এটা বোধহয় মা নয়, অন্য কেউ!

লুকাস! লুকাস!’ খেলতে খেলতে হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যে হারিয়ে যায় ছেলেটা! ডেকে ডেকে এলিয়াসের গলা ধরে যায়। তার পর আবার দুম করে কোত্থেকে এসে হাজির হয়। ভারী দুষ্টু! আসলে ওরা যমজ ভাই। বছর দশেক বয়স।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

লুকাস! লুকাস!’ খেলতে খেলতে হঠাৎ হঠাৎ কোথায় যে হারিয়ে যায় ছেলেটা! ডেকে ডেকে এলিয়াসের গলা ধরে যায়। তার পর আবার দুম করে কোত্থেকে এসে হাজির হয়। ভারী দুষ্টু! আসলে ওরা যমজ ভাই। বছর দশেক বয়স। সারা দিন ওদের কত কী খেলা! সবুজ শস্য-খেতের ভেতর গা ডুবিয়ে লুকোচুরি আছে, পাথুরে টানেলের মিশকালো অন্ধকারে শরীর মিলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আছে, টলটল লেকের জলে সরু কাঠের ভেলায় উপুড় হয়ে ভেসে বেড়ানো আছে। ওরা দুজনে পোকা ধরে ধরে কাচের বয়ামে রাখে। বহু পুরনো কবরখানার ভেতরে ঢুকে, মাথার খুলি, হাড়গোড়ের জঞ্জাল থেকে বহু দিন খেতে না-পাওয়া একটা রোগা-নোংরা বেড়ালকে বাড়ি বয়ে নিয়ে আসে।

Advertisement

কিন্তু ওদের মা আজকাল এই সব দস্যিপনা একদম সহ্য করতে পারছে না। হাসপাতাল থেকে কসমেটিক সার্জারি করিয়ে বাড়ি ফেরার পর থেকেই মা-টা যেন কেমন পালটে গেছে। এমনিতে তো শুধু চোখ আর ঠোঁটদুটোর কাছটা বাদ দিয়ে তার গোটা মুখে-মাথায় ব্যান্ডেজ জড়ানো, কেমন যেন হরর ছবির ‘মমি’ ভূতের মতো দেখাচ্ছে। তার ওপরে নিত্যনতুন ফতোয়া। এই ঘোর গ্রীষ্মেও জানলার খড়খড়ি পুরো বন্ধ রাখতে হবে। ঘরের মধ্যে হুটোপাটি, চেঁচামেচি একদম চলবে না। খেলাটেলা যা করার বাইরে গিয়ে করতে হবে।

ওদের দু’ভাইয়ের মনে হচ্ছিল, এই মা-টা কিছুতেই তাদের আগের মা হতেই পারে না। আগের মা তাদের একটুও বকত না। আর এই মহিলা সে দিন এলিয়াসকে ঘরের দরজা বন্ধ করে পিটিয়েছে! তা ছাড়া এই মা যেন লুকাসকে দেখতেই পায় না! চিনতেই চায় না। ওর সঙ্গে কথা বলে না, ওকে ব্রেকফাস্ট দেয় না। এলিয়াসের খুব খারাপ লাগে। আর আরও আরও বেশি করে মনে হয়, বাইরের কেউ ওদের মা সেজে এই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। মায়ের বিছানায় শুচ্ছে, মায়ের জামাকাপড় পরে ঘুরছে। এই খারাপ মহিলা নিশ্চয়ই তাদের আসল মা’কে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে। আসলে, ‘ক্যাপগ্রাস সিনড্রোম’ একটা মনের অসুখ। অসুস্থ যে, তার আচমকা মনে হতে থাকে, তার কাছের মানুষটি আর তার কাছে নেই। অন্য কেউ সেই মানুষটা সেজে তাকে ঠকাচ্ছে। এখানে এলিয়াসও ওই সিনড্রোমেই ভুগছে। পরিচালকরা এরই সঙ্গে লুকাস নিয়েও একটা ধাঁধা, রহস্য তৈরি করেছেন। একেবারে ক্লাইম্যাক্সে এসে যার উত্তর মিলছে।

Advertisement

মাঝের সময়টা এলিয়াসরা দু’ভাই মিলে মা’কে ঘুমন্ত অবস্থায় বন্দি করে ফেলে। তাকে খাটের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে মুখে স্টিকিং প্লাস্টার সেঁটে দেয়। ওরা বার বার জানতে চাইছিল তাদের সত্যিকারের মা কোথায়? মহিলা যত বার বলছেন, তিনিই ওদের মা, ওরা ততই খেপে উঠছিল। মায়ের গালে নিষ্ঠুর থাপ্পড় মারছিল। ম্যাগনিফায়িং গ্লাসে রোদ্দুর ফেলে গালের নরম চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছিল। ভয়ে-ব্যথায় মহিলা বিছানা ভিজিয়ে ফেলেন।

পুরনো মিউজিক ভিডিয়োর মিষ্টি স্মৃতিমাখা ঘুমপাড়ানি গান দিয়ে যে ছবিটা শুরু হয়, তার শরীর থেকে একটু একটু করে সব সারল্য, ছেলেমানুষি মুছে যেতে থাকে। ডিজিটালের বদলে ৩৫ মি.মি ক্যামেরা, বাইরের খোলা আকাশ, দিগন্ত-ছোঁয়া ফসলের খেত, অঝোর-অনাবিল বৃষ্টি ছেড়ে যখনই বাড়ির মধ্যে ঢুকছে, তখনই কম-নিচু আলো, সন্দেহ আর শঙ্কার একটা চাপা গুমোট। ছবির শেষে সেই গুমোটটাই যেন দাউদাউ বিস্ফোরণে ফেটে যায়, যখন এলিয়াস তার মা‌’কে-সুদ্ধই গোটা বাড়িটায় আগুন লাগিয়ে দেয়! তার পরেও অবশ্য হাওয়ায় দোলা ফসলের খেত, নরম ঘুমপাড়ানি গান, মায়ের সঙ্গে দু’ভাইয়ের সোহাগের আদুরে ফ্রেম ফিরে আসে। কিন্তু একেবারে শেষ দৃশ্যে পরদা-জোড়া অন্ধকারে আগুনের ছোট ছোট ফুলকিগুলো উড়তে থাকে! কাঠফাটার আওয়াজও যেন শোনা যায়। মমতার পোড়া ছাইটুকু শুধু দেখি না।

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement