পালাবার পথ নেই। আণবিক বিস্ফোরণের জেরে গায়ে পড়ছে বিষাক্ত কালো বৃষ্টি। ‘ব্ল্যাক রেন’ জাপানি ছবির দৃশ্য।
৬ অগস্ট, ১৯৪৫। আশঙ্কা আর আতঙ্কে মোড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা রোদ-ঝলমলে সকাল। বাচ্চারা সবে স্কুলের রাস্তায়। হিরোশিমার শান্ত বাতাসে মাঝে মাঝেই বেজে উঠছে এয়ার-রেড সাইরেন। মার্কিন যুদ্ধবিমান ‘এনোলা গে’-র শরীর থেকে আকাশ কালো করে এর পর যেন নেমে এল সাক্ষাৎ মৃত্যু। কী এমন হল, বোঝার আগেই থেমে গেছে অসংখ্য প্রাণ। শরীর ঝলসে দেওয়া দমকা হাওয়া, চোখ-পুড়িয়ে দেওয়া আলো, দম বন্ধ করা বিষাক্ত ধুলো, উড়ে আসা কাচ আর আগুন, আর ব্যাঙের ছাতার মতো পাক খাওয়া, পুঞ্জীভূত বীভত্স এক মেঘ তখন আকাশে। হিরোশিমার বেশির ভাগ ঘড়ির কাঁটা থমকে সকাল আটটা পনেরোয়।
তখন প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ ছিলেন হিরোশিমায়। হিরোশিমার বাসিন্দা ছাড়াও এর মধ্যে ছিলেন সেনাবাহিনীর লোকজন। ঘন ঘন বিমানহানায় হওয়া ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ করছিলেন আশপাশের শহরের লোকজনও। তার মধ্যে স্কুল-পড়ুয়াও প্রচুর। ১৯৪৫-এর ডিসেম্বরে বিস্ফোরণে মৃতের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াল প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার। শহরের নব্বই শতাংশ বাড়ি পুড়ে ছাই, বা ভেঙে তছনছ।
বিস্ফোরণের সময় চার বছরের মেয়ে সানায়ে কানো। তাঁর মনে আছে, চার দিকে ছুটে আসা কাচের টুকরো সরিয়ে বাড়ি থেকে সবাইকে বের করছিলেন বাবা। বাবার সর্বাঙ্গে ঢুকে আছে কাচ। একটা থামে ধাক্কা খেয়ে মারা গেলেন দিদা। পড়শিদের সাহায্যে এগিয়ে যেতেই বিষক্রিয়ায় মারা গেলেন মা। রেললাইন ধরে ছুটল সানায়ে। ঝাঁপ দিয়ে পিছিয়ে এল, কারণ অসহ্য উত্তাপে নরম দুটো পা পুড়ে গেল। নদীতে ভেসে আছে পানীয় জলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে পুড়ে যাওয়া মানুষের শরীর। নদীর জলে বিষ। জল মুখে দিলেই মৃত্যু। কান্না চেপে রইল সানায়ে। দুটো ‘রাইস বল’ দিয়ে গেল কেউ। তার পর সে ঘুমিয়ে পড়ল নদীর ধারেই।
কেইকো সাসাকির বয়েস তখন ছয়। দিদার সঙ্গে থাকে হিরোশিমার বাইরে। মা হিরোশিমায়। মেয়ের বিপদ শুনে দিদা গেলেন হিরোশিমায়। ফিরে এলেন পিঠে এক বোঝা নিয়ে। দিদার পিঠের বোঝায় মা রয়েছেন ভেবে ছুটে গেল সাসাকি। দিদা এগিয়ে দিলেন মায়ের একটি সোনার দাঁত আর মায়ের কনুইয়ের পোড়া এক টুকরো হাড়।
পাঁচ বছরের কিকুও ইয়ামাশিতার বাড়ি ভেঙে পড়ল আগুনে। ভাইবোন আর কিকুও তখন খেলছিল বাড়ির দোতলায়। কোনও রকমে সবাই বেরিয়ে পড়ল ভিটে ছেড়ে। মা চললেন একটা ঠেলাগাড়িতে। ভাইরা এসে পর দিন সকালে খবর দিল, মারা গেছেন মা। দিন কয়েক পর মারা গেল এক ভাই।
পাঁচ বছরের তোকিকো ওয়াদা সবে খেতে বসেছিল সকালের জলখাবার। ধাওয়া করে এল আগুন আর দুর্গন্ধে ভরা ধোঁয়া। দাদু আর দিদার সঙ্গে পালাতে গিয়ে রাস্তায় দেখল রক্তে মুখ লাল, পথে শুয়ে আছে এক সেনা, মুখ এত লাল— যেন সাক্ষাৎ শয়তান!
