আড্ডায় আর নেই পৌরুষী পাট্টা

বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডার সাহস ছিল না। তাদের মায়েরা প্রায় কম্যান্ডো। অতএব, সন্ধ্যাবেলায় মাঠে মাটির খুরিতে হুইস্কি বা রাম। এখন সেই লিঙ্গবৈষম্য নেই, রাত জেগে ঠাকুর দেখা, সেলফি তোলায় বন্ধুত্ব অনেক স্বতঃস্ফূর্ত। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীবান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডার সাহস ছিল না। তাদের মায়েরা প্রায় কম্যান্ডো। অতএব, সন্ধ্যাবেলায় মাঠে মাটির খুরিতে হুইস্কি বা রাম। এখন সেই লিঙ্গবৈষম্য নেই, রাত জেগে ঠাকুর দেখা, সেলফি তোলায় বন্ধুত্ব অনেক স্বতঃস্ফূর্ত। স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৮ ২২:৫৩
Share:

—ফাইল চিত্র।

আবার পুজো আসছে। আর তার সঙ্গে প্রস্তুত হচ্ছে কলকাতা। বাঁশের কেল্লা সেজে উঠছে আস্তে আস্তে। শপিং-এর বিলবোর্ড স্টিকারের মতো লেগে যাচ্ছে শহরের আনাচে-কানাচে। পুজোর কেনাকাটার বাজেট, ঘুরতে যাওয়ার আইটিনেরারি, সপ্তমী থেকে দশমীর জামাকাপড়ের মহড়ার পাশাপাশি পুজো আসছে বলে কলকাতা ও তার মানুষজন ভেতরে ভেতরে প্রস্তুত হচ্ছে আরও একটা জিনিসের জন্য। তা হল আড্ডা! পুজোর আড্ডা! আসলে বাঙালির মতো আড্ডাবাজ জাত পৃথিবীতে ক’টা আছে বলা মুশকিল। তাই আমাদের আড্ডা একটা গবেষণার বস্তু। আর তার মধ্যে পুজোর আড্ডা অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে।

Advertisement

পুজো নিয়ে আমার নিজের কোনও দিনই মাতামাতি নেই! সেই ছোটবেলা থেকেই কী জানি কেন পুজো এলেই আমার মনে হত, এই রে, অ্যানুয়াল পরীক্ষা এসে গেল! সেই ভয়টাই কোনও দিন পুজোটা উপভোগ করতে দিল না আমায়! তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষার ভয় কাটলেও পুজোর ওই ভিড় আর হইচইয়ের প্রতি অনীহাটা রয়েই গিয়েছে। তবু যে একটা মাত্র কারণে পুজোর দিনগুলো ভাল লাগে, তা হল ওই আড্ডা!

আমার বড় হয়ে ওঠার মফস্‌সল শহরটা ছিল একদম গঙ্গার কোল ঘেঁষে! আমি এবং আমার বন্ধুরা প্রাণপণ বিশ্বাস করতাম যে ‘ডন’ সিনেমার সেই ‘ছোরা গঙ্গা কিনারেওয়ালা’ গানটা আসলে আমাদের জন্যই লেখা। আর সেই গঙ্গার পাড়টাই ছিল আমাদের পুজোর সকালের আড্ডার আসল জায়গা। কাঠের জেটিতে পা ঝুলিয়ে জাহাজ দেখতে দেখতে সেই আড্ডার সময়গুলোর জন্য আমরা সারা বছর অপেক্ষা করতাম। যদিও সারা বছরই দেখা হত বন্ধুদের সঙ্গে। কিন্তু পুজোর ওই চারটে দিনের মধ্যে কী ছিল কে জানে। মাথার ওপর নীল আকাশে ক্যান্ডিফ্লসের মতো মেঘ, নদীর পাড়ে নুইয়ে পড়া কাশফুল আর দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ! আমার মনে হত, শরৎ আসলে আড্ডা মারার সবচেয়ে ভাল সময়!

Advertisement

নব্বই-এর গোড়ার দিকে সেটা ছিল আমাদের বয়েজ় স্কুল-লাঞ্ছিত টেন-ইলেভেনের জীবন। টিউশনের দেড় ঘণ্টা বাদ দিয়ে বাকি জীবনটা ছিল একদম নারীচরিত্রবর্জিত! পুজোর ওই দিনগুলোয় আমাদের খুবই ইচ্ছে থাকত, সকালের সেই আড্ডায় মেয়েরাও আসুক। কিন্তু মেয়েরা সেই সময় আমাদের ঠিক খোলাখুলি পাত্তা দিত না! মানে টিউশনিতে একটু-আধটু ঝাড়ি আমাদের র‌্যাশন ছিল। সে সবের বাইরে আমাদের সঙ্গে গঙ্গার ধারে বসে আড্ডা দেওয়ার কথা তারা দুঃস্বপ্নেও ভাবত না! তাদের বাবা-মায়েরাও তখন ততটা লিবারাল ছিলেন না। প্রচুর মেয়ের মায়েদের আমি জানতাম, যাদের মতো তীব্র ব্ল্যাক ক্যাট কম্যান্ডো পৃথিবীর কোনও দেশে নেই! তা ছাড়া মেয়েদের নিজস্ব গার্ল গ্যাং-ও ছিল।

আমাদের মেয়েদের কাছাকাছি আড্ডার সুযোগ আসত সন্ধেবেলায়। মফস্‌সলের বিশাল প্যান্ডেলের মাঝে ছিল যাত্রার স্টেজ। তার কাছে চেয়ার নিয়ে বসে থাকত তারা। আমরাও খুব ক্যাজ়ুয়ালি, যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে ঘুরতাম আশেপাশে। টুকটাক কথা হত। যে বেশি সাহসী, সে চুরমুর বা ভেলপুরি কিনে এনে মেয়েদের অফার করত। কিন্তু এটুকুই। এর বেশি পাওয়া যেত না কিছু। আর আমাদের চাহিদাও এর চেয়ে বেশি সাহসী ছিল না। অন্য কিছু ‘অফার’ করার জন্য যে দম লাগে তা আমাদের উনিশ ইঞ্চি বুকে তখনও গজায়নি!

তবে শুধু যে বান্ধবী-সান্নিধ্যের আশা তা নয়, আমাদের আড্ডার আর একটা দিক ছিল। নেশা! আমার মতো দু’-এক জন ভিতু মানুষ চিরকাল যাবতীয় নেশার থেকে দূরে থাকলেও বাকিরা বেশ উৎসাহী ছিল এ ব্যাপারে। সিগারেট অনেকেই খেত লুকিয়েচুরিয়ে। কিন্তু পুজোর সন্ধেবেলা বড় ফাঁকা মাঠ আর তার আনাচে-কানাচে বসে অনেকেই হুইস্কি কিংবা রাম ঢালত মাটির গ্লাসে! কেউ একটুতেই আউট হয়ে কান্নাকাটি করত, অমুক মেয়েটি তাকে পাত্তা দেয়নি ভেবে। আবার কেউ কিছুই হয়নি ভাব করে আবার চাঁদা তুলত আর একটা বোতল আনবে বলে। কেউ এর মধ্যে দলে পড়ে মদ খেয়ে ফেলে আবার ভয় পেত, বাড়িতে বাবা-মা তাদের মুখে মদের গন্ধ পাবে না তো! এই ভয় দেখিয়ে এক বার আমাদের এক বন্ধুকে ঘাস পর্যন্ত খাইয়েছিল বাকিরা। এই বলে যে, এতে নাকি মদের গন্ধ ঢেকে যায়! আর আড্ডার টপিক? সে তো গোটা পৃথিবীটাই! সুস্মিতা সেনের মিস ইউনিভার্স হওয়া থেকে রোমারিওর ডজ! পাড়ায় আসা নতুন কাকিমা থেকে ক্লিওপাত্রা কাকে বেশি ভালবাসত সেই নিয়ে তর্ক! সব ছিল আড্ডার উপজীব্য।

তবে এই দুষ্টু আড্ডায় যে কোনও বান্ধবী আসবে সেটা আমরা স্বপ্নেও ভাবতাম না। আসলে তখন আমরা এমন একটা সময় আর সমাজে বড় হচ্ছিলাম, যেটা অতটাও পারমিসিভ ছিল না। পরে শুনতাম, মেয়েরাও নিজেদের আড্ডায় লুকিয়ে সিগারেটে টান দিয়েছে। কিংবা বাড়িতে বাবা না থাকার সুযোগ নিয়ে বাবার বোতল থেকে একটু হুইস্কি চুরি করে খেয়েছে। কিন্তু ওইটুকুই। সে সময় পুজো ছিল এমন পোলারাইজ়ড আড্ডা আর ছোট ছোট তথাকথিত নিষিদ্ধতা উপভোগ করার একটা সময়।

শহুরে পুজোর সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকটা পরে। আমি যে পাড়ায় থাকি, সেখানে একদম আমাদের বাড়ি ঘেঁষেই খুব বড় করে দুর্গাপুজো হয়। প্যান্ডেলের সামনে সকাল থেকে রাত অবধি আড্ডাও চলে। আমার দেখা সেই নব্বইয়ের মফস্‌সলের আড্ডার থেকে কিন্তু এই সময়ের শহুরে আড্ডা অনেক আলাদা। তখনকার সেই ছোট্ট টাউনের চেয়ে এখনকার এই শহর আর তার চারপাশ অনেক বেশি পারমিসিভ। এখনকার আড্ডায় সেই বাইনারি ব্যাপারটা নেই। সেই ‘পেটে খিদে মুখে লাজ’ ব্যাপারটা নেই। এখন ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি স্বতঃস্ফূর্ত! তাদের কী চাহিদা ও কিসে তৃপ্তি সেটা তারা বোঝে ও আদায় করতে জানে। বন্ধুত্বের মধ্যে জেন্ডার ঢুকিয়ে জোর করে একটা অন্য কৌণিক দৃষ্টি আনাটা এখন আর নেই।

নব্বইয়ের সেই সব সময়ে আমার সে ভাবে মনে পড়ে না কোনও মেয়েকে রাস্তায় আমরা সিগারেট খেতে দেখেছি বলে। যদি এক জনকেও দেখা যেত তা হলে লোকজন এমন করে তাকাত যেন মানুষের মাঝে ভিনগ্রহের কোনও জীব এসে উপস্থিত হয়েছে! এখানেও একটা পুরুষতান্ত্রিকতার অদৃশ্য হাত ছিল। এই সময়ে সে সব আর নেই। রাস্তাঘাটে তো বটেই, পুজোর আড্ডাতেও পোলারাইজ়েশন আর নেই। দক্ষিণের ম্যাডক্স স্কোয়্যার থেকে উত্তরের মহম্মদ আলি পার্ক, সব পুজোতেই এখন খোলা হাওয়া! আগে কথার ছলে মেয়েদের হাতে হাত লেগে গেলেও কয়েকটা ভুরু আপনা থেকে কুঁচকে যেত। আর এখন গলা জড়িয়ে ধরলেও কেউ কিছু মনে করে না। ইম্প্রপার টাচ থেকে ফ্রেন্ডলি হাড্‌ল-এ পালটে গেছে সমাজটা। পুজোর আড্ডাতেও এই খোলা হাওয়া এখন। এ ওর গলা জড়িয়ে ঘোরা। এক খাবার থেকে ভাগ করে খাওয়া। একই বিয়ার ক্যানে (কাগজ জড়ানো) চুমুক দেওয়া এখন আর বাড়তি কোনও সম্পর্ক বা যৌনতার ইঙ্গিত বহন করে না। এ সব এখন কমনপ্লেস। বন্ধু কথাটার ব্যাপ্তি আমরা যে অবশেষে উপলব্ধি করতে শুরু করেছি, সেটা পুজোর আড্ডা দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায়! তা ছাড়া সারা রাত মেয়ে বাড়ির বাইরে থাকবে ভেবে যে মধ্যবিত্তের এক সময় কোরামিন নেওয়ার অবস্থা হত, সেই মধ্যবিত্ত এখন সারা রাত জেগে প্যান্ডেল হপিংয়ে বা কোনও বড় পুজোর প্যান্ডেলে বাড়ির মেয়েদের আড্ডা মারাটা ওষুধ ছাড়াই হজম করতে শিখে ফেলেছে। জেন্ডার বায়াস কেটে যাওয়াটা এখনকার পুজোর আড্ডার একটা বড় দিক। আনন্দ করার প্রক্রিয়ার যে কোনও লিঙ্গভেদ হয় না, সেটা এত দিনে বোঝা গেছে। তাই প্যান্ডেলের পাশে বসে সারা রাত আড্ডা, গান আর সিগারেটের কাউন্টারেই হোক, বা অষ্টমীতে শাড়ি পরে অঞ্জলি দিয়ে কোনও বন্ধুর বাড়ির ছাদে চিকেনের সঙ্গে ভদকা খাওয়াই হোক, পুজোর আড্ডা এখন শরতের রোদের মতোই ঝকঝকে!

পুজোর আড্ডার এখনকার আর একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল সেলফি আর গ্রুপফি! প্যান্ডেলে, মাঠে, রেস্তরাঁয়, রাস্তায় আড্ডার মাঝে মাঝে সবাই এখন নিজের ছবি তোলে। ক্ষণে ক্ষণে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের আড্ডা, নিজের ভাবনা, অবস্থান ইত্যাদি জানিয়ে দেয়! তাই যে বন্ধু পুজোয় আসতে পারল না এ বার, যে বন্ধু ফিরতে পারল না শহরে, অথবা যে বন্ধু চাকরির জটে মনমরা হয়ে আটকে থাকল নিজের কিউবিকলে, সেও সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সেই সব আপলোডেড ছবির মধ্যে দিয়ে কিছুটা হলেও একাত্মবোধ করে বন্ধুদের সঙ্গে!

সারা বছর তো বাঙালি আড্ডা মারে। তা হলে পুজোর আড্ডা স্পেশাল কেন? আমরা তো সেই অল্প বয়সে সারা বছরই প্রায় গঙ্গার ধারের সেই কাঠের জেটিতে পা ঝুলিয়ে বসে আড্ডা দিতাম। কিন্তু এত বছর পরেও পুজোর দিনগুলোর কথাই বেশি করে মনে থেকে গিয়েছে কেন? এর স্পষ্ট কারণ আমার জানা নেই! তবে মনে হয়, পুজোর সময়ে পৃথিবীর চালচিত্রটাই এমন যে সব কিছুই স্পেশাল হয়ে ওঠে। আসলে সবটাই তো মনের কারিকুরি! গ্রীষ্মের কটকটে রোদ দেখলে যেমন বিরক্তি আর ক্লান্তি আসে। বর্ষার মেঘ দেখলে যেমন অজানা কী এক কষ্ট মনে পড়ি-পড়ি করেও পড়ে না, তেমন শরতের আকাশের নীচে সবটাই অন্য রকম একটা ভাললাগায় রাঙানো লাগে। ঢাকের আওয়াজ, মানুষজনের উজ্জ্বল মুখ আর আলোময় প্যান্ডেলের মাঝে আমাদের একঘেয়ে, কষ্ট করে বয়ে নিয়ে যাওয়া জীবনটাকেও কেমন নতুন ছাপানো বইয়ের মতো লাগে। রোজকার আড্ডার পুরনো কথাও মনে হয় যেন প্রথম বার শুনছি! রোজ দেখা বন্ধুকে দেখে মনে হয় ‘কত্তদিন তোকে দেখিনি!’ আসলে সারা বছর আমরা কষ্ট করি এই চারটে দিন বাঁচব বলে। চারটে দিন কাটা ঘুড়ির মতো ঘুরব বলে। সবাই একসঙ্গে সিনেমা দেখব বলে। দল বেঁধে খেতে যাব বলে! আর আমরা চাই, এই সব কিছুর মধ্যে সুতোর কাজের মতো জড়িয়ে থাকবে আমাদের আড্ডা! আমাদের আবার একটা বছরের জন্য বাঁচিয়ে দিয়ে যাবে আমাদের দেদার আড্ডা ও তার ভালবাসার ওম! আসলে ভালবাসা ছাড়া, বন্ধুত্ব ছাড়া পুজোর আড্ডার অন্য কোনও দাবি তো ছিল না কোনও দিন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন