আমার মামার সংখ্যা বড় কম নয়। মোট আট জন। মাসি পাঁচ। আমার মামার বাড়ির দিকটা, অর্থাৎ পুরো পরিবারটাই একটু ভালমানুষ, নির্বিরোধী, নিরীহ। কেউই তেমন লড়াকু বা ডাকাবুকো নয়। তা বলে সবাই সমান নিরীহ বা ভাল এমন নয়। কারও একটু-আধটু স্পিন আছে, বিপথে যাওয়াও আছে, কিন্তু তা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। দাদামশাই ডাকসাইটে রেল-কর্মচারী ছিলেন। যেমন সুপুরুষ, তেমনই সাহসী ও সফল। মামারা উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর চেহারাটা পেয়েছিলেন, চরিত্র নয়। ফলে দাদামশাই ষাট বছর হওয়ার আগেই যখন মারা যান, স্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করার মতো যথেষ্ট সম্পত্তি রেখেই গিয়েছিলেন ছেলেদের জন্য, কিন্তু নিরীহ ও বিষয়বুদ্ধিহীন মামাদের সেই সম্পত্তি রক্ষা করার মতো এলেম ছিল না। পাঁচ ভূতে লুটেপুটে খেল। তবু বলতে হবে ভালমানুষদের জন্য বোধহয় ভগবান কিছু ব্যবস্থা রাখেন। তাই ডুবতে ডুবতেও তাঁরা তেমন ভাবে তলিয়ে গেলেন না। সম্পন্নতা বা ঐশ্বর্য না থাকলেও মধ্যবিত্ততায় টিকে রইলেন। আমার মনে আছে, সেই ব্রিটিশ আমলে বগুড়া লোন ব্যাংকে দাদামশাইয়ের পঞ্চাশ হাজার টাকা ছিল। দেশভাগের অনেক বছর পরে সেই ব্যাংক চিঠি দিয়ে সেই টাকা নিয়ে আসতে বলেছিল। কিন্তু পাকিস্তান যেতে হবে বলে ভয়ে কেউ সেই টাকা নিয়ে আসতে চায়নি। সুদে আসলে সেই টাকা তখন বেশ স্ফীত হয়েছে। আজও সেই টাকা বেওয়ারিশ পড়ে আছে।
আমার এই কাহিনি অবশ্য এক জনকে নিয়ে। তিনি আমার জিষ্ণুমামা। মাত্র দু-তিন মাস আগে বোধহয় নব্বই পেরনো মামা বিদায় নিলেন। যৌবনকালে জিষ্ণুমামার ছিল অসাধারণ চেহারা। খুব লম্বাচওড়া নন, কিন্তু টকটকে ফরসা, মাথায় কালো আঙুরের থোকার মতো কোঁকড়া চুল, তেমনই অসামান্য মুখশ্রী। দোষের মধ্যে একটু তোতলা ছিলেন।
আমরা তখন লামডিং-এ। রেলের যে বাড়িটিতে আমরা তখন থাকি, সেটি বেশ বড়। চারদিকে বাগান, পাশেই খেলার মাঠ। জিষ্ণুমামা তখন লামডিঙে বেড়াতে গেছেন। আর মামার সঙ্গে আমার খুব ভাব। আমার বন্ধুরাও তাঁকে ভারী পছন্দ করত। কারণ আমাদের কোনও আবদারই মামা ফেলতেন না। ক্রিকেটে ফিল্ডিং দিতেন, বল করতেন, গোলকিপিং করতেন, পেয়ারা বা কামরাঙা পেড়ে দিতেন।
সেই সময়ে এক দিন বিকেলে আমার শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এল। প্রবল জ্বর। এবং জ্বর লাফিয়ে লাফিয়ে একশো ছয় ডিগ্রিতে উঠে গেল সন্ধের পর। ডাক্তার এলেন। সব দেখেটেখে মুখ গম্ভীর করে বাবাকে বললেন, ব্লাড টেস্ট করাতে হবে। মনে হচ্ছে টাইফয়েড। শুনে আমার মাথায় বজ্রাঘাত। তখনকার দিনে টাইফয়েড হলে সহজে সারত না, দেড়-দু’মাসের ধাক্কা। আর সামনেই তখন আমার অ্যানুয়াল পরীক্ষা।
পরীক্ষার চিন্তায় প্রবল ইচ্ছাশক্তির বলে জ্বর পর দিনই এক সময়ে সাতানব্বইতে নামিয়ে ফেলেছিলাম। ডাক্তার দেখে বললেন, হ্যাঁ, উইল-পাওয়ারে এ রকম মাঝে মাঝে হয়, তবে এটা বেশি ক্ষণ থাকবে না। থাকলও না। জ্বর বাড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে পেট ছাড়ল। প্রবল জ্বর, প্রবল উদরাময়।
আর সেই সময়ে জিষ্ণুমামা আমার কাছে শয্যাপার্শ্বে সেই যে মোতায়েন হলেন, তাঁকে আর কেউ নড়াতেই পারল না। কী গভীর স্নেহ আর মমতায় জিষ্ণুমামা আমাকে আগলে ছিলেন তা মনে পড়লে আজও চোখে জল আসে। উনিই মাথা ধোয়াতেন, জলপট্টি দিতেন, ঘন ঘন বেডপ্যান পরিষ্কার করতেন। মা কাছে এলে বলতেন, মেজদি, তুমি কাছে এসো না, তা হলে বেশি বায়না করবে। তোমারও মন খারাপ হবে। দিদি বা ঠাকুমাকেও বেশি ঘেঁষতে দিতেন না। তখনকার দিনে জ্বর হলে পথ্যি ছিল বার্লি বা সাবু। খেতে পারতাম না। কিন্তু মামা ঠিক ভুলিয়েভালিয়ে, নানা রকম গল্প বলে, স্তোকবাক্য দিয়ে আমাকে খাইয়ে দিতেন। কখনও-সখনও এক-আধটা কমলালেবুর কোয়া, একখানা চোরাই বাতাসা বা চিনির জল আর লেবু ঘুষ দিতেন। রাত্রিবেলাতেও মামাই পাশে থাকতেন। প্রবল জ্বরের মধ্যে মাঝে মাঝে ঘোর লাগা চোখে চেয়ে দেখতাম, যিশুখ্রিস্টের মতো মামার করুণ মুখ আর মায়াভরা দুটি চোখ আমার দিকে নিবদ্ধ। আমার প্রাণপাখিটিকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই পাহারা দিতেন জিষ্ণুমামা।
আমার মাথার কাছে একটা রেডিয়ো ছিল। সন্ধেবেলা মামা রেডিয়ো চালিয়ে আমাকে শোনাতেন।
বাহান্ন দিন বড় কম সময় নয়। তখন টাইফয়েডের কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ ছিল না, জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল ছিল না, এখনকার মতো ডাক্তাররা তখন ভাল ভাল পুষ্টিকর খাবারের পথ্য দিতেন না। ফলে শরীর শুকিয়ে কাঠি হতে লাগল, শরীরের সব শক্তি উধাও হল আর নেমে এল রাজ্যের দুর্বলতা। বালিশ থেকে ঘাড়ই তুলতে পারি না। জিষ্ণুমামা তখন উঁচু করে বালিশ সাজিয়ে, আমাকে পাঁজাকোলে করে বসিয়ে দিতেন। কত গল্প বলতেন, কত ভরসা দিতেন। কী যত্নে যে অয়েল ক্লথ পেতে দীর্ঘ ক্ষণ ধরে ঠান্ডা জলে মাথা ধুইয়ে দিতেন তা বলার নয়।
একটু একটু করে জ্বর নামল। বোধহয় মাসখানেকের মাথায় আমাকে গরম জলে কিছু ক্ষণ রাখা ডিম প্রায় তরল অবস্থায় খাওয়ার নির্দেশ দিলেন ডাক্তার। সে যেন অমৃত। মুড়ি খাওয়ার অনুমতিও পাওয়া গেল, কিন্তু বেশি নয়, কম। আমি তখন কেবল খাবারের বায়না করতাম, কাঁদতামও। কিন্তু সর্বংসহ জিষ্ণুমামা আমাকে ঠিক সামলাতেন। ওষুধ, পথ্য সব তিনিই খাওয়াতেন। বড় কৌটোর ভিতরে আগে কাগজ ঢুকিয়ে পরিসর কমিয়ে ওপরে মুড়ি ঢেলে আমাকে দিতেন, যাতে বেশি না খাই।
তখন জিষ্ণুমামাকে যতটা না বুঝেছি, পরে বড় হয়ে বুঝেছি তার ঢের বেশি। আজও মনে হয়, জিষ্ণুমামার ভিতরে বাহান্ন দিন ধরে স্বয়ং ভগবান আমাকে আগলে রেখেছিলেন। আজও তাঁর জন্য বুক টনটন করে।
ছবি: সুমিত্র বসাক।