পাঁচ বছরের ইয়ায়েকো সাসাকির ভাই ভর্তি হাসপাতালে। বাবা সেখানেই খাবার নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছেন। পাশের বাড়ি বন্ধুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলার সময়, একটা আগুনের গোলা এসে পড়ল তাদের উপর। চার পাশের বাড়িঘর জ্বলছে দাউদাউ। তার মধ্যেই নিজের বাড়ির সামনে এসে ইয়ায়েকো না পেল তার মায়ের দেখা, না পেল তার বাবাকে। রাস্তার ধারে কেঁদে আকুল। এক চেনা মহিলা তাকে নিয়ে গেলেন তাদের ভাঙা বাড়ির ভিতর। ‘বাবা, মা’, বলে চিত্কার করল ইয়ায়েকো, সাড়া মিলল না কোনও। দুই বোনকে নিয়ে বেঁচে রইল ইয়ায়েকো। এক বোনের সারা শরীর পোড়া। অন্য শহরে চলে যাওয়া বোন অক্ষত।
বিস্ফোরণের তীব্রতা আর ধরন খতিয়ে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের নিয়ে জাপানি সেনাবাহিনী মাঠে নামল। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রুম্যান ৭ অগস্ট রেডিয়োয় ঘোষণা করলেন, হিরোশিমায় ফেলা হয়েছে আণবিক বোমা। ১৫ তারিখে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে যদিও সাধারণ জাপানিরা জানলেন না সেই কথা। শুরু হল আহতদের এবং বিকিরণে ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিত্সা। বোমা ফেলার জায়গা থেকে ১৫০০ মিটার দূরে হিরোশিমার রেড ক্রস হাসপাতালের বাক্সবন্দি অব্যবহৃত এক্স-রে ফিল্মে ছবি উঠে আছে দেখেই জাপানি বিজ্ঞানীরা বুঝেছিলেন, নতুন অস্ত্র আণবিক বোমাই। একই ভাবে জানলার ফ্রেমের ছায়ার ছবি দেওয়ালে, সেতুর উপর রেলিঙের ছায়ার ছবি, কাঠের দেওয়ালে মই আর সৈন্যের ছবি, গ্যাস ট্যাংকের গায়ে হ্যান্ডেলের ছবি, পাথরের গায়ে মানুষের ছায়ার ছবি খুঁজে পেলেন বিজ্ঞানীরা। আণবিক রশ্মি মেয়েদের পিঠে খোদাই করে দিল তাদের কিমোনোর নকশা।
বিকিরণের বিপদ কেটে গেলে ধীরে ধীরে পুরনো শহরে ফিরে এল মানুষ। ধ্বংসস্তূপে তেরো বছরের মেয়ের চিহ্ন খুঁজে খুঁজে তিন মাস পর তোমিকো ইনোউয়ের মা খুঁজে পেলেন নিজের কিমোনোর কাপড় দিয়ে গাঁথা মেয়ের এক পাটি কাঠের চপ্পল। মেয়ের বাঁ-পায়ের ছাপ স্পষ্ট তার ওপর। বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইয়োশিকো কিতামুরার দোমড়ানো জলের বোতল খুঁজে পেলেন বাড়ির লোকজন। ৫৪ বছরের বৃদ্ধ মোসোরোর খুলি পাওয়া গেল। চোখে কাচ আর লোহা-গলা তাঁর সেই চশমা। পাওয়া গেল ছাত্রছাত্রীদের পোড়া ইউনিফর্ম, কারও বুকপকেটে স্কুল বা কোম্পানি ব্যাজ, আধপোড়া টিকিট। বিস্ফোরণের তিন দিন পর হাইস্কুলের শূন্য প্রাঙ্গণে, তেরো বছরের শিগেরু অরিমেনের মা খুঁজে পেলেন ছেলের দেহ, আর পেটের নীচে আঁকড়ে রাখা তার না-খাওয়া, জমাট বাঁধা কালো-ভাতের লাঞ্চ বক্স। মৃত তিন বছর এগারো মাসের শিনইচি তেত্সুতানির বাবা বাড়ির পিছনে ছেলের দেহের সঙ্গে কবর দিলেন তার ছোট্ট ট্রাইসাইকেল। সাইকেল আরোহী ঊনষাট বছরের কেনগো নিকাওয়ার পোড়া দেহে পাওয়া গেল পকেটঘড়ি, সকাল ৮.১৫-য় থেমে তার সময়।
লোহা, কাচ, ইট, কংক্রিট, হাড়গোড় দলা পাকিয়ে চতুর্দিকে। কোথাও গলে যাওয়া ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের ধাতব মূর্তি। শুরু হয়েছে চিকিত্সা, উদ্ধার, নতুন করে শহর গড়ার কাজ। বিস্ফোরণের সময় পাঁচ বছরের মেয়ে হিরোয়াকি ইচিকাওয়া শুনেছিল, আগামী কুড়ি বছরের জন্য বন্ধ্যা হয়ে গেছে হিরোশিমার মাটি। কিন্তু তাদের ঝুপড়ির পিছনের ফাঁকা জমিতে জেগে উঠল কুমড়ো, ফুটল ফুল।
nilanjanbanerjee1974@gmail.com