ডান দিকে, ২১ জুলাই, ১৯৯৯-এর আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা। সেখানে এই রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ হওয়ার সম্ভাবনার খবর। বাঁ দিকে: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শঙ্খ ঘোষ। দুজনেই ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি বদলের পক্ষে।
১৯৯৯ সালের ঘটনা। দূরদর্শনে একটা প্রস্তাবিত বিল এল, পরের দিন সেটি বিধানসভায় পেশ করা হবে। সরকার পক্ষ বিলটি আনছে। তখন বামফ্রন্টের শাসনকাল। বিলে বলা হচ্ছে, এই রাজ্যের ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটির বদল ঘটানো হবে। ‘আজকাল’ পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তাঁকে বললাম, বিলটির মূলেই গোলমাল আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কী গোলমাল। বললাম, ‘পশ্চিমবঙ্গ’ নামটি পরিবর্তন করতে চাওয়া হচ্ছে, কিন্তু আমাদের সংবিধানে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বলে তো কোনও রাজ্য নেই, রাজ্যটির সংবিধানসম্মত নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’। ভারতের এই একটি রাজ্যের নামই এখন ইংরেজিতে। ‘নেফা’ আর নেই। আর একটি রাজ্যের নাম অর্ধেক ভারতীয় আর অর্ধেক ইংরেজি শব্দে। সেটি হল নাগাল্যান্ড। উনি বললেন, আপনি এই বিষয়ে একটি পোস্ট-এডিটোরিয়াল লিখতে বসে যান তো। বেশি রাতে আপনার বাড়ি থেকে লেখাটা আমরা তুলে নেব।
ওই লেখাটিতে লিখেছিলাম, ১৯৪৭ সালে যখন ভারত ভাগ হল, তখন বাংলার যে অংশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হল, সেই অংশ সরকারি ভাবে চিহ্নিত হল ‘ইস্ট বেঙ্গল’ নামে। স্বাভাবিক ভাবে আমাদের এই অংশের নাম হল ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’। আমরা ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ নামটিকে অনুবাদ করে মুখে মুখে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ করে নিয়েছি। লিখেছিলাম, রাজ্যের নাম বদলিয়ে সাংবিধানিক ভাবে করা যায় পশ্চিমবঙ্গ, পশ্চিমবাংলা, বঙ্গভূমি, বঙ্গপ্রদেশ, কিংবা সরাসরি বাংলা। আমরা তো মুখে মুখে বাংলাই বলি। বাংলা নামটি আশ্চর্য ভাবে প্রচলিত থেকে গেছে খেলার জগতে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দল ফুটবল থেকে শুরু করে খেলাধুলোর যে কোনও শাখাতেই ‘বাংলা’ নামে চিহ্নিত। সর্বভারতীয় খেলাধুলোর ক্ষেত্রে আমরা তো ‘বাংলা জয়ী’ কিংবা ‘বাংলা পরাজিত’, এ ভাবেই লিখি। বাংলার মানুষ কিংবা বাংলার সংস্কৃতি, আমরা মনে মনে ভাবি এবং প্রকাশ করি এই ভাবে। ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল— পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান।’— রবীন্দ্রনাথের এই যে উচ্চারণ, সে তো আবহমান বাংলাকে নিয়ে। আমরা কি সেই বাংলাকে ভুলে যাব! প্রতিবেশী দেশটি বাংলাদেশ নামে পরিচিত হচ্ছে বলেই কি আমাদের বাংলা নামটি বাতিল হয়ে যাবে! তাঁরা একটা দেশ বা রাষ্ট্র হিসেবে সব সময় বাংলাদেশ বলেন, কখনও শুধু ‘বাংলা’ বলেন না।
পর দিন সকালে লেখাটি পড়ার জন্য অনুরোধ করলাম শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, পবিত্র সরকারকে এবং বিধানসভার সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদের। তখনকার উপমুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকেও অনুরোধ জানালাম। শঙ্খদা, সুনীলদা, পবিত্রদা বললেন, ঠিক আছে, এ মতে তাঁদের সায় আছে। বিভিন্ন দলের নেতারা বললেন, আপনার যুক্তি মেনে নিচ্ছি, আমাদের আপত্তি নেই। বুদ্ধবাবু বললেন, প্রস্তাবটায় যে ভুল আছে, এত দিন বলেননি কেন? বললাম, কাল বিকেলে প্রস্তাবটা দূরদর্শনে এসেছিল বলেই জানতে পারলাম। প্রস্তাবটাতে একটা সংশোধনী আনতে হবে। সকলে ‘বাংলা’ নামের প্রস্তাবটি মেনে নিচ্ছেন শুনে বুদ্ধদেববাবু বললেন, ‘আপনি যখন উদ্যোগ নিয়েছেন— আর আপনি তো কোনও দলে নেই, আপনার পক্ষে বলা সম্ভব— আপনি সবাইকে অনুরোধ করুন আমার ঘরে এসে বিষয়টা আলোচনা করে নিতে। সৌগত রায়কে বলুন সংশোধনীটা যেন উনি আনেন। আমি সিএম-এর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি।’
আমি সবার সঙ্গে কথা বলে রাজি করালাম, তাঁরা যাতে উপমুখ্যমন্ত্রীর ঘরে গিয়ে মিটিং করে নেন। বুদ্ধদেববাবু জানালেন, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ‘বাংলা’ নামটিতে রাজি হয়েছেন। সে দিন বিধানসভায় সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সর্বসম্মত ভাবে প্রস্তাব গৃহীত হল, রাজ্যের নাম ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল’ থেকে বদলিয়ে ‘বাংলা’ হবে। গণসংগীতশিল্পী অজিত পাণ্ডে তখন বিধায়ক, তিনি ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’ গেয়ে বিধানসভার ভেতরে প্রদক্ষিণ করলেন। অন্যরাও কণ্ঠ মেলালেন। অজিতদা আমাকে ফোন করে বললেন, সবাই চাইছে এই দিনটাতে তুমি বিধানসভায় চলে এসো। আমি বললাম, আমি ওখানে গিয়ে কী করব, আমি বরং দেখি যাতে নিউজটা খুব গুরুত্ব দিয়ে যায়, আর এটা নিয়ে দূরদর্শনে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান করি।
আমরা একটি বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান করলাম। সেখানে একটা কথা উঠল, বাংলাদেশ থেকে আপত্তি উঠতে পারে, ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলা’ এই দুটি নাম নিয়ে বাইরের বিশ্বে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। পরে খবর পেয়েছিলাম, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ‘বাংলা’ নামের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। আলোচনায় আরও বলা হল, ভারতের পঞ্জাব রাজ্য আর পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশ তো আছে, তা নিয়ে তো কোনও বিভ্রান্তি নেই!
এখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বাইরের বিশ্বে এ রাজ্যকে ‘বেঙ্গল’ নামে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন, তাতে ওই বিভ্রান্তির যুক্তিটাই অবশ্য আর খাটবে না। তবে হিন্দিতে এবং ভারতের সব ভাষাতে এ রাজ্য ‘বাংলা’ নামেই পরিচিত হোক। হিন্দিতে ‘বঙ্গাল’ বললে অন্য সব প্রদেশেই ‘বঙ্গাল’ বলার প্রবণতা দেখা যাবে। শঙ্খ ঘোষ অবশ্য ইংরেজি সহ সব ভাষাতেই ‘বাংলা’ নামটি চেয়েছেন। তিনি মনে করেন, পরিবর্তন হয়ে গেলে বাইরের বিশ্বও ‘বেঙ্গল’ নয়, ‘বাংলা’-ই বলবে।
বাইরের বিশ্বে বে অব বেঙ্গল, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, এ-সব সূত্রে ‘বেঙ্গল’ নামটি বেশ পরিচিত। আর আন্তর্জাতিক ভাবে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসীদের ভাষা ‘বেঙ্গলি’ ভাষা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের মানুষের ভাষা ‘বাংলা’ বলে স্বীকৃত। একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন বিবিসি লন্ডনে চাকরি করি। কমনওয়েল্থ ইন্সটিটিউটের এক কর্মকর্তাকে ইন্টারভিউ করতে গেছি। দেখি একটা বোর্ডে লেখা আছে, ওই ইন্সটিটিউট কোন কোন ভাষা নিয়ে কাজ করে। তালিকায় ‘বেঙ্গলি’র নীচে অন্য একটি ভাষা হিসেবে লেখা ‘বাংলা’। ইন্টারভিউয়ের সময় প্রশ্ন করে জবাব পেলাম, বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা বাংলা, আর ইন্ডিয়ার একটা স্টেটের আঞ্চলিক ভাষা বেঙ্গলি। আন্তর্জাতিক ভাবে এই ভুলটা এখনই ভাঙা দরকার, প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার এই সত্য, যে, দুটোই একই ভাষা। সরকারি উদ্যোগ ছাড়া এটা প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার চর্চা ও উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক ভাবে অনেক ফান্ড কাজ করে। এই সব ফান্ডের বাংলা ভাষার জন্য বরাদ্দ সমস্ত অর্থই কেবল বাংলাদেশ পাচ্ছে, আর ভারতীয় ভাষাগুলোর জন্য বরাদ্দ অর্থের একটা অংশ মাত্র আমরা পাচ্ছি, সে অর্থ তো অনেকগুলো ভাষার মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ‘বাংলা’ আমাদের রাজ্যের ভাষা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে, বাংলা ভাষার জন্য বরাদ্দ অর্থের অর্ধেক বাংলাদেশের, আর বাকি অর্ধেক আমাদের প্রাপ্য হবে।
আজ থেকে সতেরো বছর আগে সে দিনের সবাই একমত হয়ে রাজ্যের নাম বদলের আনন্দ আর আবেগ এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। কিন্তু কেন্দ্র থেকে রাজ্যের নাম পরিবর্তনের অনুমোদন আদায় করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ তখন নেওয়া হয়নি। এ আক্ষেপ ভোলার নয়। এখন দেখা যাক, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন কি না। অপেক্ষা করে থাকব।
pankajsaha.kolkata@gmail.com