তাঁ র জন্ম ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১৫। তার মানে, এই বছর জন্মশতবর্ষ চলছে। যদিও আমাদের খুব একটা হেলদোল নেই। তাঁর নাম ‘কবি প্রদীপ’। আসল নাম রামচন্দ্র নারায়ণজি দ্বিবেদী। যদিও এর কোনওটা বললেই সাধারণ বাঙালি তাঁকে চিনতে পারবেন না। কিন্তু ওঁর লেখা একটি গানের কথা বললেই সবাই হইহই করে উঠবেন। ১৫ অগস্ট হোক বা ২৬ জানুয়ারি— আমরা সেই গান দিনরাত শুনি। গানটি হল, ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ, জরা আঁখো মে ভর লো পানি’। ষাটের দশকে চিনের ভারত আক্রমণের পরে, ভারত যখন চিনের কাছে হেরে গেল, গোটা দেশ সেই শোকে মুহ্যমান ও হাজার হাজার মৃত সৈনিকের জন্য কাতর। তখন ভারতের মনোবল ফেরাতে কবি প্রদীপের লেখা এবং লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া এই গান ভারতবাসীকে না়িড়য়ে দিয়েছিল।
প্রদীপ ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফিল্ম-গীতিকারদের এক জন। শুধু তাঁর লেখা গান শোনার জন্য বহু লোক বহু সিনেমা বার বার দেখতেন। গাঁধীজি ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের ডাক দেওয়ার ছ’মাসের মধ্যে, ১৯৪৩-এ, রিলিজ করল হিন্দি ছবি ‘কিসমত’, যা লিখলেন ও পরিচালনা করলেন জ্ঞান মুখোপাধ্যায়। ভারতের প্রথম গোল্ডেন জুবিলি হিট এই ছবিটির জন্য প্রদীপ গান লিখলেন— ‘আজ হিমালয় কি চোটি সে ফির হমনে ললকারা হ্যায়/ দূর হটো অ্যায় দুনিয়াওয়ালোঁ, হিন্দুস্থান হমারা হ্যায়।’ ছবিটি সব রেকর্ড ভেঙে হিট হয়েছিল, কলকাতায় রক্সি সিনেমা হল-এ চলেছিল টানা ১৮৭ সপ্তাহ, আর এই গানটি এমন সুপারহিট হয়েছিল, সিনেমার রিল রি-ওয়াইন্ড করে বার বার চালাতে হত, দর্শকের দাবিতে। এই জিনিস তার আগে সারা পৃথিবীতে আর ঘটেছে কি না সন্দেহ। এই গানটার অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তার চোটে, সম্ভাব্য গ্রেফতারি এড়াতে কিছু দিনের মধ্যে কবি প্রদীপকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হয়।
স্বাধীনতার পরেও প্রদীপ গান লিখতে থাকলেন, দেশ গড়ে তোলার আহ্বান মিশিয়ে। ১৯৫৪ সালে ‘জাগৃতি’ ফিল্মের জন্য লিখলেন ও নিজে গাইলেন— ‘আও বচ্চোঁ তুমহে দিখায়ে ঝাঁকি হিন্দুস্তান কি/ ইস মিট্টি সে তিলক করো ইয়ে ধরতি হ্যায় বলিদান কি’। এই সিনেমা মুক্তির কিছু দিন পরে পাকিস্তানে এরই আদলে লেখা হয় একটি গান— ‘আও বচ্চোঁ সয়ের করায়ে তুমকো পাকিস্তান কি’। ‘জাগৃতি’-র আর একটি জনপ্রিয় গানে ছিল— ‘হম লায়ে হ্যায় তুফান সে কশ্তি নিকালকে, ইস দেশকো রখনা মেরে বচ্চোঁ সমহালকে’। মহাত্মা গাঁধীকে অভিবাদন জানিয়ে একটি গানে কবি লিখেছিলেন— ‘দে দি হমে আজাদি বিনা খড়্গ বিনা ঢাল/ সবরমতী কে সন্ত তুনে কর দিয়া কামাল’।
দেশভাগ আর তার সঙ্গে সামাজিক অধঃপতনের শুরু দেখে ‘নাস্তিক’ সিনেমায় লিখলেন— ‘দেখ তেরে সংসার কি হালত কেয়া হো গয়ি ভগবান/ কিতনা বদল গয়া ইনসান/ সুরজ না বদলা চাঁদ না বদলা না বদলা রে আসমান/ কিতনা বদল গয়া ইনসান’। গানটি উনি নিজে গেয়েছিলেন। এই গানেই এক জায়গায় বলা হয়— ‘ফুট ফুট কর কিঁউ রোতে পেয়ারে বাপু কে প্রাণ, কিতনা বদল গয়া ইনসান’— ভারতে এই লাইন নিয়ে কম রাজনীতি হয়নি!
গীতিকার হিসেবে প্রথম সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার পান কবি প্রদীপ, ১৯৬১-তে। ১৯৬৩ সালে পান বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাওয়ার্ড। তাঁর দেশাত্মবোধক গান তখন ঘরে ঘরে। পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশক মাতিয়ে রেখেছিল এ সব গান। তাঁর খ্যাতি ভারত ছাড়িয়ে আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল।
কবির লেখা বেশ কয়েকটি ভজনও খুব বিখ্যাত। ‘জয় সন্তোষী মা’ (১৯৭৫) ছবিতে ‘ইঁয়াহা ওঁয়াহা জাঁহা তাঁহা মত পুছো কহাঁ কহাঁ...’ আর অন্য অনেক গান দুর্দান্ত হিট করেছিল। ‘ম্যায় তো আরতি উতারুঁ রে...’ গানটির সময় সিনেমা হল-এ বহু দর্শক-মহিলা আরতি আরম্ভ করতেন! ভক্তিগীতি, ঊষা মঙ্গেশকরের গলায় ‘হে জগৎ কে মালিক’ গানগুলিও ঢেউ তুলেছিল। ১৯৪৮ সাল থেকেই মঙ্গেশকর পরিবারের সঙ্গে কবি প্রদীপের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ২৭ জানুয়ারি ১৯৬৩-তে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর উপস্থিতিতে লতা দিল্লিতে গাইলেন— ‘অ্যায় মেরে বতন কে লোগোঁ’। শুনতে শুনতে নেহরুর চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। তিনি গীতিকারের খোঁজ করলেন। এর পর ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রদীপকে ‘রাষ্ট্রীয় কবি’ উপাধি দেওয়া হয়।
প্রদীপ এই গানের স্বত্ব থেকে যা আয় করেছিলেন, সমস্তটাই যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের বিধবাদের জন্য দিয়ে দিতে চাইলেন। গানের রাজস্বও যুদ্ধ-বিধবাকোষে জমা করার জন্য আপিল করা হল। মুম্বইয়ের উচ্চ আদালত ২৫ অগস্ট ২০০৫-এ এইচ এম ভি কোম্পানিকে গানটির রয়্যালটি বাবদ প্রাপ্য একটি বড় অঙ্কের টাকা এই বিধবাকোষে জমা রাখতে আদেশ দেয়।
প্রদীপ গীতিকার হয়ে গিয়েছিলেন অবশ্য পাকেচক্রে। তাঁর বাবা-মা’র ইচ্ছে ছিল, তিনি শিক্ষক হবেন। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক স্তরের পড়া শেষ করেন, তার পর একটা শিক্ষক-শিক্ষণ কোর্স করেন। এর মধ্যেই প্রচুর হিন্দি কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং বিভিন্ন কবি সম্মেলনে তাঁর কবিতা আর কবিতা পড়ার স্টাইল বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৩৯ সালে, মুম্বইয়ের এক কবি সম্মেলনে তাঁর কবিতা শুনে, বম্বে টকিজ-এর হিমাংশু রাই তাঁকে ‘কঙ্গন’ সিনেমায় গান লিখতে বলেন। ছবিতে প্রদীপ চারটি গান লেখেন। চারটিই খুব জনপ্রিয় হয়, তার মধ্যে তিনটি আবার উনি নিজে গেয়েওছিলেন। তার পর বম্বে টকিজ-এর দুশো টাকার মাইনেতে কাজে যোগ দেন। অনেকে বলেন, উনি আগে থেকেই প্রদীপ ছদ্মনামে লিখতেন, কেউ বলেন, হিমাংশু রাই তাঁর রামচন্দ্র নামটা পালটে রাখেন ‘প্রদীপ’। এই পালটানো নাম নিয়ে নাকি মুম্বইয়ের পোস্ট অফিসে খুব গোলমাল বাধে। কবির সব চিঠি চলে যেত সে কালের প্রখ্যাত ফিল্ম-অভিনেতা প্রদীপ কুমারের বাড়িতে। তখনই উনি নিজের নাম রাখেন ‘কবি প্রদীপ’। পরের ছবিই ‘বন্ধন’। তার প্রত্যেকটা গান লিখলেন তিনি, প্রতিটিই সুপারহিট। ‘চল চল রে নওজওয়ান’ তো ভারতের মনে নতুন উদ্দীপনার জন্ম দিল। তার পর অনজান, কিসমত, ঝুলা, নয়া সংসার, পুনর্মিলন— তাঁর লেখা ও গাওয়া গানের বান ডাকল হিন্দি সিনেমায়।
তবে বম্বে টকিজ ভেঙে যেতে কবি প্রদীপের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা খারাপ হয়। চুক্তি অনুসারে ‘প্রদীপ’ নামে সর্বত্র গান লিখতে না পারায়, ‘মিস কমলা’ নামে কিছু গান লিখেছিলেন।
পাঁচ দশক ধরে, প্রদীপ সত্তরের ওপর ছবিতে গান লেখেন। তাঁর মোট গানের সংখ্যা প্রায় ১৭০০! ১৯৯৭ সালে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে, তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার দেওয়া হয়।
তবে নব্বইয়ের দশকের হিন্দি গান ছিল তাঁর ঘোর অপছন্দের। সেই বিতৃষ্ণায় তিনি গান লেখাই ছেড়ে দেন। ১৯৯৮ সালের ১১ ডিসেম্বর, ৮৩ বছর বয়সে মারা যান।
skc.nsou@gmail.com