মুঘল আমলে দশ অবতার এল বাঁকুড়ার গোল তাসে

প্রায় ৫০০ বছর আগে মল্লভূমে শুরু হয় এই খেলা। অথচ বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির এই চিহ্নটি আজ অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রায় ৫০০ বছর আগে মল্লভূমে শুরু হয় এই খেলা। অথচ বাংলার প্রাচীন সংস্কৃতির এই চিহ্নটি আজ অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে।

Advertisement

ঊর্মি নাথ

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৮:২০
Share:

ঐতিহ্য: ফৌজদার পরিবারের সবাই একসঙ্গে দশ অবতার তাস তৈরিতে মগ্ন।

সময়টা ১৫৬৫ সালের কাছাকাছি। মল্লভূমের উপর দিয়ে শিষ্যদের নিয়ে বৃন্দাবন থেকে গৌড় যাচ্ছিলেন বৈষ্ণব গুরু শ্রীনিবাস আচার্য। গোটা বাঁকুড়া এবং বর্ধমান, বীরভূম, সাঁওতাল পরগনা, মেদিনীপুর ও পুরুলিয়ার কিছু অংশ নিয়ে তৎকালীন মল্লভূম। হঠাৎ রে-রে-রে। কয়েক মুহূর্তে সর্বস্বান্ত হয়ে গেলেন গুরু ও চ্যালার দল। সঙ্গের পুঁথিগুলিও মুক্তি পেল না, সব লুঠ করে নিয়ে গেল এক দল লুঠেরা।

Advertisement

মল্লভূমের ৪৯তম রাজা বীর হাম্বীরের নির্দেশে এই কাণ্ড ঘটেছিল। সেই সময় দিল্লির মসনদে সম্রাট আকবর। আফগানদের সঙ্গে আকবরের যুদ্ধে রাজা হাম্বীর জানপ্রাণ লড়িয়ে দিলেন। পরাজিত হল আফগান। আকবরের নয়নের মণি হয়ে গেলেন বীর। কিন্তু এ কী হল পরাক্রান্তশালী রাজা বীরের? লুঠ করা পুঁথিগুলির মধ্যে শ্রীনিবাসের লেখা ভাগবত পড়ে বীরের পরিবর্তন হল ‘রত্নাকর থেকে বাল্মীকি’। শ্রীনিবাসের কাছে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। ‘অহিংসা’ হয় বীরের মূলমন্ত্র। মল্লভূমে তাঁর ৫৫ বছরের শাসনকালকে ইতিহাস স্বর্ণযুগের তকমা দিয়েছে। বিচক্ষণ, সুশাসক এবং শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বীরের উৎসাহে তৈরি হয়েছিল বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরগুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ রাসমঞ্চটি। রাজার কাছে বিনোদনের সংজ্ঞাও বদলে গেল। শিকার নয়, রক্তপাত নয়। গুরু শ্রীনিবাসের উৎসাহে তাসের খেলা শুরু হল মল্লভূমে। যে খেলা রাজা-রানি-জোকার নিয়ে নয়, ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতার নিয়ে তাসের খেলা! বাংলায় শুরু হল খেলার ছলে ঈশ্বর ভজনা।

ব্যাবিলন না মিশর না কি ফ্রান্স...কবে কোথায় প্রথম তাস খেলা শুরু হয়েছিল? উত্তর নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু ভারতে তাস খেলার ইতিহাস দীর্ঘ দিনের। ইউরোপীয়রা ভারতে আসার অনেক আগেই রাজস্থান, মহীশূর, অন্ধপ্রদেশ, কর্নাটকে তাস খেলা হত, যার নাম ছিল ‘গঞ্জিফা’। গঞ্জিফার উল্লেখ পাওয়া যায় বাবর-কন্যা গুলবদন-এর লেখা ‘হুমায়ুননামা’য়, অাবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’তে। শোনা যায়, সম্রাট আকবর ভালবাসতেন গঞ্জিফা খেলতে। কখনও ১৪৪টি, কখনও ৯৬টি তাস নিয়ে গঞ্জিফার একটি সেট তৈরি হত হাতির দাঁত দিয়ে। এখনও সে জিনিস দেখা যায়, তবে জয়পুর মিউজিয়ামে। রাজা-রাজড়ার খেলা ক্রমশ জনপ্রিয় হয় আম আদমির মধ্যেও। গঞ্জিফার ইসলামিক চিহ্নের জায়গায় জায়গা করে নেয় হিন্দু দেব-দেবী, বিষ্ণুর দশ অবতার।

Advertisement

শ্রীনিবাস ছিলেন ওড়িশার মানুষ। শ্রীনিবাসের হাত ধরে এই খেলা বাংলায় এলেও, এখানে এসে খেলার নিয়ম কিছুটা বদলে যায়। ওড়িশার দশ অবতারের তাসের একটি সেটে থাকত ১৪৪টি তাস। যেখানে গণেশ, কার্তিককেও বিষ্ণুর অবতার রূপে পাওয়া যায়। বিষ্ণুপুরে দশ অবতার তাসের একটি সেট ১২০টি তাস নিয়ে। গণেশ-কার্তিকের উল্লেখ নেই। এখানে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, জগন্নাথ (বুদ্ধের জায়গায়) এবং কল্কি; বিষ্ণুর এই দশ অবতারের মূর্তি আঁকা থাকে তাসে। প্রত্যেক অবতারের আবার ১২টা করে তাস। তার মধ্যে একটা রাজা ও একটা মন্ত্রী। বাকি দশটায় থাকে অবতারের প্রহরণ বা জ্ঞাপক চিহ্ন। যেমন মৎস্য অবতারের মাছ, কূর্মর কচ্ছপ, বরাহের শঙ্খ, নৃসিংহের চক্র, বামনের হাঁড়ি, পরশুরামের টাঙ্গি, রামের বাণ, বলরামের গদা, জগন্নাথের পদ্ম এবং কল্কির তরবারি। প্রথম পাঁচ অবতার, অর্থাৎ মীন, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন— এই পাঁচটি তাসের ক্রমপর্যায় হল রাজা, মন্ত্রী, তার পর দশ, নয়, আটি (আট), সাতি (সাত) ইত্যাদি। এক্কা (এক) সব চেয়ে ছোট। পরের পাঁচটি অবতার, অর্থাৎ পরশুরাম থেকে কল্কি পর্যন্ত রাজা-মন্ত্রীর পর বড় এক্কা, তার পর দুরি (দুই)। এই করে সবচেয়ে ছোট দশ। দশ অবতার তাস পাঁচ জন মিলে খেলে, যা ১০ মিনিটের মধ্যেও শেষ হতে পারে। আবার এক ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। সকালে খেলা হলে তাসের রাজা রামচন্দ্র, রাতে হলে মীন।

দশ অবতার তাসের ছবি

বীর হাম্বীরের উত্তরসূরি রাজা রঘুনাথ সিংহ এবং তাঁর ছেলে বীর সিংহের আমলেও এই খেলা বাংলায় বেশ জনপ্রিয় হয়। ইউরোপীয়রা এ দেশে নোঙর ফেলার পর ভারতীয়রা পরিচিত হয় চারকোনা ৫২ তাসের খেলার সঙ্গে। ক্রমশ ইউরোপীয় রাজা-রানি-জোকারের জনপ্রিয়তার সামনে কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়ে বিষ্ণুপুরের দশ অবতার।

এখনও বিষ্ণুপুরের দশ অবতার তাস গঞ্জিফার মতো ইতিহাস হয়ে যায়নি ঠিকই, তবে লুপ্ত হওয়ার কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। একমাত্র বিষ্ণুপুরের মনসাতলার ফৌজদার পরিবারের প্রচেষ্টায় টিমটিম করে বেঁচে আছে দশ অবতার তাসের অস্তিত্ব। এই পরিবারটি হাত তুলে দিলেই হারিয়ে যাবে এই শিল্প।

বীর হাম্বীর তাঁর সেনাপতি কার্তিক ফৌজদারকে দশ অবতার তাস তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর আমল থেকে আজ পর্যন্ত ফৌজদার পরিবার এই কাজ করে আসছেন। ‘‘অতি কষ্টে আছি, আর্থিক অনটন প্রবল। প্রাচীন এই ঐতিহ্যকে কত দিন ধরে রাখতে পারব জানি না। বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুর দেখতে আসা দেশি-বিদেশি অনেক পর্যটক গাইডদের কাছে এই তাসের গল্প শুনে আসেন আমাদের বাড়ি। এক-এক সময় তো দিনে চার পাঁচটা দল আসে। ওঁরা এসে আমাদের কাজ দেখেন, ফোটো তোলেন, প্রশংসা করেন। কপাল ভাল থাকলে এক জন হয়তো কিনলেন। এমনও দিন গিয়েছে, অনেকগুলো দল এসেছে কিন্তু তাঁদের মধ্যে এক জনও কেনেননি। এতে কী করে আমাদের চলবে?’’ ফৌজদার পরিবারের দশ অবতার তাসের শিল্পী শীতলের এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সত্যি কঠিন।

শীতলের জ্যাঠামশাই ভাস্কর ফৌজদার। যাঁর কাছ থেকে এই তাস তৈরির কাজ শিখেছেন শীতল ও তাঁর দাদা সুবল। ভাস্করবাবুর প্রয়াসেই পৃথিবী জেনেছিল দশ অবতারের তাসের কথা। লন্ডন, স্কটল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ আমেরিকা, বহু দেশের আমন্ত্রণে তিনি সাগর পাড়ি দিয়েছিলেন, বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। কিন্তু এত কিছুর পরও তিনি এ দেশে এই শিল্পকে ঘুরে দাঁড় করাতে পারেননি। দশ অবতার তাস তৈরি করে উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়ার হতাশা তাঁর আমৃত্যু ছিল। যে সমস্যা এখন আরও জীবন্ত, আরও প্রকট।

তেঁতুলবিচির আঠা, মেটে সিঁদুর, গালা, বেলের আঠা, শিরীষের আঠা, পুরনো কাপড়, খড়িমাটি ইত্যাদি এই তাসের উপকরণ। রং করার জন্য ব্যবহার করা হয়, সিমপাতার রস, হলুদ, কালি, নীল ইত্যাদি। ফৌজদার পরিবার এখনও পুরনো উপকরণ পুরনো প্রথা মেনেই তৈরি করেন এই তাস। বৃত্তাকার চার থেকে দশ সেন্টিমিটার ব্যাসযুক্ত এবং ১/৫ ইঞ্চি পুরু এই তাস তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ ও পরিশ্রমের। ১২০টি তাসের সেটের দাম মোটামুটি ১০ হাজার টাকা! এখন অবশ্য সিম্বল হিসেবে দশ অবতার তাসের ১০টি তাসের সেটও পাওয়া যায়। তার দাম হাজার থেকে বারোশো। এই অঙ্কটা পরিশ্রম ও ঐতিহ্যের নিরিখে যথাযথ, কিন্তু তা দিতে অধিকাংশ ক্রেতা নারাজ। হাতে গোনা ক্রেতাদের মধ্যে বিদেশিদের সংখ্যাই বেশি। শীতলের কাছ থেকে জানা গেল, বছরে সর্বসাকুল্যে দুই-তিন সেট বিক্রি হয়। এখনও বিষ্ণুপুরের কিছু মানুষ এই খেলা নিয়মিত খেলেন, তাঁরা মাঝেমধ্যে কিনে নিয়ে যান ফৌজদারদের কাছ থেকে।

দশ অবতার তাসের খেলার মতোই অনেকটা নকশা তাসের খেলা। যা খেলার রেওয়াজ ছিল মল্লভূমে। এই তাসও তৈরি করতেন এবং এখনও করেন এই ফৌজদার পরিবার। কিন্তু আজ নকশা তাসও দশ অবতারের মতো পঞ্চভূতে বিলীন হতে চলেছে। ‘‘৪৮টি তাস নিয়ে এক সেট নকশা তাস। পরি, যোদ্ধা, পাতা, শঙ্খ, ঝাড় ফুল, বরফি ফুল, তরোয়াল, আম ফুল, ঘাস ফুল, কল্লোল ফুল, ঘোড়ার উপরে ঘোড়সওয়ার, হাতির উপর মাহুত। ১২টি চিহ্নের চারটে করে তাস। চার জন লাগে এই খেলার জন্য,’’ জানা গেল শীতলের কাছ থেকে।

দশ অবতার তাস বা নকশা তাস তৈরি করে আর পেট চলে না ফৌজদার পরিবারের। দাদা সুবলও অসুস্থ। তাই কিছুটা পেটের টানে শীতল মাটির ঠাকুর গড়েন, বিষ্ণুপুর ঘরানার পট তৈরি করেন। ‘‘দাদা খুব অসুস্থ। অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাকে কাজে সাহায্য করে। আমরা যদি একটা সরকারি ভাতা পেতাম, খুব সুবিধা হত। অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আজও কোনও ভাতা পাইনি,’’ খেদ শীতলের গলায়। ওঁরা সরকারি ভাতা পাননি, তাই হয়তো জেদটা আরও বেড়ে গিয়েছে এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার। ‘‘আমার ভাইপো ও তাদের স্ত্রীদের হাতে ধরে শিখিয়েছি তাস আর পট তৈরির কাজ। বউরা ঘরের কাজের পাশাপাশি এই কাজও দিব্যি শিখে নিয়েছে,’’ শীতলের গলায় এক চিলতে খুশির ঝলক।

ফৌজদার পরিবার যেখানে এককাট্টা হয়েছে এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার, সেখানে সরকার নীরব। এমনকী রাজ্যের মেলাগুলিতে এখনও ডাক পড়ে না ফৌজদারদের। ‘‘মেলা এখন অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। মেলায় যেতে গেলে দরখাস্ত দিতে হবে। আগে মেলায় শিল্পীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষই করত, রেমুনারেশন দিত। এখনও দেয়, তবে তার অঙ্কটা বেশ কম, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও নিজেদের করতে হয়। আমরা শিল্পীরা এখন থার্ড পার্সন হয়ে গিয়েছি,’’ অনুযোগ শীতলের।

বিষ্ণুপুর শব্দটায় মিশে আছে জোড় বাংলা, শ্যামরাই মন্দির, রাসমঞ্চ, টেরাকোটার মন্দির, বালুচরী শাড়ি। বলতে বাধা নেই, আর্কিয়োলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার দৌলতে এই মন্দিরগুলির রক্ষণাবেক্ষণ প্রশংসনীয়। পশ্চিমবঙ্গে পর্যটন শিল্পের বিজ্ঞাপনেও জায়গা পেয়েছে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার মন্দিরগুলি। কিন্তু সেই অঞ্চলেরই দশ অবতার তাসের ঐতিহ্যের কথা আজ অধিকাংশ মানুষ জানেন না! তা হলে কি এই তাসের ভবিষ্যৎও গঞ্জিফার মতো, কিছু দিনের মধ্যে সেও কি জায়গা করে নেবে মিউজিয়ামের কাচের আলমারিতে?

ফৌজদার পরিবারের ছবি: শুভ্র মিত্র

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement