কা গে র ছা ব গে র ছা

একটা আকাশ, একটা মাদারি মেয়ে

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘টোপ’ পড়েছিলাম বহু বছর আগে। কিন্তু তা নিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে লেগে গেল তিরিশটা বছর। বার বারই মনে হত, ছুঁচের মধ্যে দিয়ে সুতো গলানোর চেয়েও কঠিন কাজ এই গল্প নিয়ে সিনেমা বানানো!

Advertisement

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘টোপ’ পড়েছিলাম বহু বছর আগে। কিন্তু তা নিয়ে চিত্রনাট্য লিখতে লেগে গেল তিরিশটা বছর। বার বারই মনে হত, ছুঁচের মধ্যে দিয়ে সুতো গলানোর চেয়েও কঠিন কাজ এই গল্প নিয়ে সিনেমা বানানো! আসলে গল্পটা বড়ই বাস্তবধর্মী, আর কবিতা কিংবা চিত্রনাট্য লেখার সময় আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করে বাস্তবাতীত বা এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটির জগৎ। ‘টোপ’-এ তার ছায়ামাত্র ছিল না, অথচ গল্পটাও ভাবাচ্ছিল। বেশ কিছু বছর ধরে দেশটাকে দেখছিলাম। দেখছিলাম বিশাল বড় ছিপ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কিছু শক্তিমান মানুষ, গেঁথে তুলে নিচ্ছে কবি, পেন্টার, গায়ক, ফিল্মমেকার, বক্তৃতাবাজদের। আর এরই মাঝখানে মিডিয়া ধুনো দিচ্ছে। ব্রিজের নীচে চাপা পড়া মরা মানুষের পা কোন চ্যানেল কত কাছ থেকে দেখাতে পারে, সেই লড়াই চলছে। মৃতেরাও টোপ হয়ে যায় এই দেশে। বুঝতে পারছিলাম, সময় এসে গেছে। আর সত্যি সত্যিই এক মাঝরাতে উঠে দেখলাম— ম্যাজিক! ‘টোপ’-এর চিত্রনাট্যের প্রথম পর্যায় শেষ।

Advertisement

চিত্রনাট্যে এসে পড়ল মুন্নির কথা। মুন্নি দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটে, সাইকেল চালায়, নানা রকম কসরত দেখায়। ঢোল-বাজিয়ে বাবা আর থালা-বাজানো মায়ের সঙ্গে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গা ঘুরে ঘুরে খেলা দেখায়। ছবিতে মুন্নি তার বেঁচে থাকার কথা বলে, সাধ-আহ্লাদ, ছোট ছোট স্বপ্নের কথা বলে। মুন্নির খোঁজে আমার টিমের লোকজন শহর আর শহরতলির অলিতে-গলিতে। কাউকে শিখিয়ে-পড়িয়ে এই কাজটা করানো যাবে না। কেন না মুন্নিদের দড়ির ওপর হাঁটতে শেখা আসলে শুরু হয়ে যায় মায়ের পেটের ভেতর থেকেই। আমার সত্যিকারের মাদারি-মেয়েই চাই। ডামি ব্যবহার করা বা শটের কারচুপিতে ব্যাপারটা ম্যানেজ করার প্রশ্নই নেই। এক্কেবারে শেষ মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া গেল মুন্নিকে, মানে কাজলকে।

বছর বারো-তেরোর কাজল অক্ষর চেনে না, আমাদের মতো মানুষজনদের চেনে না, চিনতে চায়ও না। যদিও চিত্রনাট্যের মুন্নির মতো কাজলও স্বপ্ন দেখে ওর রুপোর নাকছাবি হবে, গলার হার হবে, বিয়ের বর হবে। মুন্নির মতোই কাজল হয়তো বুঝতে পারে একটু একটু করে সে বড় হচ্ছে, তার শরীরে আস্তে আস্তে একটি নারী দানা বাঁধছে। এর বাইরে ও কিছুই জানে না, শুধু একটাই জিনিস জানে কাজল, দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটতে। কাজলের সঙ্গে আমাদের বা আমাদের সঙ্গে কাজলের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছিল কথা বোঝার বা কথা বোঝানোর। কী শব্দ দিয়ে কথা গাঁথলে তা কাজলের কাছে পৌঁছবে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না!

Advertisement

শুটিং শুরুর দিন সকালে কাজলকে নিয়ে হাজির আমার দলবল। সামান্য একটু চুল ট্রিম করতে চেয়েছিলাম আমরা। তাতে কাজল সমস্ত শরীর গুটিয়ে, ঘাড় গোঁজ করে, পাথরের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একে দিয়ে অভিনয় করানো! বাপ রে! এর চেয়ে অসম্ভব কাজ আর কী হতে পারে? ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে আসছিল পেটের ভেতর। কী হবে! কী করে হবে? অভিনয় তো করতেই হবে, সংলাপ বলতেই হবে, ক্যামেরার সামনে আলো নিয়ে দাঁড়াতেই হবে, হেঁটে যেতেই হবে এক মার্ক থেকে আর এক মার্ক।

কোন জাদুতে জানি না, সহযোগী পরিচালক সোহিনীর কথা ও বুঝতে পারত। প্রতিরোধ ভেঙে আস্তে আস্তে কাজল পালটাতে শুরু করল। দিন তিন-চারেকের মাথায় দেখলাম, সোহিনী যে ভাবে বলছে, দেখিয়ে দিচ্ছে, হুবহু সেটা করে ফেলছে কাজল। এমনকী না দেখে মার্ক-এ এসে দাঁড়ানো, আলো নেওয়া, শটের মাঝখানে অর্ডার ফলো করাও দিব্যি রপ্ত করে ফেলল। দীর্ঘ চল্লিশ বছরের সিনেমা বানানোর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছি, সবাইকে দিয়ে অভিনয় করানো যায় না। আর শত চেষ্টা করলেও সবার দ্বারা অভিনয় হয় না। কাজলের মজ্জায় মজ্জায় অভিনয় ছিল। কয়েক দিন একটা সুন্দর পরিবেশে, সবার সঙ্গে থেকে, কঠিন পাথর ভেঙে বেরিয়ে আসছিল হাসিখুশি, কৌতূহলী একটা বাচ্চাও। সেই ক’দিনে এক থেকে পঞ্চাশ অবধি লিখতে শিখে গিয়েছিল কাজল। আমরা ঠিক করেছিলাম, ছবির কাজ শেষ হয়ে গেলে ওকে কোনও ভাল বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেব। ওর বয়সি বাচ্চাদের সঙ্গে পড়া-লেখা, নাচ-গান-নাটক শিখবে, একটু বড় হলে অভিনয়টা আরও ভাল করে শিখে, পা রাখবে অভিনয়ের জগতেই। ওর কিশোরী মুখাবয়বে, চোখের স্ফুলিঙ্গে যে অভিব্যক্তি আমি দেখেছি, তা সাধারণ নয়। আমরা সবাই ভাবতে শুরু করেছিলাম, এ মেয়ে অনেক দূর যাবে। কিন্তু আকাশে ঝোলা দড়ির ওপর দিয়ে কতটাই বা যাওয়া যায়!

কাজলের অভিভাবকরা অনেক টাকার বিনিময়ে ওকে অভিনয় করতে দিয়েছিল। সবাই মিলে পাহারাদারের মতো নজর রাখত মেয়েটার ওপর। ছত্তীসগঢ়ের হতদরিদ্র বাপ-মায়ের বড় মেয়ে কাজল কুমারী। যে মহিলা কাজলের মাসি বলেছিল নিজেকে, আসলে সে ওর গ্রামতুতো দিদির শাশুড়ি। কাজলের বাবা-মা এদের কাছে বছরে পঁচিশ হাজার টাকা পায় মেয়েকে ভাড়া খাটিয়ে। কাজলের ছোট যে বোন, সেও এমনই কারও কাছে ভাড়া খাটে সেই সুদূর পঞ্জাবে। সবচেয়ে ছোট বোন এখন সবে দড়ির ওপর হাঁটতে শিখছে, ভাড়া খাটানোর আগে আরও বছর দুয়েক সময় পাবে সে।

আমরা অনেক চেষ্টা করেও কাজলকে নামিয়ে আনতে পারলাম না শূন্যে ঝোলা ওই দড়ির ওপর থেকে, কাজলের ‘মালিক’, ওর ‘বিরাদরি’-র কবল থেকে। আশ্চর্য ব্যাপার, যখন কাজলকে বলেছিলাম নতুন স্কুল, হস্টেল, নতুন বন্ধু, পরিষ্কার জামা-কাপড়, পেট ভরে খাওয়া-দাওয়ার কথা, তখন একদম চুপ করে ছিল কাজল। বেশ কিছু ক্ষণ পর মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বলেছিল— আমার বোন দুটোর কী হবে? ওরা তো ও ভাবেই থাকবে। বাবা, মা, বোনেরা সবাই আমায় বলবে— আমি কারও কথা ভাবলাম না, নিজে নিজেরটা বুঝে নিলাম।

কয়েক দিন আগে টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালে ‘টোপ’-এর ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়ে গেল ‘মাস্টার্স অব ওয়ার্ল্ড সিনেমা’ বিভাগে। ছবি শেষ হওয়ার পর আমি যখন মঞ্চে ফিরে এলাম আবার, তখন দাঁড়িয়ে উঠেছে তিন হাজার দর্শকে ঠাসা প্রেক্ষাগৃহের অর্ধেক লোক। তাদের প্রবল উচ্ছ্বাস প্রকাশের মধ্যে আমার কানে এল— ‘হোয়ার ইজ মুন্নি? হোয়াই ইজ শি নট হিয়ার? শি শুড হ্যাভ বিন হিয়ার টুডে!’ আমি ওদেরও কাজলের কথা বললাম। জানি না ও এখন কোথায়! কোন শহরের দড়ির ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলেছে! কে যেন বলেছিল, ওরা বেনারস চলে গেছে, কেউ এক জন বলেছিল, এসপ্ল্যানেডে খেলা দেখাতে দেখেছে কাজলকে। জানি না! সব অর্থেই কাজল ওর বাবা-মায়ের কাছে, মালিকের কাছে, রাজার কাছে এবং আমাদের কাছেও টোপ হয়ে রইল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement