রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

আমাদের দেশে যখন লংকা এল, প্রথমেই সে গেল দাক্ষিণাত্য বিজয়ে। কারণ, সেখানকার মানুষজন আগেই ঝাল খেতে অভ্যস্ত। তখন সেখানকার খাবারে গোলমরিচের শাসন চলছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৬ ০০:০০
Share:

আবার লংকা

Advertisement

আমাদের দেশে যখন লংকা এল, প্রথমেই সে গেল দাক্ষিণাত্য বিজয়ে। কারণ, সেখানকার মানুষজন আগেই ঝাল খেতে অভ্যস্ত। তখন সেখানকার খাবারে গোলমরিচের শাসন চলছে।

Advertisement

তাকেই হারিয়ে দিল লংকা। একই রকম ঝাঁজ, চেহারাতেও মিল আছে, কিন্তু ভীষণ সহজে মেলে। এমনকী বাড়ির উঠোনে রান্নাঘরের বাইরেও গাছ লাগানো যায়। রান্না করতে করতে গাছ থেকে পেড়ে এনে ব্যবহার করা যায়। এই রকম সবজি বা মশলা গিন্নিদের চিরকালই প্রিয়। তাই সব মিলিয়ে গোলমরিচকে দূরে সরিয়ে হেঁশেল দখল করতে লংকার বেশি সময় লাগল না।

লংকা হয়ে উঠল গরিবদের মসিহা। কারণ অল্প লংকা বাটা মাখলেই এক থালা ভাত এমনি এমনি সাবাড় করে দেওয়া যায়। কোনও সবজিই লাগে না। এমন ‘একা কুম্ভ’ ইমেজ তৈরি হয়ে যেতেই লংকা দীন-দুঃখীদের ভারতদেশে আরও জাঁকিয়ে বসল।

ষোলো শতকের শেষ দিকে উত্তর ভারতে বসে লেখা ‘আইন-ই-আকবরি’-তে চল্লিশটা পদের রান্নার বিবরণ দেওয়া আছে। কিন্তু তার কোনওটাতেই লংকার নামগন্ধ নেই। সব পদেই গোলমরিচের ব্যবহারের কথা লেখা। অন্য দিকে, দক্ষিণ ভারতের প্রবাদপ্রতিম চারণকবি পুরন্দরদাস (১৪৮৪-১৫৬৪) লংকার ভালবাসায় গান পর্যন্ত লিখেছেন। ‘তোমায় আমি প্রথম দেখি সবুজ— অভিজ্ঞতা তোমায় রাঙা করেছে হে সুন্দরী! তুমি সুস্বাদু কিন্তু পরিমিতি মাপা। হে গরিবদের মসিহা, তোমায় পেলে বিট্ঠল ভগবানকেও ভুলতে বসি।’

শিলনোড়ায় সামান্য সরষের তেল, নুন ও আদা দিয়ে লংকাবাটা আস্তে আস্তে এ দেশের সব রান্নার হৃদ্‌যন্ত্র হয়ে উঠছে। সময়ের সঙ্গে সে ঢুকে এসেছে ভারতের আয়ুর্বেদে, যেখানে চিরকালই বিদেশি অনুপান নৈব নৈব চ, সেখানে পর্যন্ত কলেরার ওষুধ হিসেবে মরিচের স্থান দখল করেছে লংকা।

লংকার এই ভারতবিজয়ের পুরো কৃতিত্ব দাবি করতে পারে পর্তুগিজরা। কারণ ওদের হাত ধরেই তো লংকা এ দেশে পৌঁছেছিল। তার প্রমাণ হল, মুম্বই বাজার। সেখানে লংকাকে ‘গোয়াই মিরচি’ বলা হত কয়েক দশক আগেও। পর্তুগিজরা শুধু এ দেশের লোককে লংকার স্বাদ চাখিয়ে ক্ষান্ত থাকেনি। পর্তুগিজ যাজকরা ১৫৪২-এ জাপানে আসেন। সঙ্গে আসে লংকা। তার পর কোরিয়া পর্যন্ত পৌঁছে যান তাঁরা। বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী পর্তুগিজরা আঁচ করেছিল যে, আগামী দিনে লংকা গোলমরিচকে কোণঠাসা করে দেবে। সারা বিশ্বের রান্নাঘর কুক্ষিগত করবে। অন্যরা জেগে ওঠার আগে যতটা সম্ভব ব্যবসা করে নিয়েছিল তারা। কারণ তারা জানত, লংকা ফলানো খুব সহজ, তাই এক বার জানাজানি হয়ে গেলে লংকার ব্যবসা আর শুধুই নিজেদের হাতে আটকে রাখা যাবে না।

এই বিভিন্ন দেশে পৌঁছনোর সময় লংকার গতিপথটা বড়ই ভারত-কেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। তাতেই ইউরোপের লোকে ভুলতে শুরু করে যে লংকার আদি দেশ মধ্য আমেরিকা। আর ওদের মনে বরং এই ধারণা মজবুত হয়— ভারতবর্ষই লংকার মাতৃভূমি। ও দিকে, ইউরোপের কিছু অংশে, যেমন হাঙ্গেরিতে, লংকা বা পাপরিকা গিয়েছিল তুর্কিদের মারফত। আবার তুরস্কে, লংকা পৌঁছেছিল ভারতবর্ষ থেকে আরব বণিকদের হাত ঘুরে সেই পারস্য দেশ হয়ে। পর্তুগিজদের এই ব্যবসাবুদ্ধি দারুণ সফল হয়। কারণ ভারতবর্ষ ছিল সত্যিই সোনার দেশ। সেখানে গোলমরিচ আর লংকা দুই-ই পাওয়া যেত। ইউরোপের যে সব দেশে লংকার প্রচলন তখনও হয়নি, তাদের গোলমরিচ জোগান দিত তারা। আর বাকি দেশগুলোতে পাঠাত লংকা।

আমাদের দেশের ভারী প্রিয় খাবার আচার। এই শব্দটাও কিন্তু এদেশীয় নয়। লংকাকে মধ্য আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ‘আচা’ বা ‘আছা’ বলা হয়, আর সেখান থেকে এই ‘আচার’।

১৯১২ সালে আমেরিকার ফার্মাসিস্ট উইলবার স্কোভিল লংকার ঝাল মাপার এক স্কেল তৈরি করেন। তার পর হাড্ডাহাড্ডি ঝালবাজির প্রতিযোগিতা শুরু হয় ভারত আর লাতিন আমেরিকার। ২০০৭ সালে নাগাল্যান্ডের ‘ভূত জোলোকিয়া’-কে বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল লংকার মুকুট পরায় গিনেস বুক। এ লংকা মেক্সিকোর টাবাস্কো’র চেয়েও চারশো গুণ বেশি ঝাল। কিন্তু ২০১১-য় হঠাৎ এই শিরোপা কেড়ে নেয় ইংল্যান্ডের ‘ইনফিনিটি চিলি’। কিন্তু বেশি দিন নয়— ২০১৪ সাল থেকেই নাগা জোলোকিয়ার মাথায় ফিরে আসে সেরা ঝালবাজের তাজ। এর স্কোভিল ইউনিট ১৩,৮২,১১৮! তাই, ভারত বিশ্বের বৃহত্তম লংকা উৎপাদনকারী দেশ তো বটেই, ঝালবাজিতেও সকল দেশের সেরা!

কিন্তু কলম্বাসের ইতালির আর ইতালির ভেনিসের কী হল? প্রতিদ্বন্দ্বী অটোমানরা গোলমরিচের প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য, তাদের শ্যাম তো আগেই গিয়েছিল। এ বার লংকা গাছের গোপন রহস্য ফাঁস হয়ে যেতে, তাদের কুলও গেল। ব্যস! আস্তে আস্তে পর্তুগালের প্রধান বাণিজ্য নগরী হয়ে উঠল লিসবন, আর ভেনিসের সওদাগর বেঁচে রইল শুধু শেক্‌সপিয়রের নাটকে!

ডান হাত ভেঙেছে, অথচ বাঁ হাতে প্লাস্টার!

ছবি: সুমিত্র বসাক

মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করার পর দুটো বছর কেটে গেছে। হাউস সার্জেনের মাইনেতে নুন আনতে পান্তা ফুরোবার হাল। মাঝেমধ্যে হাসপাতালের ‘স্যর’দের কাছ থেকে পাওয়া রাতের ডিউটি— সারা রাত রুগি দেখা, পাহারা দেওয়া। বিনিময়ে সামান্য কিছু টাকা। এখনকার মতো এত প্রাইভেট নার্সিং হোম তখন ছিল না।

মধ্যবিত্তের সংসার। বাবা রিটায়ার্ড, এক বোনের বিয়ে বাকি। এমন সময় হাতে চাঁদ পেলাম। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে গ্রামের একটা হাসপাতালে চাকরি। মাইনে কম, তাতে কী, কিছু টাকা বাঁচানো যাবে। কারণ বিনা পয়সায় কোয়ার্টার্স আর ইলেকট্রিসিটি। বড়পিসির কাছে রান্নার তালিম নিয়ে, এক সপ্তাহের মধ্যে পাড়ি দিলাম ধুবুলিয়া টিবি হাসপাতালের উদ্দেশে। সঙ্গে বড় একটা টিনের সুটকেস— আমার সংসার। আর পিসিমার তৈরি নারকোল নাড়ু। পিসিমার বড় ভয়। বিদেশ-বিভুঁই বলে কথা, অন্তত ক’দিনের জলখাবার তো হয়ে যাবে।

স্টেশন থেকে নেমে একটা সাইকেল রিকশা চেপে রওনা হলাম হাসপাতালের দিকে। খানিকটা পিচের রাস্তা পার হয়ে মোরামের পথ। সময়টা দুর্গাপুজোর ঠিক আগে। চারিদিকে সবুজ ধানখেত, মাঝে মাঝে সাদা কাশফুল। শহরের ছেলে, সব কিছুই ভাল লাগছে। হাসপাতালের সুপারের সঙ্গে দেখা করার পর উনিই রিকশাওলাকে বলে দিলেন, ডান দিকের কলাগাছের জঙ্গলটার পাশ দিয়ে একটু এগিয়ে ওই দূরের বাড়িটায় যেতে হবে। ছিরিছাঁদহীন বেরং একটা বাড়ি। বহু দিন কেউ না থাকলে যেমন হয়। ঘরের মধ্যে একটা চৌকি, আর ভাঙা, দরজা-খোলা একটা কাঠের আলমারি।

একটু জিরিয়ে নেব ভাবছি, হঠাৎ মনে পড়ল, এখনও তো জয়েন করা হয়নি! পড়িমরি ছুটলাম সুপারের ঘরে। সুপার অতি অমায়িক। বললেন, আজ হাজিরা খাতায় সই করে বাড়ি চলে যাও। কাল থেকে সকাল আটটার মধ্যে আউটডোরে আসবে। বাকি কাজ সিনিয়র ডাক্তাররা বুঝিয়ে দেবে।

ওই রাতেই ডাক পেলাম ডাক্তার রায়ের। এটা-ওটা কথার পর বললেন, ক’টা দিন আর রান্নাবান্না কোরো না, দু’বেলা আমার কোয়ার্টার্সে খেয়ে নেবে। আমি তো কিছুতেই বুঝতে পারি না, গোড়া থেকে সকলেই কেন এমন ভাল ব্যবহার করছেন আমার সঙ্গে। ক’দিন পর বুঝলাম। এই হাসপাতালে বছর দশেক কোনও নতুন ডাক্তার জয়েন করেনি। আমি টিকে গেলে, সিনিয়র ডাক্তার রায় বদলি হতে পারবেন। তাই আমার এত খাতির।

সকাল আটটা থেকে দুপুর তিনটে ডিউটি। তার পর কোনও কাজ নেই। সকলের পরামর্শে, রাতের দিকে হাসপাতালের একটু দূরে একটা চেম্বারে বসার ব্যবস্থা হল। দু’-এক জন করে রুগি আসতেও শুরু করল। এমনই এক দিন, বেশি রাতের দিকে, কয়েক জন লোক ছুটতে ছুটতে ডাক্তারখানায় এসে হাজির। সঙ্গে সাইকেল ভ্যানে এক জন মহিলা। বছর তিরিশের, অচৈতন্য। নাড়ির গতি দ্রুত। রক্তচাপও কমের দিকে। রুগি কিছু একটা খেয়ে নিয়েছে। অবস্থা ভাল নয় বুঝে ওদের জানালাম, এখুনি স্যালাইন দিতে হবে আর স্টমাক ওয়াশ করতে হবে। কিন্তু আমার এখানে তো ব্যবস্থা নেই। কোনও হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে হবে। ওঁরা বললেন, এখানে কাছাকাছি সে রকম কোনও ব্যবস্থা নেই। একমাত্র ভরসা, দু-তিন মাইল দূরে বড় ডাক্তারবাবুর বাড়ি। ওঁর কাছেই নিয়ে যাব বলে রওনা হলাম। আমি একটা সাইকেলের সামনের সিটে, রুগি সাইকেল ভ্যানে। পৌঁছতে বেশ খানিক ক্ষণ সময় লেগে গেল। তখন প্রতিটা মুহূর্তই খুব জরুরি। পৌঁছে দেখি, বড় ডাক্তারবাবুর ঘরের বাইরে রুগির ভিড়। বড় দু-তিনটে হ্যাজাক জ্বলছে। অত ভিড়ে ডাক্তারবাবুকে কে বোঝাবে এই রুগির অবস্থা!

গলায় স্টেথোস্কোপটা ঝুলিয়ে, ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম ডাক্তারবাবুর কাছে। প্রথমে আমাকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। আমি কিন্তু চিনতে ভুল করিনি, এ তো আমাদের কলেজের সিনিয়র, মোহনদা! বলে উঠলাম, মোহনদা, আমাকে চিনতে পারছেন না, আমি তো খালু! ‘খালু’ শুনেই উনি জড়িয়ে ধরলেন। আসলে আমাদের কলেজটা বেলগাছিয়ার খালের ধারে বলে অন্য মেডিকেল কলেজের ছেলেরা আমাদের ‘খালু’ বলে ডাকত।

শুরু হল চিকিৎসা। স্যালাইন দেওয়া থেকে যত রকম ইমার্জেন্সি, সব উনি করলেন। শুধু বললেন, রাতটা তোকে এখানে থাকতে হবে। তুই অবজার্ভ করবি। আমি বাকি রুগি সামলাই।

রুগির পাশে বসে ডিউটি দিচ্ছি। বেশ ক’ঘণ্টা পর রুগি চোখ চেয়ে চাইল, বুঝলাম জ্ঞান ফিরছে। তখনও ভোর হয়নি, কিন্তু পাখিরা ডাকাডাকি করছে। বসে থাকতে থাকতে আমার হঠাৎ কলেজে পুরনো একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল।

ইমার্জেন্সিতে নাইট ডিউটি চলছে। সিনিয়র ডাক্তার এই মোহনদা। মাঝরাতে পুলিশ একটা লোককে নিয়ে এল। মাথা থেকে রক্ত ঝরছে, দুটো হাত থেকেও। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কপালের ক্ষত সেলাই করে পাঠালাম মোহনদার কাছে। ডান হাতের কবজি মনে হয় ভেঙে গেছে। ঠিক করে প্লাস্টার করতে হবে। ওটা সিনিয়র ডাক্তারের কাজ। খানিক ক্ষণ পর দেখলাম, ওর ডান হাতটায় না, বাঁ হাতে একটা প্রকাণ্ড প্লাস্টার। ডান হাত ভেঙেছে, অথচ বাঁ হাতে প্লাস্টার! এই নিয়ে কলেজে হাসিঠাট্টাও হয়েছিল অনেক দিন ধরে।

এই সব ভাবছি, এমন সময় দু’কাপ গরম চা নিয়ে মোহনদা এসে হাজির। চা খেতে খেতে মনে পড়ে যাওয়া গল্পটা বলেই ফেললাম। ‘আরে, ওই লোকটা ওই অঞ্চলের নামকরা পকেটমার। এর আগেও বেশ ক’বার এসেছে। তবে ওর ডান হাতের চেয়ে বাঁ হাতটা বেটার খেলত। আমি তাই বাঁ হাতটা প্লাস্টার করে দিয়েছিলাম। শ্যামবাজার-বেলগাছিয়া অঞ্চলের লোকেরা কিছু দিন অন্তত নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে!’ মোহনদার সহাস্য উত্তর।

শিবাজী চট্টোপাধ্যায়
হিদারাম ব্যানার্জি লেন, বউবাজার

hrishisivaji@gmail.com

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement