বাংলা ছবির প্রবীণতম

কাজ শিখেছেন জঁ রেনোয়ার কাছে। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে। তার পর উত্তম-সুচিত্রার ‘শিল্পী’। ১০১ বছরের রামানন্দ সেনগুপ্ত টালিগঞ্জের প্রাচীনতম টেকনিশিয়ান। স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়কাজ শিখেছেন জঁ রেনোয়ার কাছে। ‘দ্য রিভার’ ছবিতে। তার পর উত্তম-সুচিত্রার ‘শিল্পী’। ১০১ বছরের রামানন্দ সেনগুপ্ত টালিগঞ্জের প্রাচীনতম টেকনিশিয়ান। স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৭ ০০:০০
Share:

বিস্মৃত: বাঁ দিকে, আলফ্রেড হিচককের সঙ্গে রামানন্দ। পাশে ‘শিল্পী’ ছবির দৃশ্য।

রাধা স্টুডিয়ো, ১৯৪৬। ‘নিশীথে’ ছবির শ্যুট চলছে। উত্তমকুমার ফ্লোরে বেশ বিরক্তি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি প্রস্তুত, কিন্তু সেট তৈরি হয়নি তখনও। চাঁদনী রাতের দৃশ্য। টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো থেকে রাধা স্টুডিয়োয় বদল হওয়ায় নতুন টেকনিশিয়ানদের দিয়ে আলো করতে একটু সময় লাগছে।

Advertisement

কিন্তু সে সব কি আর মহানায়ক শুনবেন? হুঙ্কারও দিলেন তিনি, ‘কী একেবারে আলো হবে! তার জন্য এত দেরি, হুঃ!’ এই ‘হুঃ’-তেই মাথা বিগড়ে গেল ক্যামেরাম্যান রামানন্দ সেনগুপ্তর। আলো করতে-করতেই সকলের সামনে বললেন, ‘উত্তম, তুমি তো অভিনয়, আলো, ক্যামেরা সব শিখে গিয়েছ। কিছুই তো বাকি নেই!’ বেশ অসন্তুষ্ট হলেও উত্তমকুমার কিছু বলেননি।

গোল বাধল আর এক দিন। উত্তম-সুপ্রিয়ার দৃশ্য। রামানন্দ একটু কায়দা করে আলো করেছেন। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে উত্তম সংলাপ বলবেন। সে দিন সোজাসুজি উত্তমের ওপর আলো দেননি রামানন্দ।

Advertisement

শট দিতে গিয়েই উত্তম অবাক! ‘এ কী! আমার মুখে আলো নেই!’ রামানন্দ বললেন, ‘অন্য একটা এফেক্ট হবে, অ্যাবস্ট্রাক্ট লাইটিং করেছি। এক বার দেখো।’

কে শোনে কার কথা! ‘আপনার সাহস তো কম নয়, উত্তমকুমারের মুখের ওপর আলো দেননি! দেখব পরের ছবি কী করে করেন,’ বেজায় চটলেন নায়ক। শেষ হয়ে গেল ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর আলোর কাজ!

তার পর থেকে সব পরিচালকই অর্ধেক স্ক্রিপ্ট শুনিয়ে বলতেন, ‘উত্তমের সঙ্গে এত কী ঝামেলা হল যে, ও বলছে রামদা থাকলে আর ছবি করব না? ও তো বক্স, ওকে নিতেই হবে। তোমাকে কাজ দিতে পারছি না।’ এমনও হয়েছে, ‘নিশীথে’-র শ্যুট দেখতে রামানন্দর বন্ধুরা এলে উত্তম তাদের শ্যুটিং-এ ঢুকতে দিতেন না! গল্ফ ক্লাব রোডের বাড়িতে বসে স্মৃতি হাতড়াচ্ছিলেন ১০১ বছরের রামানন্দ।

ভারতীয় চলচ্চিত্রে তিনি ইতিহাস তৈরি করেছেন। তিনিই প্রথম আলোকচিত্রশিল্পী যিনি ‘টেকনিকালার’-এ ছবি তুলেছিলেন। এর পিছনেও লুকিয়ে আছে আর এক ইতিহাস। বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্রকার জঁ রেনোয়া ১৯৪৯-১৯৫০-এ ভারতে আসেন, তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘দ্য রিভার’-এর লোকেশন দেখতে। রামানন্দর সঙ্গে পরিচয় হয় রেনোয়ার। আধুনিক প্রযুক্তির কাজ শিখতে উৎসাহী যুবক রামানন্দকে রেনোয়া ইংল্যান্ডে পাঠান ‘টেকনিকালার’ প্রযুক্তি শিখতে। রামানন্দ যখন দেশে ফিরে এলেন, রেনোঁয়া ‘দ্য রিভার’-এর শ্যুটিং শুরু করতে চলেছেন। ‘দ্য রিভার’-এ ‘অপারেটিভ ক্যামেরাম্যান’ হিসেবে কাজ করেছিলেন রামানন্দ।

সেই কাজ করা থেকেই রেনোয়ার সঙ্গে তাঁর বন্ধুতা। রামানন্দর বাড়িতেও গিয়েছিলেন রেনোয়া। চালগুড়ির আলপনা দেখে আর বেলের শরবত খেয়ে তিনি মুগ্ধ! উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর তিক্ততার কথা রেনোয়াকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন রামানন্দ। উত্তরে রেনোয়া বলেছিলেন, পৃথিবী জুড়ে সব অভিনেতাদেরই পছন্দের ক্যামেরাম্যান থাকে। বাদ পড়ার ঘটনা কিছু নতুন নয়।

উত্তমকুমারের স্মৃতি ভুলে তাঁর কথাতে বারেবারে উঠে আসছিল বন্ধু রেনোয়ার কথা। রেনোয়ার সঙ্গে লোকেশন দেখতে গিয়ে ছুটেছেন কখনও নদী, কখনও জঙ্গলে। ‘সে এক কাণ্ড! নদীতে মেয়েদের স্নান করা, কলসি ভরে জল তোলার দৃশ্য, ঝুপ করে ডুব দেওয়ার দৃশ্য দেখে রেনোয়া এমন লাফালাফি আরম্ভ করলেন যে মনে হচ্ছিল ওখানকার স্থানীয় লোকেরা না আমাদের ওপর চড়াও হয়,’ বললেন রামানন্দ। রেনোয়া পরে বলেছিলেন, ভারতীয় মেয়েদের কাঁখে কলসি, ঘাটে বসে স্নান, মাটিতে বসার ভঙ্গির মধ্যে তিনি শান্তির ইঙ্গিত পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষগুলোর ভঙ্গিতেই বোঝা যায় কতখানি শান্তিপ্রিয় এরা। আমাদের দেশে তো বাথরুমও লোকে দাঁড়িয়ে করে। ওরা শুধু যুদ্ধ চায়।’ একটানা বলে চলেছেন রামানন্দ। রেনোয়ার সব কথা তাঁর স্মৃতিতে উজ্জ্বল।

কথা বলতে-বলতে হাঁটছেন রামানন্দ। মনে পড়ল, টালিগঞ্জের প্রবীণতম এই ক্যামেরাম্যান একদা নন্দনে ফিল্মোৎসব উদ্বোধনের প্রদীপও জ্বালিয়েছিলেন।

ফিল্মোৎসব অনেক পরে। এক দিন ‘দ্য রিভার’ ছবির শ্যুট চলছে রেললাইনের ধারে। ইস্টার্ন স্ট্রাইকার স্টুডিয়োতে। ট্রেনের আওয়াজে শটই নেওয়া যাচ্ছে না। সকলে স্টুডিয়োর বাইরে বেরিয়ে এল। প্রত্যেকটা ট্রেনে উপচে পড়ছে যাত্রী। জানলায়, ছাদেও লোক! রেনোয়া অবাক! তাঁকে বোঝানো হল, দেশভাগের জন্য সকলে এ ভাবেই কলকাতা আসছে। রামানন্দ বলছেন, ‘সে দিন সাহেব বলেছিলেন, ‘আমি ভারতীয় হলে সারা জীবন শুধু দেশভাগ নিয়েই ছবি করতাম। ভারতীয় মানেই গরিব, কালো, খোঁড়া, কানা, বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে চাননি তিনি। বরং বলতেন, ‘আমাদেরও দেশে কালো গরিব সব আছে। ট্রলি বা ক্রেনের ব্যবহারও পছন্দ করতেন না রেনোয়া।

হিচককের সঙ্গেও মোলাকাত হয়েছিল এই বাঙালি সিনেমাটোগ্রাফারের। শুনেছিলেন, শ্যুটিং শুরুর আগে ছবি তৈরির আগে ছ’মাস শুধু চিত্রনাট্য নিয়ে নাড়াচাড়া করতেন হিচকক।

ক্যামেরার আলো, ছায়া নিয়েই কেটেছে রামানন্দের জীবন। ‘নাগরিক’ করার সময় ঋত্বিক ঘটকের কাছাকাছি এসেছিলেন তিনি। ‘এক বার সেটে বিয়ার খেয়ে এসেছিলাম বলে ঋত্বিক বেজায় চটেছিল! তখন ও মদ্যপানকে খুব খারাপ চোখে দেখত। নাটক নিয়ে তখন ও পাগল। অথচ সেই মানুষটাই মদে ডুবে নিজেকে শেষ করে দিল!’ আপশোস গলায়।

রেনোয়া-মুগ্ধতার জন্য মাঝে মধ্যে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ রামানন্দের অসম্ভব ভাল লেগেছিল, কিন্তু ওঁর সঙ্গে কাজ করা হয়নি। ‘এক দিন সত্যজিৎবাবু বললেন, ‘রেনোয়া আপনাকে চিঠি লেখে?’ ওঁর ভাবটা এমন ছিল, যেন আপনার মতো চাকর-বাকর স্তরের লোককে উনি কেন চিঠি লিখবেন!’ বলছিলেন রামানন্দ। প্রায়ই নিজের আলমারি খুলে ফাইল থেকে রেনোয়ার ছবি, হিচককের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। ফেলে আসা সময়কে ছুঁয়ে থাকতে চান।

সুচিত্রা সেনের কথা কোনও দিন ফেলতে পারেননি তিনি। সুশীল মজুমদারের ‘শুভরাত্রি’ ছবির কাজ চলছে। সে দিনই সুচিত্রাকে মুম্বই যেতে হবে। সুচিত্রা শুধু ছটফট করছেন, আর পরিচালককে তা়ড়া দিচ্ছেন। ‘আমি বললাম, আমার ছেলেরা কি বাঁদর যে লাফিয়ে লাইট করবে? পরিচালক সে দিন আমাকে ধমকেছিলেন, কিন্তু সুচিত্রা কিছু বলেননি,’ উত্তেজিত রামানন্দ। তাঁর প্রিয় ‘রামবাবু’র সঙ্গে কাজ করবেন বলে সুচিত্রা বহু বার ডেট অ্যাডজাস্ট করেছেন। উত্তম-সুচিত্রার ‘শিল্পী’ও ও ভাবেই হয়েছিল। ‘যে কোনও অ্যাঙ্গেল থেকেই সুন্দরী উনি। খুব নারীকেন্দ্রিক চরিত্র করতে চাইতেন। সেই জন্যই ওঁর প্রিয় ছিলেন অসিত সেন,’ যোগ করলেন রামানন্দ। অসিত সেন একদা রামানন্দের সহকারী ছিলেন।

নিজের হারিয়ে যাওয়ায় কোনও অভিমান নেই তাঁর। ‘একশো বছরেও কোনও গ্লানি নেই, এ বার যেতে পারলেই ভাল।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন