নদীতে নয়, নৌকো চলছে পথেঘাটেই। ’৭৮-এর ভয়ংকর বন্যার ছবি।
বর্ষায় টানা বৃষ্টি হতে থাকলেই আমার ১৯৭৮ সালের অভূতপূর্ব বন্যার কথা মনে পড়ে। সংবাদমাধ্যমগুলো বলেছিল পশ্চিমবঙ্গের কোনও কোনও অঞ্চল তখন ১৮ ফুট জলের তলায়। লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। প্রতি বুধবার সন্ধ্যায় আমি লাইভ ‘দর্শকের দরবারে’ অনুষ্ঠান করতাম। বন্যা হওয়ার আগের সন্ধেয় অনুষ্ঠানের শুরুতে মজা করে বলেছিলাম, সারা দিনই তো বৃষ্টি চলছে, তাই আপনারা অনেকে হয়তো খিচুড়ি-পাঁপড়ভাজা খেতে খেতে অনুষ্ঠান দেখছেন। সারা রাত অবিরাম বৃষ্টি চলল। পর দিন সকালে উঠে জানলাম, ভয়ংকর পরিস্থিতি। কোনও কোনও নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে, সারা রাজ্য বন্যার জলে ভাসছে। দু-একটা কাগজ আমাকে সমালোচনা করে লিখল, যখন সারা রাজ্য বন্যার জলে ডুবে যাচ্ছে তখন উনি খিচুড়ি-পাঁপড়ভাজা খাওয়ার কথা বলে মজা করছেন! সারা রাত বিপুল বৃষ্টিতে এ অবস্থা দাঁড়াবে, তখন তো তা বোঝার উপায় ছিল না। আমি খুব লজ্জা পেলাম কাগজের মন্তব্যে।
চারপাশের অবস্থা কী জানতে পথের জল ভেঙে ক্যামেরা টিম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে এগিয়ে দেখি, নৌকো চলছে। গড়িয়াহাটের আশেপাশের রাস্তাগুলো চেনার কোনও উপায় নেই, সব রাস্তাই যেন নদী, তার দু’পাশে বাড়িগুলো জেগে আছে। লোকেরা ঘরবন্দি। প্রবীণ কলকাতাবাসীদের সাক্ষাৎকার নিতে লাগলাম, তাঁরা বললেন, এমন জলবন্দি কলকাতা দেখার অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। প্রতি দিন কলকাতার নানা প্রান্তে ঘুরে মানুষের দুর্গতি, কষ্টের ছবি তুলে ধরতে লাগলাম। লেকটাউনের রাস্তায় কোমর-জলে দাঁড়িয়ে সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বললাম। শ্রীভূমিতে গিয়ে পথে নামতেই দেখি আমি গলা-জলে দাঁড়িয়ে। উপরের তলাগুলো থেকে লোকেরা চিৎকার করে তাঁদের দুর্দশার কথা জানাতে লাগলেন, আমরা সে ভাবেই তাঁদের বক্তব্য রেকর্ড করতে লাগলাম। কেউ বলছেন, জল নেই, জিনিস কিনতে বেরোতে পারছেন না, দোকানপাটও সব বন্ধ। লোডশেডিং চলছে। লাইন সারাতে এই জলে লোক আসবে কেমন করে! এক-এক দিন এক-এক অঞ্চলের মানুষের দুর্গতির কথা দেখাতে লাগলাম। জানতে পেরে সরকারি বিভাগগুলো অনেকটা সজাগ হল। সাহায্য পাঠানো হতে লাগল। খবর এল, জেলাগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। বেরিয়ে পড়লাম জেলাগুলোর উদ্দেশে।
সব জায়গায় নিজেরা ঢুকতে পারছি না, মিলিটারির সাহায্য নিতে হচ্ছে। হুগলি জেলায় ঢোকার জন্য মিলিটারির উঁচু ট্রাকে চেপে আমরা চললাম। এক দিন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আনন্দবাজারের তরফ থেকে আমাদের সঙ্গে ছিলেন মিলিটারির ট্রাকে। আমরা তো সব ফিল্ম করছি। কিন্তু সুনীলদা কোনও ফোটোগ্রাফার সঙ্গে নেননি। হাতে কোনও নোটবইও নেই। শুধু দেখে যাচ্ছেন। পর দিন আনন্দবাজারের পাতায় সুনীলদার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ছবির মতো সব ফুটে উঠেছে। যেতে যেতে আমাদের চোখে পড়েছিল জলমগ্ন একটা বড় বাড়ি, বাড়ির লোকজন সব বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন, শুধু একটা কুকুর উঁচু দেওয়ালের ওপর বসে যেন বাড়ি পাহারা দিচ্ছে। আমরা সে দৃশ্য শুট করলাম। দেখলাম, সুনীলদার লেখাতেও খুব সুন্দর এসেছে সেই কুকুরটির কথা।
উলুবেড়িয়াতে, যেখানে সব বাড়ি একেবারে ডুবে গেছে, লোকেরা কেবল বাড়ির ছাদে বাস করছেন, সেখানে ঢুকতে মিলিটারির ভেলার সাহায্য নিতে হল। একটা বাড়ির ছাদে অনেক লোক দেখে আমরা সে দিকে এগোতে লাগলাম। তাঁরা আমাদের হাত নেড়ে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন। বাড়ির কাছে গিয়ে অনেক কষ্টে জলের উপরে জেগে থাকা দেওয়াল ধরে ধরে আমরা ছাদে উঠে গেলাম। দেখি লোকেরা নির্বাক, মেয়েরা কেউ কেউ কাঁদছেন। কী হল আপনাদের, জিজ্ঞেস করলাম। তাঁরা বললেন, আমরা ভাবলাম আপনারা খাবার নিয়ে এসেছেন, কিন্তু আপনারা তো ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন! জানেন, ক’দিন ধরে আমাদের পেটে খাবার পড়েনি! যখন জলে কলাগাছ ভেসে যাচ্ছে, সেটা ধরে আমরা শুধু থোড় চিবিয়েছি!
বন্যার পরে বেশ কয়েক দিন চলে গেছে, তখনও জল সরার কোনও লক্ষণ নেই। গ্রামাঞ্চলে পথে কোমর-জল, বুক-জল ঠেলে, জলে ভেসে থাকা মরা গরু-ছাগল দু’হাত দিয়ে সরিয়ে ঢুকতে হচ্ছে। সব সময় আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান বিমান সিংহ। খবর পেলাম, হিংলো বাঁধ ভেঙে বন্যার জল গ্রামের পর গ্রাম মানুষ ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেছে। সেখানে জল দাঁড়ায়নি। আমরা তখন সহজে সে এলাকায় ঢুকতে পারলাম। যখন হাই রোড ছেড়ে শান্তিনিকেতন যাওয়ার পথে ঢুকলাম বীরভূমের গ্রামে গ্রামে যাব বলে, দেখি, গাছের মাথায় মাথায় আটকে আছে ধুতি, শাড়ি, হাওয়ায় পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে। বুঝলাম, গাছের মাথায় আটকে গিয়েছিলেন কোনও নারী বা পুরুষ, হয়তো বাঁচার আশায় আঁকড়ে ধরেছিলেন সেই গাছের ডাল, কিন্তু জলের তোড়ে ভেসে গেছেন, পরনের কাপড় আটকে আছে গাছের মাথায়।
অভিযোগ শুনলাম, বাঁধের গেট ঠিক সময়মত খোলা হয়নি বলে বাঁধ ভেঙে বানের জল শত শত মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কর্মীরা তখন নাকি পিকনিক করতে গিয়েছিলেন, তাই বাঁধের গেট খোলার জন্যে কেউ ছিলেন না। বিপদের কোনও পূর্বাভাসও নাকি সাধারণ মানুষকে দেওয়া হয়নি। বাঁধ কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলাম। শুটিং চলছে, শুধু একের পর এক আমার প্রশ্ন, কোনও জবাব নেই। শুধু টেবিলে রাখা পেপারওয়েটটা সেই কর্তাব্যক্তি হাত দিয়ে ঘুরিয়ে যাচ্ছেন। আমরা ক্লোজ-আপে ধরে আছি সেই দৃশ্য। সেই ইন্টারভিউ প্রচারিত হলে বাঁধ কর্তৃপক্ষের উপর দর্শকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় সেচমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হল। জিজ্ঞেস করলাম, কোনও ব্যবস্থা নেবেন? বলেছিলেন, হ্যাঁ, দোষীরা শাস্তি পাবে। জেনেছিলাম শাস্তির নির্দেশ এসেছিল। এবং ফলত আমার বদলির আদেশ এসেছিল সেই উচ্চপদস্থ অফিসারদের আমার উপর ক্ষোভের কারণে। আমাদের ডিরেক্টর মীরা মজুমদার বললেন, ‘তোমার ভাষ্য এবং সমস্ত স্ক্রিপ্ট ইংরেজিতে অনুবাদ করে দাও। আমি সব নিয়ে দিল্লিতে যাব।’ মীরাদি দিল্লিতে কর্তৃপক্ষকে সমস্ত অনুষ্ঠান দেখিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে আমরা কেবল আমাদের কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করেছি। তাই আমার বদলি রদ হল।
বন্যার কবল থেকে মানুষ দুর্দম প্রাণশক্তিতে কী ভাবে নতুন করে জেগে উঠছে, অনুষ্ঠানে তা দেখাতে গিয়ে, রবীন্দ্রভবনের প্রথম ডিরেক্টর ক্ষিতীশ রায়ের পরামর্শে, ব্যবহার করেছিলাম জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের ‘নবজীবনের গান’: ‘এসো হাত লাগাই হাত লাগাই হাত লাগাই/ ভেঙে পড়া গ্রামে প্রাণের দুর্গ ফিরে বানাই।’ বিখ্যাত সব শিল্পীকে অনুরোধ করেছিলাম বন্যা নিয়ে ছবি আঁকতে। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়, শানু লাহিড়ী, রবীন মণ্ডল, প্রকাশ কর্মকার, সুনীল দাস আঁকলেন। তাঁদের ছবি নিয়ে এক বিশেষ অনুষ্ঠান করেছিলাম।
আমার পেশা-জীবনে নিজেকে সবচেয়ে বেশি ধন্য মনে করেছিলাম ১৯৭৮-এর ওই বন্যার সময় শহরে-গ্রামে দুর্গত মানুষের কথা তুলে ধরতে পেরে, সামান্য হলেও তাঁদের কিছু কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য সক্রিয় হতে পেরে। একটা মজার কথা মনে পড়ছে। জলের সঙ্গে আমার ছবি তখন একেবারে জড়িয়ে গিয়েছিল। সেই সময় ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ ফিল্মে নায়ক যখন নায়িকা জিনাত আমনকে জলোচ্ছ্বাস থেকে দু’হাতে তুলে আনছেন, তখন দর্শকদের মধ্যে থেকে মন্তব্য শোনা গেল: এ তো পঙ্কজ সাহা! বন্ধুদের কাছে এ কথা শুনে খুব হেসেছিলাম।
pankajsaha.kolkata@gmail.com