর্মের শৌচাগারে। ঠিক তখনই ওই বিপত্তি। গার্ড সাহেবের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করে অখিলচন্দ্র সটান সাহেবগঞ্জ ডিভিশনাল রেলওয়ে অফিসে দিলেন চিঠি পাঠিয়ে—('Beloved Sir, I am arrive by passenger train Ahmedpur station and my belly is too much swelling with jackfruit. I am therefore went to privy... I am running with lotah in one hand and dhoti in the next...')। শেষ লাইনে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে লিখলেন, উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে বিষয়টি খবরের কাগজে ছেপে দেবেন তিনি।
ব্যাকরণের ভুলে ভরা এই চিঠিটির কিন্তু ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, এই চিঠি পাওয়ার পরেই রেল কর্তৃপক্ষ সব শ্রেণির যাত্রীদের জন্য ট্রেনে শৌচাগারের বন্দোবস্ত করেন। অখিলবাবুর সেই চিঠি আজও নয়াদিল্লির রেল মিউজিয়ামে রাখা আছে।
ভরা গ্রীষ্ম মানেই তো আম-কাঁঠালের মরশুম। সদ্য পেরিয়ে গেল জামাইষষ্ঠীও। বাবাজীবনরা সব কবজি ডুবিয়ে খেয়ে ঘরে ফিরেছেন। যাঁরা মেট্রো কিংবা ইএমইউ ট্রেনে করে ফিরেছেন, কেউ কেউ নিশ্চয়ই বিপাকেও পড়েছেন। কারণ, এখনও তো সেখানে শৌচাগার নেই! দেবেন নাকি, একটা চিঠি ঠুকে?