ঘুমের অসুখ আর সুখেরা

অদ্ভুত এক ঘুমের অসুখে বেহুঁশ তরুণ সৈনিকের বিছানা ঘিরে ওরা তিন নারী। হাসপাতালের মেট্রনই বাকি দুজনকে দেখায় ব্যাপারটা। ঘুমের মধ্যেই কোন গোপন স্বপ্ন দেখে ইট্ নামে ওই ছেলেটি উত্তেজিত হচ্ছে।

Advertisement

শান্তনু চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share:

অদ্ভুত এক ঘুমের অসুখে বেহুঁশ তরুণ সৈনিকের বিছানা ঘিরে ওরা তিন নারী। হাসপাতালের মেট্রনই বাকি দুজনকে দেখায় ব্যাপারটা। ঘুমের মধ্যেই কোন গোপন স্বপ্ন দেখে ইট্ নামে ওই ছেলেটি উত্তেজিত হচ্ছে। আসলে এদের মধ্যেই একটি মেয়ে, তার নাম কেঙ, তার ‘অতীন্দ্রিয়’ বিদ্যায় ওই সব ‘ঘুমন্ত’ সৈনিকদের শরীর ছুঁয়ে, তাদের মনের অন্দরে, স্বপ্নের ভেলায়, ইচ্ছের নদীতে সওয়ার হয়।

Advertisement

ওই সৈনিকদের বউরা, বা প্রেমিকারা কেঙ-এর কাছে জানতে চায়, সৈনিকদের ‘বর্তমানের’ খবর। কিন্তু মেয়েটি শুধু সৈনিকদের স্মৃতিতে-অতীতে ভেসে বেড়ায়। মেট্রন আর একটি মেয়েকে বলে, জানো তো, অন্যের মনের কথা ‘পড়ে ফেলা’র বিশেষ গুণের জন্য, কেঙ-কে এফবিআই মোটা মাইনের চাকরি দিতে চেয়েছিল,কিন্তু কেঙ যায়নি। হাসপাতালের খোলা কাফেটেরিয়ায় কেঙের সঙ্গে প্রথম আলাপের সময়, সেই মেয়েটি, জেন‌্‌জিরা, বলেও ফেলে, তুমি তো এফবিআই-এর এজেন্ট। কেঙ শুধু হাসে। আর ওরা বন্ধু হয়ে যায়।

জেন‌্‌জিরা এক জন গৃহবধূ। যে পুরনো স্কুলবাড়িতে এই নতুন হাসপাতালটা তৈরি হয়েছে, জেন্‌জিরা এক সময় সেই স্কুলটায় পড়ত। তার একটা পা, আর একটা পায়ের চেয়ে দশ সেন্টিমিটার ছোট। তবু বিশেষ জুতো পরে, ক্রাচ নিয়ে সে রোজ হাসপাতালটায় আসে। স্কুলবেলার আলতো স্মৃতিগুলোয় আদর বোলাতে বোলাতেই সে ওই ঘুমিয়ে থাকা সমস্ত সেনাদেরই দেখভাল করে। তবু ইট্-এর জন্য তার ওই স্বেচ্ছাসেবায় কোথায় যেন একটু বাড়তি যত্ন, মায়া লেগে থাকে।

Advertisement

ইট্ও সেই স্পর্শে সাড়া দেয়। ঘুমের অসুখ থেকে মাঝে মাঝে জেগে উঠে সে জেন্‌জিরার সঙ্গে বেড়াতে যায়। পথের ধারের রেস্তরাঁয় খায়, সিনেমা দেখে। পার্কে বসে দুজনে গল্প করে। টুকটাক, সাধারণ কথা। হারিয়ে যাওয়া সময়ের কথা। ছবির দ্বিতীয় পর্বে আবার দেখা যায়, কেঙ জেন্‌জিরাকে ‌ ইট্-এর স্মৃতির গ্রামে স্বপ্ন-সফর করাচ্ছে। কেঙ যেন তখন ইট্-এর স্মৃতির আত্মা— জেন্‌জিরার সঙ্গে তার সংলাপ চলে।

গোটা ছবিটায় এ ভাবেই খটখটে বাস্তবের গায়ে গায়ে লেগে থেকেছে ফ্যান্টাসির পৃথিবী। লেখক-পরিচালকের আগের ছবিগুলোর সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা জানেন, উনি এ ভাবেই ছবি বানান। সেখানে মন্দিরের দেবীরা সাধারণ মানুষীর বেশে, মেয়েলি আড্ডার ছলে দৈববাণী শুনিয়ে যান। চেনা রাস্তায় এমনি চলতে চলতেই স্বপ্নের সিংদরজা পেরিয়ে যায়। অবশ্য এ ছবিতে রাজনৈতিক রূপক খোঁজাই যায়। হাসপাতালের বিছানায় ছড়ানো-ছেটানো ঘুমন্ত সৈনিকেরা, তাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি সরকার-প্রশাসনের কী-করি-আজ-ভেবে-না-পাই গোছের জড়ভরত বিভ্রান্তির প্রতীক হতে পারে। আর যখন জানা যায়, ওই স্কুল তথা হাসপাতালটার নীচেই আছে প্রাচীন রাজাদের কবরখানা এবং সেই রাজারা এই সৈনিকদের জীবনীশক্তি শুষে নিয়েই তাঁদের পুরনো ক্ষমতার যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন তো দেশটার এই ‘রাজার উচ্ছিষ্ট’ গোছের দশার সঙ্গে ইতিহাসের যোগও খুঁজে পাওয়া যায়।

আবার হাসপাতালের ডাক্তারবাবু যখন ‘ঘুমন্ত’ রোগীদের নাকে একটা নতুন চিকিৎসা-যন্ত্র পরিয়ে দিতে দিতে বলেন, আমেরিকা তাদের সৈন্যদের জন্য আফগানিস্তানে এটা ব্যবহার করেছিল, তখন এক জন নার্স সরল, নিরীহ ভঙ্গিতে, ঝাঁঝালো রাজনৈতিক প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়, ‘আচ্ছা, ওরাও কি ওখানে দুঃস্বপ্ন দেখত?’

তবে এ ছবিটাকে শুধুই রাজনৈতিক রূপক বললে ভুল হবে। পরিচালক আসলে একটা ভীষণ ধীর-শান্ত সময়ের স্রোতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অতীত আর বর্তমানের দৃশ্যগুলোকে এ ধার-ও ধার করেছেন। ছবিটা অনেকটাই ওই ঘুমন্ত সৈনিকদের শরীরের স্পন্দনের মতোই নিশ্চল। ক্যামেরাও তাই প্রায়ই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মিড বা লং শটে সময় আর দৃশ্যগুলোকে নিজেদের মতো বয়ে যেতে দিয়েছে। সে ভাবেই আমরা দেখি, ছবির একদম শুরুর দৃশ্যে প্রাগৈতিহাসিক জন্তুর মতো দেখতে যে মাটি-কাটা যন্ত্রটা হাসপাতালের পাশের জমিটায় খোঁড়াখুঁড়ি করছিল, কবরে শুয়ে থাকা রাজাদের অভিশাপের ভয়কে পাত্তা না দিয়ে জমিটাকে সে পুরোটাই খুঁড়ে ফেলেছে। আর সেই মাটির ঢিপিটা উঁচু আর বড় হতে হতে বাচ্চাদের ফুটবল খেলার মাঠটাকে পুরোটাই কেমন ঢেকে ফেলল! ক্যামেরা দূরে থাকলেও ধুলো-মাটির নোংরা গুঁড়ো যেন আমাদের গায়ে এসে লাগে।

sanajkol@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement