রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
Share:

তিল

Advertisement

পিনাকী ভট্টাচার্য

Advertisement

খুল যা সিম্‌সিম্‌’ মনে আছে? যার ইংরেজি 'Open Sesame!' যা বলে আলিবাবা হাঁক দিতেই গুপ্তধন মিলেছিল। আজ সেই Sesame বা তিলের গপ্প— তিনি খাওয়ার জগতের এমন এক চরিত্র যিনি পূজাপার্বণ থেকে চর্বিতচর্বণ— সবেতেই আছেন।

তিল ঠিক কবে থেকে রসুইঘরে প্রবেশ করেছিল তা ইতিহাসেরও হিসেবের বাইরে। অন্যান্য শস্যের সঙ্গে, হরপ্পায় এক তাল
পোড়া-তিলও পাওয়া গিয়েছে। ঋগ্বেদে যদিও তিলের উল্লেখ নেই, কিন্তু তিল দিয়ে তৈরি খাবারের উল্লেখ রয়েছে। অথর্ববেদের সময় থেকে তিল শুধু খাওয়ার জন্য নয়, ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও ব্যবহৃত হচ্ছে— নবধান্যের অন্যতম হিসেবে তিলকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে আর যাগেযজ্ঞে তিল স্থান পাচ্ছে। সেই জমানায় আর্যদের আর তার কিছু দিন পর পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের লাঞ্চ হত ভাত, ঘি, দুধ আর তিল দিয়ে। এর বেশ কয়েকশো বছর পরে আলেকজান্ডারের সঙ্গে এ দেশে আসা গ্রিক পণ্ডিত আরিস্তবোলাস লিখেছেন, তিনি ব্রাহ্মণদের মধু আর তিল মিশিয়ে এক রকম লাড্ডু খেতে দেখেছেন।

তিল শুধু এ দেশে নয়— সারা বিশ্বেই অত্যন্ত পরিচিত সেই আদ্যিকাল থেকে। মেসোপটেমিয়াতে তিলের চাষ হচ্ছে চার হাজার বছর ধরে; তুতানখামেনের মমির পাশে পাওয়া তিল প্রমাণ করে সেই জমানাতেও তা মানুষের কতটা প্রিয় ছিল! শুধু মুখরোচক বলে নয়, তার পুষ্টিগুণও তিলকে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি এনে দিয়েছিল। রোমান যোদ্ধারা শরীরের শক্তি আর উদ্দীপনা ধরে রাখতে তিল খেত। অ্যাসিরীয় উপকথা বলে, দেবতারা যখন পৃথিবী তৈরি করতে মিলিত হয়েছিলেন, তাঁরা তিল দিয়ে তৈরি সুরা পান করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের জনপ্রিয় খাবার ‘পাস্তেলি’ তিল আর মধু দিয়ে তৈরি হত। এই কিংবদন্তি বনে যাওয়া ‘ওয়েফার’টা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রেসিপিতে বদল ঘটিয়েছে। ডুমুর, কিশমিশ আর বাদাম যোগ হয়েছে রান্নায়, কিন্তু তাতে তিলের স্বাদের রকমফের ঘটেনি। সেই প্রথম শতাব্দীতেই ভারত থেকে তিল ইউরোপে পৌঁছে গিয়েছিল। আফ্রিকায় ‘বেন্নি’ (সেখানে তিলকে এই নামেই ডাকে) পৌঁছে গিয়েছিল বহু যুগ আগেই। ক্রীতদাসদের হাত ধরে, আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় পৌঁছল।

চিনদেশের সঙ্গে তিলের পরিচয় সেই চার হাজার বছর আগে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, খাবার হিসেবে নয়— সেই জমানায় চিন-এ তিল ব্যবহার হত কালি তৈরি করতে আর জ্বালানির তেল হিসেবে। তিল খাবার হিসেবে ও-দেশে প্রথম ব্যবহৃত হয় হান সাম্রাজ্যের সময়— সম্রাট লিং-এর প্রিয় স্ন্যাক হওয়ায় এর গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছিল। ট্যাং যুগে তিল মেশানো রুটি হয়ে ওঠে সেই জমানার সবচেয়ে জনপ্রিয় জলখাবার। আর হালফিলের সব চিনে খাদ্যরসিকই জানেন— চিনা খাবারে, বিশেষ করে অনেক ডিজার্টে তিল থাকবেই থাকবে।

আদ্যিকাল থেকেই ভেষজ হিসেবেও তিল জনপ্রিয়। মিশরের ৩৬০০ বছরের পুরনো ৬৫ ফুট লম্বা এবের্‌স প্যাপিরাস-এ লেখা ওষুধের তালিকায় তিলের নাম পাওয়া যায়। রানি ক্লায়োপাত্রা তাঁর ত্বক-পরিচর্যার জন্যে তিল ব্যবহার করেছেন। ব্যাবিলনের মহিলারা মধুর সঙ্গে তিল মিশিয়ে খেতেন যৌবন ধরে রাখার জন্য। আমাদের দেশে তো আবার তিলের সঙ্গে আয়ু আর অমরত্বের একটা যোগসূত্র টানা হয়েছে বৈদিক আমল থেকেই। আলেকজান্ডারের আমলে কারা যেন মধু আর তিলের মণ্ড খেত!

pinakee.bhattacharya@gmail.com

নাম হয়ে গেল ‘কী বিপদ!’

এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে নাম লেখানোর পর আট বছর কোনও ডাক পাইনি। ওখানে নিমাই বলে এক জনের সঙ্গে একটু পরিচয় ছিল। এক দিন দেখা করে বললাম, বয়স তো তেত্রিশ হয়ে গেল, কিছু হল না তো! নিমাই বলল, পশ্চিমবঙ্গ সরকার চাকরির বয়সসীমা পঁয়ত্রিশ করেছে। কলকাতা পুলিশে সাব-ইন্সপেক্টর নেবে, চাইলে আপনার নাম লালবাজারে পাঠিয়ে দিই? রাজি হলাম।

এর নাম ভাগ্য। যখন সরকারি চাকরি পাওয়ার কথা নয়, তখন আমি পুলিশের চাকরির সব পরীক্ষা দিয়ে সফল হয়ে কলকাতা পুলিশের দারোগা হলাম।

চাকরিতে যোগ দিলাম ব্যারাকপুর পুলিশ ট্রেনিং কলেজে। প্রথম দিন চুল বাটি-ছাঁট করা হল, দ্বিতীয় দিন থেকে ফিল্ড ট্রেনিং। ভোর সাড়ে পাঁচটায় মাঠে হাজির, যাকে বলে ‘ফল ইন’। একটা ফুটবল গ্রাউন্ডের আকারের মাঠে প্রথমে সাত পাক দৌড়, তার পর পি.টি, প্যারেড। বয়স বেশি হওয়ায় আমার তো ওষ্ঠাগত প্রাণ! বলে ফেললাম, ‘কী বিপদ!’ সেই থেকে আমার নাম হয়ে গেল ‘কী বিপদ’। আরও অনেকেরই নামকরণ হয়েছিল। এক জন দৌড়ের সময় চিনেবাদাম মুখে দিয়েছিল, বিষম খেয়ে মরমর। তার নাম হল ‘বাদামদা’। এক জনের মাথায় টাক ছিল, একটু ঝুঁকে হাঁটত। তার নাম ‘বৃদ্ধ শাজাহান’। ন্যাকা ন্যাকা কথা বলার জন্য আর এক জনের নাম হল ‘ইলুপিসি’।

সব চেয়ে ভয়াবহ ছিল ঘোড়া চালানো। ট্রেনার মাহাল সিং, পঞ্জাবি। দাড়ির ফাঁক দিয়ে কী যে বলতেন, বেশির ভাগই বুঝতাম না। তবে ঘোড়াগুলো ওঁর কথা সব বুঝত। মাহাল সিং যা বললেন তাতে বোঝা গেল, দু’পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পেটে মারতে হবে, মারার তরিকা দেখে ঘোড়া বুঝবে, কী ভাবে চলতে হবে। প্রথম দিন ঘোড়ার চলার ছন্দের সঙ্গে শরীরটাকে ঠিকমত ওঠানামা করাতে না পারায় নিতম্বের চামড়া ঘষা খেয়ে উঠে গেল। অসম্ভব জ্বলুনি! ব্যারাকে ফিরে দেখি, একই অবস্থা অনেকেরই। অগত্যা উপুড় হয়ে শুয়ে একে অপরের পশ্চাদ্দেশে বোরোলীন লাগালাম। সকাল-বিকেল পি.টি-প্যারেড আর দুপুরে ল’ ক্লাস। বারো-তেরো মাস কাটিয়ে কলকাতায় ফিরলাম। এ বার প্র্যাকটিকাল ট্রেনিং।

ছবি: দেবাশিস রায়

ট্রেনিং শুরু হল বেনিয়াপুকুর থানায়। বড়বাবু রাশভারী লোক। তাঁর নির্দেশে সেকেন্ড অফিসারের তত্ত্বাবধানে থানার কাজ শেখা শুরু হল। একটা থানা চালাতে যা যা জানা দরকার, মাসখানেকের মধ্যেই জেনে গেলাম। তখন থানায় অফিসারের সংখ্যা কম ছিল। আমাকে তাই মাঝে মাঝে ডিউটি শিফ্‌টে বসতে হত। এই ডিউটি শিফ্‌টকে বলা হয় ‘ফাইল ডিউটি’। এক বার এক নাইট ফাইল-এ ঘটনাক্রমে এক দাগি আসামিকে ধরে বড়বাবুর বাহবা কুড়োলাম। আড়ালে অবশ্য অনেকেই টিটকিরি দিল— ঝড়ে বক মরে, ফকিরের কেরামতি বাড়ে!

পোস্টিং হল মুচিপাড়া থানায়। এলাকায় বাড়িওয়ালা-ভাড়াটের ব্যাপক গোলমাল। এক দিন নাইট ডিউটি শেষে সবে এক কাপ চা নিয়ে বসেছি, খালি গায়ে গামছা পরে এক লোক এসে হাজির। কী ব্যাপার? না, তিনি এক জন ভাড়াটে, অভিযোগ করতে এসেছেন, বাড়িওয়ালা ভাড়াটেদের বাথরুমে তালা দিয়ে দিয়েছে। অভিযোগকারীকে বললাম, এই পোশাকে না এলেই কি হত না? ভদ্রলোক খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘আমাদের সমস্যা নিয়ে ভাবুন আগে, পরে পোশাক নিয়ে ভাববেন!’ প্রমাদ গুনলাম। নিজের প্রাতঃকৃত্য ভুলে, এক জন কনস্টেবলকে নিয়ে সাতসকালে ছুটলাম সেই বাড়ি। একটা বাথরুম তালা দেওয়া, পাশে ছোট একটা বাথরুম খোলা। ভাড়াটেদের বললাম, এই তো আপনাদের ব্যবস্থা আছে! এক ভাড়াটে বললেন, ‘দেখুন তো এর মধ্যে একটু স্বাস্থ্যবান লোক বসতে পারে কি না? আপনিই বসে দেখুন।’ অবাক কাণ্ড। আমাকে বাহ্যি করার পোজে বসে দেখতে হবে!

বাড়িওয়ালাকে ডেকে তাঁর বাথরুমটা খোলালাম। সেটা প্রমাণ সাইজের। বললাম, ‘নতুন বাথরুমে আপনার তালা লাগান, ওটা আপনি ব্যবহার করবেন। আগেরটা ভাড়াটেরা যেমন ব্যবহার করতেন, তা-ই করবেন।’ ধমকের সুরে বলেছিলাম, বাড়িওয়ালা উচ্চবাচ্য না করে মেনে নিলেন। সে দিনের মতো ঝামেলা মিটল।

আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা এলাকায় এক ডাক্তারবাবু আকুপাংচার পদ্ধতিতে চিকিৎসা করতেন, যদিও ওঁর কাছে পরিচিতরা ভয়ে যেতেন না, পাগলাটে ছিলেন বলে। উনি সঞ্চয়িতা চিট ফান্ডে কিছু টাকা রেখেছিলেন। হাইকোর্টে মামলা চলছিল। এক দিন মহামান্য বিচারপতি মামলার শুনানি মাঝপথে মুলতুবি করে দেন। ডাক্তারবাবু কোর্টে হাজির ছিলেন। মামলা মুলতুবি, ঘোষণায় উনি রেগে আগুন। বিচারপতিকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে নিজের একটা ভিজিটিং কার্ড ছুড়ে দিয়ে কোর্ট থেকে দৌড়। পর দিন হাইকোর্ট থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও.সি-র কাছে নির্দেশ এল, ডাক্তারবাবুকে মহামান্য বিচারপতির সামনে হাজির করাতে হবে।

বড়বাবু এই দুরূহ কাজটি দিলেন আমার ঘাড়ে। নিন্দুকেরা বলত, ডাক্তারবাবু নাকি কামড়েও দেন। আমি এক সহকর্মীকে নিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ি গেলাম। ওঁকে বোঝালাম, বিচারপতি সে দিন আপনার কথা বুঝতে পারেননি, তাই আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আপনাকে ওঁর কাছে নিয়ে যেতে। উনি আপনার কথা শুনবেন। ডাক্তারবাবু রাজি হলেন। একটা ট্যাক্সিতে আমি আর আমার সহকর্মী দু’পাশে বসে ডাক্তারবাবুকে মধ্যেখানে বসিয়ে চললাম। উনি এক বার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমাকে কি অ্যারেস্ট করলেন?’ কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা হাইকোর্ট, ইন্সপেক্টরের ঘরে ডাক্তারবাবুকে নিয়ে গেলাম।

ডাক্তারবাবু আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, ‘বিশ্বাসঘাতক!’ তার পর হঠাৎ আমার ডান হাতটা টেনে নিয়ে কবজিতে এক কামড়। হাইকোর্টের ডিসপেনসারি থেকে একটা টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিয়ে ফিরে এলাম। পরে জেনেছিলাম, বিচারপতিকে অপমান করার জন্য ডাক্তারবাবুর তিন দিনের জেল আর ৫০০ টাকা জরিমানা হয়েছিল।

আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায় এর পর যদ্দিন ছিলাম, ডাক্তারবাবুর বাড়ির সামনে দিয়ে আর যাইনি!

বিমল চৌধুরী, বাবুরাম শীল লেন chowdhury_bimal@yahoo.co.in

যেখানেই কাজ করুন, ব্যাংক, রেস্তরাঁ, আইটি, অন্য কোথাও— আপনার অফিসের পরিবেশ পিএনপিসি
হুল্লোড় কোঁদল বস কলিগ ছাদ ক্যান্টিন— সব কিছু নিয়ে ৭০০ শব্দ লিখে পাঠান।
ঠিকানা: অফিসফিস, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন