বুম আর ব্র্যাকি

গেল গেল গেল! সব ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেল! সর্বস্ব ভাঙ। থামলি কেন! যখন আর কিচ্ছুটি আস্ত থাকবে না, তখন বুঝতে পারবি।’তৃষার কণ্ঠের ঝনঝনানিতে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল। এই বজ্রনির্ঘোষের কারণ একটা আছে বইকী! মাম্মা রান্না ঘরে ব্যস্ত। এক বার মুখ বাড়িয়ে, ‘মাম্মা আমি ডাইনোসরে কালার করছি কিন্তু’, বলেই বুম মেরেছে এক ছুট। মা’র উত্তরের জন্যে তার তর সয়নি।

Advertisement

কেয়া মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:০০
Share:

গেল গেল গেল! সব ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেল! সর্বস্ব ভাঙ। থামলি কেন! যখন আর কিচ্ছুটি আস্ত থাকবে না, তখন বুঝতে পারবি।’

Advertisement

তৃষার কণ্ঠের ঝনঝনানিতে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল। এই বজ্রনির্ঘোষের কারণ একটা আছে বইকী! মাম্মা রান্না ঘরে ব্যস্ত। এক বার মুখ বাড়িয়ে, ‘মাম্মা আমি ডাইনোসরে কালার করছি কিন্তু’, বলেই বুম মেরেছে এক ছুট। মা’র উত্তরের জন্যে তার তর সয়নি। সাড়ে চার বছরের বুম ডিং মেরে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করলে যতটা উঁচু হয়, তার থেকে একটু ওপরে একটা তাকে, এক বান্ডিল রংবেরঙের স্কেচ পেন আর ক্রেয়নে ভরা প্লাস্টিকের ডাব্বাটা তোলা আছে। তবু কী ভাবে যেন বুম ঠিক আঙুলের ডগায় ডাব্বাটা টেনে আনে। আজও ম্যানেজ করে নিয়েছিল প্রায়, কিন্তু শেষ মুহূর্তে রক্ষে হল না! চড়াক দুম! গোটা বারো স্কেচ পেন আর চব্বিশটা ক্রেয়নওয়ালা একটা ডাব্বা ফুট চারেক ওপর থেকে পড়লে যতটা শব্দ হয় আর কী!

কী হয়েছে বা হতে পারে আন্দাজ করে নিয়েই কিচেন থেকে চেঁচিয়ে বাড়ি কাঁপালেন তৃষা। এক এক জনের যেমন উদ্ভট খেয়াল থাকে সব ব্যাপারে পিটির পিটির, খিটির খিটির। বুমের মা’রও তাই। বুমও এই নিয়ে তিতিবিরক্ত! রেগে যে গেছে মাম্মা, বোঝাই যাচ্ছে। বেশি রাগলেই ‘তুমি’টা ‘তুই’ হয়ে যায় কিনা!

Advertisement

‘বুম, দেওয়ালের ওপর দিয়ে ঘষে ঘষে গাড়ি একদম চালাবে না! দাগ হয়ে যাবে।’

‘বুম, আবার! জল জমে আছে দেখেই ঝুপ করে জমা জলের মধ্যে লাফালে! জুতো তো ভিজে চুপ্পুস হয়ে গেল। কত বার বলেছি না, জলে লাফাবে না...’

না, না, না! সারা দিন এই রকম শয়ে শয়ে ‘না’-এর মিছিল! নাজেহাল হয়ে গেল বুম। তবু কী আর করা! মাম্মা তো! বুকে জড়িয়ে আদর যখন করে, তখন গুলুগুলু হতে হতে বুম সব ভুলে যায়। অন্তত তখনকার মতো।

‘এ কী, ডাইনোসরের রং এই রকম, কেন?’

মাম্মা যে কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে! একদম খেয়ালই করেনি বুম।

‘এ রকম কালার হয় তো মাম্মা!’

‘এই রকম কালার হয়! এ তো সব রং একটু একটু করে দিয়েছ! ডাইনোসরের স্টোরি-বইটা দেখো। এ রকম রং আছে একটারও?

হঠাৎ বুমের চোখ পড়ল ছবির ডাইনোসরটার দিকে। এ কী, এক বার চোখ পিটপিট করে উঠল যেন! কী যেন বলতে চাইছে! যেন বলছে, ‘এ রকম রং আলবাত হয়।’

একটু ভরসা পেল বুম।

‘আমার ডাইনোসরটার রেনবো কালার, মাম্মা।’ বলেই এক বার বুম তাকাল কালারিং বুকটার দিকে। ওই যে, আবারও চোখ পিটপিট!

কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তৃষা। বুমের মুখে ওই ‘রেনবো কালার’-এর ডাইনোসর শুনে একটু হেসেই ফেললেন। বুমের চুলে একটু আদর করে দিয়ে কিচেনের দিকে এগোলেন তৃষা।

‘একটু পরেই খেতে ডাকছি কিন্তু। কালার করা শেষ করো তাড়াতাড়ি।’

মাম্মা চলে যেতেই বুম আবার তাকাল কালারিং বইটার দিকে। ডাইনোসরটার মুখে এক চিলতে হাসি যেন! এত দিন বুমের সব থেকে ফেভারিট ছিল ছোট ছোট গাড়িগুলো। এখন ডাইনোসররাও। প্লে-স্কুলে ডাইনোসর নিয়ে অনেক কিছু জেনেছে বুম। টিচাররা গল্প শুনিয়েছেন। বুম জানে আর্জেন্টিনোসরাস সবচেয়ে বড় ডাইনোসর। টির‌্যানোসরাস একদম গাছ পাতা খায় না। শুধু মাংস খায় আর খুব রাগী। ওদের সঙ্গে সহজে এঁটে উঠতে পারে না অন্য ডাইনোসররা। ও দিকে বিরাট লম্বা গলা আর বিশাল চেহারা হলে কী হয়, ব্র্যাকিওসরাস কিন্তু নেহাতই গোবেচারা আর শুধুই গাছ-পাতা খায়। স্টেগোসরাসরাও গাছপাতাই খায়। কিন্তু হলে কী হবে! পিঠ জুড়ে এমন শক্ত প্লেট আর স্পাইক, যে ভয়ে কেউ ওদের কাছেই ঘেঁষে না। টির‌্যানোসরাসদের এমন লম্বা ডানা যেন ছোটখাটো একটা এরোপ্লেন! ভীষণ ভাল উড়তে পারে ওরা। গল্প শুনতে শুনতে কখন যে ডাইনোসররা তার খুব ফেভারিট হয়ে গেছে! বাবা কিনেও দিয়েছে দুটো ডাইনোসরের বই। পাতায় পাতায় রঙিন ছবি! মাঝে মাঝে ডিসকভারি চ্যানেলে ডাইনোসর দেখে বুম। এখন এরাই তার সঙ্গী। এই এখনও যে রং করতে বসেছিল বুম, ছোট বড় গোটা তিনেক ডাইনোসরকে পাশে নিয়ে।

কালারিং বইটা থেকে মুখ তুলল বুম। পাশে রাখা বাদামি-হলুদরঙা ব্র্যাকির দিকে তাকাল। আসলে ব্র্যাকিওসরাস, বুম বলে ব্র্যাকি। কী আশ্চর্য! ব্র্যাকির মুখেও এক চিলতে হাসি। চোখ কচলে আবারও দেখল বুম। নাহ! ভুল নয় তো!

ব্যালকনির পাশের কাচের লম্বা জানলার দিকে তাকাল ব্র্যাকিটা। বুমকে যেন ইশারা করল। ও মা! দোতলার এই জানলার পাশে ছোট্ট মাথায় দুটো গোল গোল চোখ নিয়ে আর একটা ব্র্যাকি যে! কখন এল! কী কাণ্ড!

‘তুমি তো মোটেই সত্যি নও। তুমি তো এক্সটিংক্ট হয়ে গেছ অনেক দিন আগে। টিচারদের কাছে শুনেছি। হঠাৎ কোথা থেকে এলে বলো তো?’ জিজ্ঞেস করল বুম।

‘আমাদেরও লুকিয়ে থাকার জায়গা আছে। দারুণ ভাল জায়গা। যাবে তুমি?’ এ বার একটু দ্বিধায় পড়ে গেল বুম।

‘কী, মাম্মার কথা ভাবছ তো? ও কিচ্ছু হবে না। চলো তো। এক্ষুনি ঘুরে চলে আসব। বেশি দূরে তো নয়।’

জানলার পাশের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল বুম। নাহ! মাম্মার আর একটু সময় লাগবে কিচেনে লাঞ্চ রেডি করতে। এক বার ঘুরেই আসা যাক! লম্বা ঘাড়টা নিচু করে নামাতেই চটপট উঠে বসল বুম ব্র্যাকির ঘাড়ের কাছে। দু’হাত দিয়ে চেপে ধরল ব্র্যাকিকে। ব্র্যাকি সোজা হতেই দুলে উঠল বুম।

‘শক্ত করে ধরে থাকো। ভয় নেই। এই পৌঁছে গেলাম বলে।’

কী জোরে জোরে হাঁটে ব্র্যাকিটা! নিমেষে যেন পৌঁছে গেল কত্তটা। হাউসিং থেকে বেরিয়ে এক বারই একটু ঝামেলা হয়েছিল। তার পর থেকে সব ঠিকঠাক। আসলে সিগন্যালের কাছে দাঁড়াব না করে হলুদ থেকে লাল আলো হতে দাঁড়িয়েই পড়েছিল ব্র্যাকি। আর তাতেই পুলিশকাকুটা হতভম্ব। ডাইনোসরকে কেউ কোনও দিন সিগন্যালে দাঁড়াতে দেখেনি কিনা! তার পর থেকেই দে ছুট! আর ব্র্যাকির নাগাল পায়নি কেউ।

‘এই জায়গাটা কোথায়?’

‘আরে চিনবেই যদি, তা হলে তো আগেই চলে আসতে। চেনো না বলেই তো নিয়ে এলাম। এখন দেখো, জায়গাটা পছন্দ কি না।’

সামনেই কী নরম, চকচকে সবুজ ঘাস! কী দারুণ বাগানটা! এক জায়গায় কত রঙের ক্রেয়ন! কত স্কেচ পেন। ও মা, জল রংও আছে তো। পাশে একটা নিচু বোর্ডে কী দারুণ ছবি আঁকার কাগজ! দু’হাত ভরে রং তুলে নেয় বুম। হাতে রং নিয়ে ছোপ লাগায় সুন্দর কাগজটাতে।

‘বুম, খাবে কিছু?’

মিষ্টি করে ডাকে কেউ। ফিরে দেখে, একদম রানির সাজে ভারী সুন্দর এক জন মহিলা। মুখটা যেন একটু চেনা চেনা। চুলে চিকচিকে ঝিলমিল কী সব যেন। জব্বর খিদে পেয়েছিল। কোনও রকম হাত ধুয়ে বুম বসে পড়ল টেবিলে। হাত বাড়ালেই প্রচুর কেক, পেস্ট্রি, চকোলেট! বাবলগামও কত্ত রকম! ফল আর সবজি ছেড়ে সে দিকেই হাত বাড়াল বুম। নাহ, কিচ্ছু বললেন না রানিমা। কী ভাল! খাবার পরে চেয়ার থেকে নামতে গিয়েই বুমের চোখে পড়ল এক পাশে কী সুন্দর একটা ফোয়ারা। কত জল। ছোট্ট পাঁচিল টপকে ফোয়ারার মধ্যে নেমে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলতে শুরু করল বুম। ছপ ছপ করে আওয়াজ হয় আর জল ছিটকোয়। ঝিরঝির করে ফোয়ারার জল এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে গা! বুমকে দেখে আস্তে আস্তে বাচ্চা ক’জন ব্র্যাকিও এগিয়ে এল। ল্যাজ দিয়ে ছপাত ছপাত করে জল ছিটকোয় ওরাও। কী দারুণ মজা। কেউ বারণ করে না।

বুম ভিজে একশা। জল ছেড়ে উঠে এল বুম। সামনেই সেই রানিমা। দু’হাত বাড়িয়ে কোলে নিতেই মুহূর্তেই জল সব শুকিয়ে গেল। জামাকাপড়ও। রানিমার সঙ্গেই একটা ঘরে গেল বুম। সেখানে চার দিকে যত খেলনা গাড়ি, তত ছোট-বড়-মাঝারি নানা সাইজের ডাইনোসর। বললেন, ‘এই ঘর থেকে যত খুশি গাড়ি আর ডাইনোসর নিয়ে নাও তুমি।’

বুমের খুশি আর ধরে না। ছোট্ট ছোট্ট হাত ভরে তুলে নেয়, যতগুলো পারে।

‘বুম, এসো সোনা, খাবে এসো। কী বাবু... তোমায় কখন থেকে ডাকছি যে!’

উঠে বসে বুম। মাম্মা বলে, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে বুঝি? বোকুরাম, না খেয়ে কেউ ঘুমোয় বুঝি?’

গালে একটা হামি দিয়ে বুমকে খাবার টেবিলের দিকে নিয়ে গেল মাম্মা। মা’র চুলগুলো সুড়সুড়ি দিচ্ছিল বুমের মুখে। হঠাৎই চমকে উঠল বুম। ওমা, মাম্মার চুলেও ওই রকম চিকিমিকি ঝিলমিল কী সব! মাম্মার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে স্বপ্নের মায়াজালটা যেন সরে যায় বুমের চোখ থেকে।

‘কী দেখছ, এগুলো? কাল আমার বুমসোনার জন্মদিন না? ঘরটা সাজাচ্ছিলাম তো। তখনই এই সব লেগে গেছে।’

গলাটা জড়িয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে বুম। মনে মনে ভাবে, ‘নাহ, রানি চাই না! আমার মাম্মাটাই বেস্ট! আমার মাম্মাই তো রানি!’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement