ক্যাপ্টেন হ্যাডক নই

আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে’— এই গানটা আমি বার বার শুনতাম মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফাইনাল ইয়ারে। গানটা আমাকে অভয় দিত। কারণ, তখন আমার জীবন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।

Advertisement

ববি চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে

Advertisement

সাত সাগর আর তেরো নদীর পারে’— এই গানটা আমি বার বার শুনতাম মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফাইনাল ইয়ারে। গানটা আমাকে অভয় দিত। কারণ, তখন আমার জীবন একটা সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সামনেই জাহাজে উঠে পৃথিবীটাকে চষে ফেলার হাতছানি। তার আকর্ষণ প্রচণ্ড। অথচ সেই আকর্ষণের সঙ্গে মিশেছে আবছা ভয়। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন ও নিজের চেনা কোনাটাকে চিরকালের মতো হারিয়ে ফেলার ভয়। তাই নিজেকেই বার বার বোঝাতাম, চিন্তা কী? ঠিক খুঁজে আনব সেই রাজকন্যা।

এগিয়ে এল সেই খুশির দিন। ‘মোবিল শিপিং’ নামের এক বিরাট কোম্পানিতে চাকরি পেলাম। উঠে পড়লাম জাহাজে। আমার জাহাজের নাম ‘সিলভান অ্যারো’। ভেবেছিলাম ঝড়, তুফান, সমুদ্রের কোনও বিপদই আমার সামনে পাত্তা পাবে না। কারণ, সেই সময় আমার চেহারা ছিল পর্বতের মতো। ওজন ৯২ কেজি, উচ্চতা ছ’ফুট, ছাতি ছাপান্ন ইঞ্চি।

Advertisement

কিন্তু জাহাজে উঠেই খুব বড় ধাক্কা খেলাম। জাহাজটা ছিল ব্রিটিশ অধ্যুষিত। তাই আমার সামনে এসে দাঁড়াল বর্ণবিদ্বেষ। মোটামুটি জানতামই, র‌্যাগিং হবে। কিন্তু, র‌্যাগিংয়ের মধ্যে যখন বর্ণবৈষম্য ঢুকে যায়, তখন ব্যাপারটা আর হাসি-ঠাট্টায় সীমাবদ্ধ থাকে না। আমি বুঝতে পারলাম, এরা আমাকে ঘেন্না করে। আমার চামড়ার রং দেখে ধরে নিয়েছে, আমি নোংরা, অলস, অকর্মণ্য। আমার সঙ্গে বসে কেউ খেত না। ভাল করে কথা বলত না। গালিগালাজও করত। ওরা যা বলত আমি তা-ই করতাম। এক বার প্রচণ্ড ঠান্ডায় আমাকে বিবস্ত্র হয়ে দৌড়তে বলল। দৌড়লাম। খারাপ খাবার খেতে দিত। তা-ই খেতাম। এতে ওরা কোনও মজা পেত না। বোর হয়ে যেত মনে হয়। আমার রাগ হত, কান্না পেত, পরের বন্দরে নেমে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করত। সামলে নিতাম। শুধু ঠিক করেছিলাম, গায়ে হাত তুললে আমি ছেড়ে কথা বলব না। বাকি সব দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম। জাহাজ এক বার ইকুয়েটর পেরোচ্ছিল। ওরা বলল, যারা জীবনে প্রথম বার ইকুয়েটর পেরোয়, তাদের ন্যাড়া হতে হয়। এটাই ইকুয়েটর ক্রসিং সেরিমনি। এই বলে আমার মাথা মুড়িয়ে দিল। আমি আয়নায় আমার জায়গায় একটা টাটকা ডিমসেদ্ধকে দেখলাম।

জাহাজটা ছিল একটা পাঁচতারা হোটেলের মতো। বিলিয়ার্ডস রুম, খেলার জায়গা, রেস্তরাঁ, ‌সুইমিং পুল, লাইব্রেরি— সব ছিল! আমি এ-সবের অধিকার নিয়েই এখানে এসেছি, তবু আমাকে এগুলোর ধারেকাছে যেতে দেওয়া হত না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইঞ্জিন রুমে কাজ করতে বাধ্য করা হত।

ইঞ্জিন রুমটা ছিল জাহাজের একেবারে নীচে। খোলের মধ্যে। সারা ক্ষণই সেটা জলের তলায় থাকত। সমুদ্রের টাটকা আলো-হাওয়া সেখানে ঢুকতই না। ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকত ওই ঘরের। সঙ্গে তেমনি আওয়াজ। মানুষ ওই ঘরে বেশি ক্ষণ সুস্থ ভাবে বাঁচতেই পারবে না। সেখানে আমাকে এক বার সাদা বয়লার স্যুট পরিয়ে টানা তিন দিন কাজ করানো হয়েছিল। ঘুম-বিশ্রাম সব বাদ। এই ভাবে কাজ করতে করতে হঠাৎ আমার মনে হল, আরে, আমি তো তিন দিন তিন রাত জলের তলায়! খোলা আকাশ দেখিনি টানা তিন দিন! তখন রাতের বেলা। জাহাজ সিঙ্গাপুর ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার দিকে চলেছে। আমি সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ারকে বললাম, বাথরুম যাব। এই বলে চুপিচুপি সিঁড়ি দিয়ে উঠে পৌঁছে গেলাম জাহাজের ডেকে। সিলভান অ্যারো তখন সত্যিই তিরের বেগে ছুটছে জাভা সি-এর জল কেটে। আপনারা কখনও আকাশ দেখে ভয় পেয়েছেন? সেই রাতে আকাশ দেখে আমার বুক ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। খোলা পরিষ্কার আকাশ। তাতে কোটি কোটি তারা। মনে হল, এটা পৃথিবীর আকাশ নয়। এরা আমাকে ভিনগ্রহে নিয়ে চলে এল না তো? অসম্ভব নয় কিছুই।

সেই ঘটনার পর একটা রোখ চেপে গেল আমার মধ্যে। ঠিক করলাম, ওদের বুঝিয়ে দেব, পড়াশোনাটা আমিও করে এসেছি। তত দিনে ইঞ্জিন রুমে থাকতে থাকতে জাহাজের সব মেশিন ও কলকব্জা আমার নখদর্পণে। কোথায় ভালভ্, কোথায় পাইপলাইন, সব হাতের তালুর মতো চেনা। আমি অন্যের কাজ এগিয়ে দিতে লাগলাম। মেরিন ইঞ্জিনিয়ারদের সবচেয়ে শক্ত কাজ হল জাহাজের বয়লারকে ফায়ার করা। সেটাও যখন অবলীলাক্রমে করে ফেললাম, সবাই আমার ওপর অনেকটা নরম হতে শুরু করল। সাদা চামড়া বুঝল, বাদামি চামড়াও কাজ পারে, বন্ধু হতে পারে। একটু ভয়ও পেতে লাগল ওরা আমাকে। কারণ, ইঞ্জিনরুমের চাবিকাঠিটি আমার কাছে থাকত। তবে, আমার প্রতিশোধ নেওয়ার কোনও ইচ্ছে ছিল না। আমি শুধু একটাই জিনিস চাইলাম। যখনই জাহাজ কোনও নতুন দেশের বন্দরে ভিড়বে, আর কেউ যাক না যাক, আমাকে সে দেশে নামতে দিতে হবে।

‘ইকুয়েটর রিচুয়াল’। ন্যাড়া হতেই হল!

আমার দ্বিতীয় জাহাজের নাম ছিল ‘ওয়ানিতা’। সেই জাহাজটা এত বড় ছিল যে যাতায়াতের জন্য ছোট গাড়ি ব্যবহার করতে হত। ক্যারিবিয়ান সাগরে ভাসতে ভাসতে সেই জাহাজের বুকেই ক্রিকেট ম্যাচে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হলাম আমি। সবার হাততালি শুনে মনে হচ্ছিল, কোনও ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচে ভারতের মান রেখেছি। বর্ণবৈষম্যকে হারিয়ে দিলাম একেবারে।

এই ‘ওয়ানিতা’ জাহাজের শেফ ছিলেন পেরেইরা। শ্রীলংকার লোক। খুবই ভাল রাঁধুনি। কিন্তু আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারতেন না। কারণ, আমি ছুতোনাতায় তাঁর রান্নাঘরে ঢুকে পড়তাম। রান্না নিয়ে এটা-ওটা তর্ক জুড়তাম। আমি বাঙালির ছেলে, রান্নায় উৎসাহ তো থাকবেই। পেরেইরা বুঝতেন না। বলতেন, আরে, তুমি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছ না রান্নার কোর্স করেছ?

এ রকম সময়েই আমাদের জাহাজ এল চট্টগ্রামে। আমার পূর্বপুরুষের দেশ-গাঁ। আমার তো আনন্দ ধরে না। ইলিশের গন্ধ টানছি বুকে। জাহাজ থামল বন্দর থেকে একটু দূরে। এক মুসলমান মাঝির ডিঙিতে চেপে আমি বন্দরে চললাম। যেতে যেতে দেখি, আশপাশের নৌকোয় খোল ভর্তি রুপোলি ইলিশ চকচক করছে। কয়েকটা বেছে নিয়ে আমি জাহাজে ফিরলাম। সরষে ইলিশ রেঁধে খাওয়াব সবাইকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে হেঁশেলে ঢোকার অনুমতি আদায় করলাম। পেরেইরা বলল, সে ছুঁয়েও দেখবে না আমার রান্না। খুব ঝাল ঝাড়তে লাগল। ইলিশ রান্না করা খুব শক্ত। ‘তোমার রান্না খেয়ে ক্যাপ্টেন ওকা অসুস্থ হয়ে পড়বে। তোমাকে বরখাস্ত করবে।’

হল ঠিক উলটোটা। ক্যাপ্টেন ওকা চেটেপুটে সেই রান্না খেলেন। বললেন, রাতের জন্য দু’টুকরো মাছ সরিয়ে রাখতে। উনি আবার খাবেন। কিন্তু রাতে পেরেইরা সুবোধ বালকের মতো এসে বলল, আর মাছ নেই। কেউ খেয়ে নিয়েছে। কে খেয়েছে সে জানে না।

ক্যাপ্টেন ওকা রেগে কাঁই। আমিও অবাক। জাহাজে বেড়াল এল কোত্থেকে! তার পর পেরেইরার পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সব বোঝা গেল। স্পষ্ট সরষের ঝাঁজ পেলাম। পারফিউম যতই লাগাও ভাই, বাঙালির নাককে ঠকানো শক্ত। পরে অবশ্য বেড়ালটি সরষে ইলিশকে প্রচুর কুর্নিশ জানিয়েছিল।

তবে এই ক্যাপ্টেন ওকা-র হাতেই আর একটু হলেই আমার চাকরিটি যাচ্ছিল। এ কাহিনি সিঙ্গাপুরের। সিঙ্গাপুরে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলাম। হয়েছিল কী, সিঙ্গাপুরে একটা নতুন হিন্দি ছবি রিলিজ করেছিল। ‘কভি খুশি কভি গম’। আমি সেটা দেখতে গিয়েছিলাম। দেশ থেকে অত দূরে শাহরুখ-কাজলকে দেখে আমার যে কী হয়ে গেল! এক বার সিনেমাটা দেখে, আমি আবার ঢুকলাম সেটা দেখতে। তার পর তার একটা সিডি-ও জোগাড় করলাম! এ সব করতে গিয়ে আমার জাহাজে ফেরার বোটটা মিস হয়ে গেল। শেষে অনেক কষ্ট করে যখন বন্দরে ফিরলাম, তখন গভীর রাত হয়ে গেছে। জানতে পারলাম, ফিরিনি বলে আমার ছবি দিয়ে সিঙ্গাপুরে হুলিয়া বেরিয়ে গেছে। ভোরের প্রথম বোট ধরে জাহাজে ফিরে ক্যাপ্টেন ওকার রক্তচক্ষুর সামনে পড়তে হল। তিনি আমার হাতের সিডিটা দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, এটা কী? আমি ঘাবড়ে গিয়ে বলে ফেললাম, এর জন্যই তো দেরি হয়ে গেল। ক্যাপ্টেন ওকা সিডিটা নিয়ে চলে গেলেন। উনি যেমন রাগী মানুষ, তেমনি খামখেয়ালি। আমি ভাবতে বসলাম, কাজটা ঠিক হল? ওকা ইরানের লোক। সেখানকার কাঠখোট্টা সিনেমা দেখে অভ্যস্ত। এ সব বলিউডি নাচগান দেখলে উনি কী বলবেন? কিন্তু আমার আর ডাক পড়ল না। সবার কথা শুনে ওকা-র খোঁজে গিয়ে, তাঁকে পেলাম জাহাজের সিনেমা হলে! ওকা সিনেমাটা দেখছেন ও ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছেন। সে যাত্রা শাহরুখ খান আমার চাকরিটা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন!

জাহাজ-জীবনে আফ্রিকা ছাড়া সব মহাদেশেই গেছি। তেতাল্লিশটা দেশ দেখেছি। এক বার জাহাজ এল আমেরিকার টেক্সাসে, হিউস্টনে। নোঙর ফেলল মাঝসমুদ্রে। সেখান থেকে মিসিসিপি নদী পেরিয়ে বন্দরে যাওয়ার কথা। বাংলাদেশে যেমন ডিঙি নৌকা, এখানে তেমনি স্পিডবোট। প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে। সেই বোটের সামনে দাঁড়িয়ে আমি। সহকর্মী অ্যাশডিনকে ব্যাগটা দিয়ে বললাম, আমার একটা ছবি তুলে দাও। সে ব্যাগটা নিয়ে যেই ক্যামেরাটা বের করতে গেল, অমনি দারুণ জোরে হাওয়া দিল। টাকাপয়সা, দরকারি কাগজপত্র আর আমার কবিতার খাতা— সব উড়ে গিয়ে পড়ল মিসিসিপি নদীর ভিতর। বলা বাহুল্য, ক্যামেরাটাকে হাওয়া ওড়াতে পারল না। দুঃখের স্মৃতিটুকু থাক, ভেবে আমি ওই অবস্থাতেও ছবি তোলার জন্য পোজ দিলাম।

এক বার, আমার জাহাজ ‘ভ্যালিয়ান্ট’ টেক্সাস থেকে এল মেক্সিকোতে। সবাই বলল, মেক্সিকো খুব গরিব দেশ। এখানে নেমে কী করবে? ছেড়ে দাও। তবু, প্যাহারিটোস নামের বন্দর আসতেই আমি নেমে পড়লাম। সঙ্গে সেই ক্যামেরা আর সর্বসাকুল্যে ৫০০ ডলার। বিদেশে গেলেই অনেকেই দেখেছি প্রথমেই রঙিন জলের সন্ধান করে। কিন্তু, নাবিক হলেও আমি ক্যাপ্টেন হ্যাডকের অভ্যেসগুলোর বরাবরই ঘোর বিরোধী। আমার নেশা হল দেশ দেখা। তাই, বন্দরে গিয়ে আগে এক জন গাইড পাকড়াও করলাম। তার নাম রামোস। এক দিনের জন্য দেশ দেখাতে হবে শুনেও সে রাজি হয়ে গেল। অটো-রিকশার মতো একটা গাড়িতে চেপে প্রায় দু’ঘণ্টা জার্নি করে একটা শহরে পৌঁছলাম আমরা। শহরটার নাম কোয়েৎজাকয়েলকস। এ নামের মানে, যেখানে সাপ লুকিয়ে থাকে। অভিনেত্রী সালমা হায়েকের জন্মভূমি।

সাপ দেখতে না পেলেও এই শহরের খাঁটি মেক্সিকান খাবার খেয়ে আমার মন ভরে গেল। প্রথমে এল ‘মেনুডো’, পর্ক দিয়ে তৈরি মেক্সিকান স্যুপ। তার পর টর্টিয়া, মেক্সিকান পায়েস ‘কাহেতা’ খেলাম। ‘পিবিল পল্লো’ বলে একটা অভিনব পদ খেলাম। কাঁচালঙ্কা আর কমলালেবু দিয়ে রাঁধা চিকেন! সব থেকে বেশি উপাদেয় ছিল ‘পিকাদিয়ো’। বিফের একটা প্রিপারেশন। আমি ও-রকম কোত্থাও খাইনি। এত ভাল লাগল, সহকর্মীদের জন্য প্যাক করিয়ে নিলাম। তার পর রামোস আমাকে রাত কাটানোর জন্য একটা বাজেট হোটেলে নিয়ে গেল।

পর দিন রামোসের সঙ্গে আবার প্যাহারিটোসে ফিরলাম। ও আমাকে আগে নিয়ে গেল বাজারে। একটা ফলের দোকান দেখাবে। জিজ্ঞাসা করলাম, মেক্সিকোর ফল কি খুব বিখ্যাত? রামোস বলল, দোকান নয়, দোকানিই হল দ্রষ্টব্য। সে খুব জনপ্রিয়। দেখলামও তাই। একটা ফল-সবজির দোকান ঘিরে বিরাট ভিড়। মাঝখানে দোকানি দাঁড়িয়ে গান গাইছে। খুব ভাল গলা। তেমনই সুন্দর সুর। ভেবেছিলাম, কোনও বিখ্যাত লাতিন আমেরিকান গান গাইছে। রামোস জানাল, তা নয়। এই লোকটার নাম স্যাঞ্চেজ। প্রত্যেকটা গান তার নিজের লেখা, নিজের সুর করা। সে গান গেয়ে তার দোকানে রাখা ফল ও সবজির গুণাগুণ বর্ণনা করছে। ওগুলো খেলে কী কী উপকার হবে, তাতে কোন ভিটামিন মিনারেল আছে, সব বলছে গান গেয়ে। মা-বাবারা বাচ্চাদের এই দোকানে নিয়ে আসে, যাতে তারা গান শোনে ও ফাস্ট ফুড ছেড়ে অর্গ্যানিক ফুড খেতে শেখে। ভাবলাম, এই মানুষটি চাইলে তো বিরাট গায়ক হতে পারত। তা না করে ফল বিক্রি করে। অন্যের উপকার করে। এমনও হয়?

জাহাজে ফিরে মনে পড়ল, বিরাট ভুল হয়ে গেছে। পিকাদিয়ো’র প্যাকেটগুলো সেই সাপের দেশের হোটেলের ফ্রিজে রয়ে গেছে। মন খারাপ হয়ে গেল। তার পর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, ঘুম থেকে উঠতে উঠতে লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। আমার এক সহকর্মী এসে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বলল, দারুণ খাবার এনেছ তুমি। থ্যাংক ইউ। জানতে পারলাম, রামোস এসে খাবারের প্যাকেটগুলো জাহাজে দিয়ে গেছে।

আমার নাবিক জীবনের সব থেকে ভয়ংকর দিনটা দেখেছিলাম, সেই ‘সিলভ্যান অ্যারো’ জাহাজে। আমরা জলদস্যুর কবলে পড়েছিলাম। সেই জলদস্যুর মধ্যে রেড র‌্যাকহ্যাম, ব্ল্যাকবিয়ার্ডের গল্পের মতো রোমাঞ্চ ছিল না। জাহাজ নোঙর ফেলেছিল ফিলিপিন্স-এর একটু দূরে, সেবু বন্দরের কাছে। কানে এল, কোনও একটা কারণে আমাদের জাহাজকে বন্দরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তার পর যে কথা কানে এল, তা মনে পড়লে এখনও ভয়ে হাত-পা পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যায়। ওখানকার কুখ্যাত মাফিয়া গোষ্ঠী ৫০,০০০ মার্কিন ডলার দাবি করেছে। না দিলে দেশে ঢুকতে তো দেবেই না, উলটে জলদস্যু দিয়ে আক্রমণ করাবে। দু’দিন পেরিয়ে গেছে। জাহাজ সমুদ্রে দাঁড়িয়ে। রাতে আমার ঘুম ভাঙল ইন্টারকমের আওয়াজে। চিফ অফিসার ফোন করে কেবিন থেকে বেরোতে বারণ করলেন। জলদস্যুরা আক্রমণ করেছে। রাত তখন তিনটে। অন্ধকারে পোর্টহোলের মধ্য দিয়ে দেখলাম, পিঁপড়ে যেমন করে খাবারকে ছেঁকে ধরে, ঠিক সে ভাবে জাহাজকে ঘিরে ধরেছে ছোট ছোট নৌকো। জাহাজ থেকে হোসপাইপে জল ছুড়ে তাদের তাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রায় দু’ঘণ্টা এ ভাবে যুদ্ধ চলল। কোস্টগার্ডও এই মাফিয়াদের ভয় পায়। তাই তাদের দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না। ভোরের আলো ফুটছিল। দেখতে পেলাম, জাহাজের চারপাশে দড়ি খাটিয়ে পিলপিল করে লোক উঠছে। প্রমাদ গুনলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল, এদের অনেকেই মহিলা ও শিশু। এরা তো তা হলে জলদস্যু নয়। হতেই পারে না! ভুল ভেঙে গেল, যখন দেখলাম এদের সঙ্গে পুরুষরাও রয়েছে। তাদের হাতে বন্দুক। কিছু ক্ষণের মধ্যেই জাহাজের ভেতর লুটপাট শুরু হয়ে গেল। আমি কেবিনের মধ্যে ভয়ে কুঁকড়ে বসে থাকলাম। আই-হোল দিয়ে দেখলাম, করিডরে ওই সব লোকজন আর বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে। দরজায় দরজায় ধাক্কা মারছে। আমার দরজাতেও দুমদুম শুরু হল। ফোনে জানলাম, ক্যাপ্টেনের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ওরা সব টাকা নিয়ে নিয়েছে। বেশ অনেক ক্ষণ পর, দরজার আওয়াজ কমে এল। কেবিনের জানলা দিয়ে দেখলাম, ওরা নেমে যাচ্ছে। সঙ্গে মেশিন, ফ্রিজ, টিভি, খাবার, জামাজুতো, যা পেরেছে নিয়েছে। পরে জেনেছিলাম, এই সব মহিলা আর শিশুই হল ওদের ঢাল। তাদের দিয়ে জোর করে ওরা যৌনবৃত্তি চালায়। দরকার হলে গোলাগুলির সামনে ঠেলে দিতেও পিছপা হয় না। শুনে শিউরে উঠেছিলাম। ওদের মধ্যে আট-দশ বছরের বাচ্চাকেও দেখেছিলাম আমি! শুনেছিলাম, এই সব দেশে বাচ্চাকে এক টুকরো পাউরুটি দিয়ে যা খুশি তাই করিয়ে নেওয়া যায়। সে দিনের এই ঘটনায় শরীরের কোনও ক্ষতি সে ভাবে হয়নি। কিন্তু মন থেকে রক্ত ঝরেছিল।

আমি অল্প কয়েক দিনের জন্যই নাবিক হয়েছিলাম। তার পর পেশা বদলে ফেলি। ডাঙায় চলে আসি। শহরে ফিরে অভিনয় করতে শুরু করি। এখন অনেক রকমের চরিত্র সাজতে হয় আমাকে। অনেক রকমের আবেগ ফুটিয়ে তুলতে হয়। এ সবের জন্য আজও আমার ভরসা সেই অল্প কয়েক দিনের সমুদ্র আর তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

bobbymobil2001@yahoo.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement